কৃষাণী অনুনয় বিনয় করে। কাঁদো কাঁদো হয়ে অনুরোধ করে, ‘ও মুরগীবু একটা ডিম দেও না! কত দিন ডিম পাড় না!’
মুরগী গম্ভীর হয়ে বলে, ‘নাহ, আপনাদের পরিবারে কোন দেশপ্রেম নাই। আপনার স্বামী টিভিতে উন্নয়ন সংবাদ দেখে হাসে। আপনার ছেলে ফেসবুকে উন্নয়নের সরকারের যে কোন ভালো খবরে হাহা করে।‘
কৃষাণী বলে, ‘কিন্তু আমি তো ঠিক আছি বু, আমি বাঁচলেও নৌকা, মরলেও নৌকা। আমার কসম লাগে একটা ডিম দাও।‘
এমন সময় মুরগীর স্বামী মোরগ ঘরে ফেরে মোরগ লীগের শান্তি মিটিং থেকে। সে কৃষাণীকে ধমক দিয়ে বলে, ‘আপনারা কখনও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন? স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছেন? আপনারা কি দেশের শত্রু ইউনুসের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন? আপনাদের মতো অকৃতজ্ঞ মানুষ আর দেখিনি। প্রিয়তমা মুরগী আমার, খবরদার ডিম দেবে না ওদের।‘
মুরগী গম্ভীর হয়ে বলে, ‘সামনে ইলেকশনে আমার প্রিয় সরকার ক্ষমতায় টিকে গেলে তবেই ডিম দেব, তার আগে নয়। আগে দল তারপর ডিম।‘
কৃষক এসে মোরগকে বলে, ‘ভাই আমরা গরীব মানুষ, আমরা তো কোন দল করি না!’
মোরগ ধমক দিয়ে বলে, ‘আপনার শ্বশুরের মামার মেয়ের জামাই তো যুবদল করে!’
কৃষক ঘাবড়ে যায়, ‘মোরগ ভাই, এতো দূরের আত্মীয়, সে কোন দল করবে না করবে! সেটা আমি তো ঠিক করে দিই না!’
: যান যান, আপনাদের আমার চেনা আছে।
মানভঞ্জনের জন্য কৃষাণী খাবার নিয়ে আসে মোরগ-মুরগীর জন্য!
মুরগী গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আমার ক্ষিদা নাই। খেতে ইচ্ছা করছে না। নিয়ে যান ওসব।‘
মোরগ পরামর্শ দেয়, ‘আমি বলি কী! এই ঘরের দেয়ালে পদ্মা সেতুর একটি ছবি টাঙিয়ে দিন। পারলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রাতের ছবিটাও দরকার। উন্নয়নের পরিবেশটা বেশ রোমান্টিক লাগে। তখন নিশ্চয়ই আমার প্রিয়া ডিম দেবে!’
মুরগী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘একটু দেশের গান বাজানোর কথা তো বললে না; দরকার হয় ক্রিকেটের গানটা বাজান, জিতবে এবার বাংলাদেশ।‘
মোরগ কৃষককে বুঝিয়ে বলে, ‘আপনাদের বাড়ির পরিবেশটা ঠিক প্রগতিশীল নয়। রুচির দুর্ভিক্ষ যেন এখানে।‘
কৃষক বলে, ‘আপনি যেইভাবে বলবেন সেইভাবেই হবে।‘
ছেলেটা বাসায় এলে কৃষাণী জিজ্ঞেস করে, ‘ও মন্টু প্রগতিশীলতা কীরে বাবা?’
: ও তো খুব কঠিন জিনিস আম্মা। কুঁচি দিয়া শাড়ি পরতে কী তুমি পারবা; পারবা কী খোঁপা করতে; সেইখানে একটু বেলিফুলের মালা?
ছেলের কথা মতো প্রগতিশীল সাজে কৃষাণী। কৃষক বাজার থেকে শেভ করে, চুলে কলপ দিয়ে, হাতে একখানা বই নিয়ে আসে।
ছেলে তার মোবাইল ফোনে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে দেয়,
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?
এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ,
এ যে বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরম বেদনা।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?।
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি--
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ--
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?
মোরগ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বন্ধ করেন এই গান; সংসদ আর সাংসদ নিয়ে একি নির্মম রসিকতার গান! দেশের জন্য যারা দিনমান খেটে অস্থির, তাদেরকে এমন হেসে উড়িয়ে দিতে লজ্জা করে না মন্টু? রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে একটু কোমল কথা যেখানে, ঐগুলো প্রগতিশীল সংগীত। যেমন, আজ জ্যোছনা রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।'
কৃষক-কৃষাণী বসে, আজ জ্যোছনা রাতে সবাই গেছে বনে শুনতে থাকে। মোরগ নির্দেশনা দেয়, ‘মাথাটা দোলাতে হবে, একটু মন খারাপ একটু মুচকি হাসি। গানটা বুঝতে চেষ্টা করুন। ঐ মন্টু তুমি টিশার্ট পরে কেন! যাও পাঞ্জাবি পরে এসো! আসুন আমরা সবাই আসন করে বসি। আমি যাই দেখি ডিমের কী খবর!’
কৃষক-কৃষাণী-মন্টু উৎসুক হয়ে তাকায় সেদিকে। একটু পরে মোরগ কৃষাণীকে ডাকে; মুখটা গম্ভীর করে বলে, ‘অবশেষে মুরগী ডিম দিয়েছে। কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি, এই ডিমের দাম ১২ টাকা। বাজারে নিয়ে গিয়ে ১২ টাকায় বেচে আসতে বলুন মন্টুকে।‘
মন্টু বলে, ‘কিন্তু পত্রিকায় দেখলাম ডিমের দাম ৬ টাকারও কম বিশ্ববাজারে!’
মোরগ বলে, ‘ওটা বৈশ্বিক মূল্যবোধের সংকট। বিশ্বের আর কোন মোরগ-মুরগীর এত দেশপ্রেম ও প্রগতিশীলতা আছে নাকি?’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন