চোরাজকতার কাঁকনদাসীদের ‘কাজল রেখা’-র ছদ্মবেশ

২৩৯ পঠিত ... ১৮:২৭, জুলাই ১৫, ২০২৪

22

আলফাডাঙ্গা গ্রামের লোক খুব চালাক। বোয়ালমারি গ্রামকে বোকা বানাতে তারা জিজ্ঞেস করে, বলুন দেখি ‘আই ডোন্ট নো’ বাক্যের মানে কী?

বোয়ালমারি গ্রামের লোক উত্তর দেয়, আমি জানি না।

অমনি আলফাডাঙ্গার লোকেরা শোরগোল তোলে, বোয়ালমারির লোক কিছু জানে না।

গতকাল ‘প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি’ আসরে দুজন সাংবাদিক তেলাঞ্জলি দেবার ঢং-এ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রসঙ্গে এমনভাবে প্রশ্ন করে যাতে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর আসে, সরকারি চাকরিতে কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি পাবে না তো রাজাকারের নাতি নাতনি পাবে!

জেনারেশন জেড (জেনজি) যাদের জন্ম একবিংশ শতকে; তারাই রাজপথে কোটা সংস্কার আন্দোলন করছে। ফেসবুকে নিয়মিতভাবে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের তরুণ-তরুণীকে ‘রাজাকার’ তকমা দিয়ে চলেছে সরকার সমর্থকেরা। এর ওপর অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত একজন প্রধানমন্ত্রী রাজাকার বিষয়ক সুইপিং কমেন্ট করলে; আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে যে শ্লোগান দেয়;

তুমি না আমি না

রাজাকার রাজাকার

চাইতে গেলাম অধিকার

হয়ে গেলাম রাজাকার।

সেখান থেকে ঐ ‘আই ডোন্ট নো’ গল্পের গ্রামের লোকের মতো চল্লিশ থেকে ষাট বছর বয়েসী সরকার সমর্থকেরা ‘রাজাকার’ শব্দটি তুলে নিয়ে ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভূতিতে আঘাত পাবার অভিযোগ তোলে। ভঙ্গিটা হুবহু ধর্ম চেতনার লোকেদের মতো, যারা ধর্মীয় চেতনায় আঘাত লেগে ‘নাস্তিক’ বলে তকমা দেয়া। এরকম আচরণকে পেডোফিলিক আচরণ বলা যায়।

২০১৮ সালে একই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা ছিল তাদেরকে ‘রাজাকার’ তকমা দিয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরী। তখনও ঠিক আজকের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

যেদেশে ১৯৭১ সালে প্রায় ০.২৫ শতাংশ সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; সেখানে তাদের নাতি-নাতনিদের ৩০ শতাংশ কোটা বেশ অবাস্তব। কমনসেন্স বলে এই কোটা সংস্কার করা প্রয়োজন।

১৯৭১ সালে রাজাকারের সংখ্যা প্রায় ০.২৫ শতাংশ ছিল। মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারকার্য সম্পাদনের মাধ্যমে কার্যত ‘রাজাকার’ ইস্যুটিকে অপ রাজনীতির স্বার্থে চুইংগামের মতো টেনে লম্বা করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনকালে তারা সুশাসন দিতে ব্যর্থ হওয়ায়; ইতিহাসের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। দুর্নীতি, গুম, ক্রসফায়ার, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পুলিশ-প্রশাসন এরকম প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিনাশ ঘটিয়ে চারপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন এই দলের কোলাবরেটরেরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। উল্লেখ্য যে ঔপনিবেশিক বৃটিশ ও পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের তুলনায় স্বকালের এই স্বদেশী কোলাবরেটরেরা দেশের অধিক সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার করেছে।

এই ডাকাতের দলের বড় গলা হচ্ছে দুর্নীতি ও লুণ্ঠন করে ধর্মপ্রেম ও দেশপ্রেম প্রদর্শন। হজ্বের ছবি আপলোড কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্ল্যাকার্ড তুলে ধরা; এই দুই-ই হচ্ছে দেশডাকাতের অপরাধ লুকানোর ছল।

যে সরকারের সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক আইজিপি, রাজস্ববিভাগের শীর্ষ কর্মকতা দেশডাকাতি করে ধরা পড়ে, সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তার ভ্রষ্টাচারের কাহিনী প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে; স্বর্ণ চোরাচালানকারী সংসদ কলকাতায় গিয়ে কিমা হয়; সেই অপরাধী চক্রের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয়গান, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মুখে ধর্ম চেতনার জয়গানের মতোই বেমানান।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর তিনটি ভোটহীন নির্বাচন স্বৈরাচারের কালো চিহ্ন হিসেবে স্বকালের কোলাবরেটরদের ললাটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রথম অঙ্গীকার ‘গণতন্ত্র’ হত্যার স্মারক। দলীয় ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো খাওয়া, পুলিশ-প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণগুলো ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়া; ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বৈষম্য সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশে; যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।

আওয়ামী লীগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি ও ভাস্কর্য সওদা করে; মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব দলীয় করণ করে; বৃটিশ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের জমিদারি বন্দোবস্তীর অনুকরণে; বাংলাদেশে সুপার এলিট তৈরির নেশায় মাতোয়ারা।

‘এই সুপার এলিট’ তৈরির প্রকল্পে ক্ষমতাসীনেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহার করে; ‘যদি তুমি সঙ্গে থাকো তবে তুমি বেশ, যদি তুমি সমালোচনা করো তবে তুমি শেষ’ নীতিতে চড়াও হয়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। বৈষম্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই সাধারণ মানুষকে ‘রাজাকার’ তকমা দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছে স্বৈরাচারী গোষ্ঠীটি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আন্তরিক হলে ০.২৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে গত পনেরো বছরে একটি কাঙ্ক্ষিত জীবনমান দেয়া যেত। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করা যেত। ‘রাজাকার’ তালিকা প্রণয়ন করে যত্রতত্র তকমা দিয়ে বেড়ানোর অশ্লীলতা থেকে জাতিকে মুক্ত করা যেত।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের তরুণ-তরুণীদের গড়ে ‘রাজাকারের নাতি-নাতনি’ বলে তকমা দেওয়া একটি গর্হিত অপরাধ হয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রধানমন্ত্রী যখন পাকিস্তানি শত্রুসেনার তত্ত্বাবধানে সিএমএইচ-এ চিকিৎসা নিয়েছেন; তখন বাংলাদেশের অযুত মা সন্তান গর্ভে নিয়ে খুনে পাকিস্তানি সেনার ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, ধর্ষণের ভয়ে অনেকে নিজেকে অসুন্দর দেখাতে মাথার চুল কেটে ফেলেছেন, অনেকে সহায় সম্বল হারিয়ে শরণার্থী মিছিলে যোগ দিয়েছেন, অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রান্না করেছেন; এইভাবে বাংলাদেশ মা নয় মাসের যুদ্ধে সহযোদ্ধা হয়ে উঠছেন। তাদের নাতি-নাতনিকে সুইপিং কমেন্ট করে ‘রাজাকার’ তকমা দেওয়া যে কত বড় অন্যায় হয়েছে; তা প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাথায় পতাকা বেঁধে অস্ত্র হাতে ছবি তুলে যারা সিক্সটিন্থ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল; মুক্তিযুদ্ধের কাজলরেখা গল্পের সেই কাঁকন দাসীরা মুক্তিযুদ্ধের সুফল ঘরে তুলেছে বাড়ি-ঘর-ব্যবসা দখল করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপসার্ভিস দিয়ে এরা সেই বৃটিশ কোলাবরেটর ও পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের মতো বুর্জোয়া বৈঠকখানা সাজিয়ে নিও রুলিং এলিট হয়েছে।

ফেসবুকে সেই সিক্সটিন্থ ডিভিশন মডেলের নতুন প্রজন্মের কিছু কাঁকনদাসী চোখে পড়ে। এদের সবার লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপসার্ভিস দিয়ে কাজল রেখা সেজে দেশলুণ্ঠনের সুযোগ লাভ। গত পনেরো বছরে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপ সার্ভিস দিয়ে দেশের মালিক সেজেছেন, তারাই অবৈধ সম্পদ, পদ, পদক, প্লট বাগিয়েছেন। আর এইভাবে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে ইতিহাসের সেই বৃটিশ কোলাবরেটর ও পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের মতো গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়াই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ; যারা প্রতিদিন শ্রম দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে; তাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের গড়ে রাজাকারের নাতিপুতি তকমা দিয়ে স্বকালের কোলাবরেটরদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের চোরাজকতা ঢেকে রাখা প্রায় অসম্ভব। বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিলেই বৃটিশ ও পাকিস্তানি কোলাবরেটররা সাধারণ মানুষকে দেশদ্রোহী তকমা দিত। স্বকালে স্বদেশী উপনিবেশের কোলাবরেটরেরা একইভাবে বৈষম্য বিরোধীদের দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে একই রকম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; এত বলাই বাহুল্য।

২৩৯ পঠিত ... ১৮:২৭, জুলাই ১৫, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top