‘বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা বলি। সেবার মুরাদ চত্ত্বরে আঁকছিলাম। আঁকার মোটামুটি আশিভাগই শেষ। এ সময় কয়েকটা আপু এসে আবদার করল তারাও আঁকতে চায়। তাদেরকে রঙ আর ব্রাশ দিলাম। তো আপুরা রঙ আর ব্রাশ হাতে নিয়েই আঁকার বদলে ছবি তোলা শুরু করল। ছবি তোলা দেখে যে কারো মনে হবে তারাই আসল আর্টিস্ট! রঙ, ব্রাশ হাতে ছবি আঁকার অভিনয়ের ছবি তোলা শেষ করে তারা আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো। মজার ব্যাপার হলো তারা যেখানে ব্রাশ ধরেছিল সেখানটা ছিল লাল রঙের, আর তারা যে ব্রাশ ধরে আঁকার ভান করেছিল সেটা ছিল হলুদ রঙের ব্রাশ। ব্যাপারটা আমি অবশ্য শুরু থেকেই খেয়াল করেছিলাম, কিন্তু একবারও বলিনি!’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ মামুরকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল রাঙানোর সময়কার মজার অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করলে এমনই নানান মজার গল্প শুনিয়ে দেন তিনি। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের দেয়াল রাঙানোর ব্যাপারটা কী?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলেই ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারবেন, কারণ দেয়ালে রঙ-বেরঙের সব আঁকিবুকি আপনার নজর কাড়বেই। ক্যাম্পাসের দেয়াল যেখানে আগে বিসিএসের কোচিং কিংবা ছাত্র সংগঠনের পোস্টারে ছেয়ে থাকতো, সেসবের বদলে এখন কোথাও শোভা পাচ্ছে বিদেশি সিনেমা বা বাংলা সাহিত্যের চরিত্র কিংবা কিছু দেয়ালে শুধুই যেমন খুশি তেমন আঁকা।
২০১৬ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগরে হিম উৎসব নামে শীতকালীন একটি উৎসব শুরু হয়। প্রথমবার হিম উৎসব উপলক্ষ্যে ক্যাম্পাসের কিছু দেয়ালকে নতুনভাবে রাঙান চারুকলার শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ মামুর। এরপর থেকেই শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল রাঙানোর অভিযান। একা শুরু করলেও পরবর্তীতে তার সাথে যোগ দেন চারুকলা বিভাগেরই অপর্ণ অধিকারী। এছাড়াও আঁকিবুকিতে প্রায়ই তাদের সাথে যোগ দিয়েছে থিন জো মং, আবির আর্য, ফারজাদ দিহান, ফারিশা, জাকিয়া রহমান তামান্না, রুবায়েত রায়হানসহ আরো অনেকে। যদিও ক্যাম্পাসের দেয়াল রাঙানোর ব্যাপারটা তারা সার্বজনীন একটা বিষয় হিসেবে নিয়েছে। এ কারণে প্রতিটি ছবি আঁকার সময় অনেক মানুষই যুক্ত থাকে।
আব্দুল্লাহ মামুর বলেন, ‘চাইলে যে কেউ যুক্ত হতে পারে আমাদের সাথে। কেউ হয়তো পানি আনে, দেয়ালে সাটানো পোস্টার পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, কেউ রঙের কৌটা খোলে, কেউ শুধু সঙ্গ দেয় বসে থেকে, আবার কেউ হয়তো শখ করে দুয়েক যায়গায় রঙের ব্রাশ দিয়ে সামান্য আচড় দেয়, কেউ কেউ যেন ছবিটা আসলে সেই আঁকছে এমন ভান করে শুধু ছবিই তোলে। তবে আঁকার মূল কাজটা এক থেকে তিনজনই করে থাকে।’
শুরুর দিকে ক্যাম্পাস রাঙ্গানোর এ অভিযানে বন্ধু-বান্ধবরা নিজেই টাকা জমিয়ে রং কিনতো। কিন্তু রং এর দাম তো নেহায়েত কম নয়। ফলে কিছুদিন যেতে আর কুলোতে না পেরে অভিযানে প্রায় ইতি টানতে হয়েছিল তাদের। কিন্তু শেষমেশ ভরসা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু প্রাক্তন ও বর্তমান সিনিয়র শিক্ষার্থী। তারা স্বেচ্ছায় এমন উদ্যোগে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যান। আর ক্যাম্পাস রঙিন করে তোলার অভিযানটাও শুরু হয় নতুন করে।
ক্যাম্পাসের অধিকাংশ দেয়াল এঁকে ভরিয়ে ফেলার আশাতেই মূলত আঁকাটা শুরু হয়েছিল তাদের। সকল দেয়ালে আঁক্র ক্ষেত্রে আগ থেকে জল্পনা-কল্পনা করা হয়না। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট বিষয় বা থিমকে কেন্দ্র করেও দেয়ালকে রঙে ভরিয়ে তোলে তারা। এই যেমন জাহাঙ্গীরনগরের টিএসসির দেয়ালগুলোতে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অ্যানিমেটিক জগতের নানা চরিত্রকে। আবার যাত্রী ছাউনিতে পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যকে। হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যের তিন ‘দা’ কেও- ফেলুদা, ঘনাদা ও টেনিদা। কোথাও পাওয়া যাবে ব্যাটম্যান আর তার চির শত্রু জোকারকে, কোথাও গেলে আবার মনে হবে যেন হারিয়ে গেছি মহাকাশের অতলে। দেয়ালে দেয়ালে রঙ-তুলির মিশেলে যেন গল্প, সিনেমা, চরিত্র, পরিবেশ সব জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এক ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য আকর্ষণ করে সকলকেই। তার মাঝে ইট-পাথরের দেয়াল, যাত্রী ছাউনি কিংবা রাস্তার লেন সবটা যখন রঙ-তুলির জোয়ারে রঙিন হয়ে ওঠে তখন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কিন্তু এক টুকরো স্বর্গের চাইতে কম কিছু মনে হয় না।
কিন্তু শেষমেশ এই স্বর্গে রাজনৈতিক দেয়ালচিত্রের জায়গা হয় কিনা জিজ্ঞেস করলে আব্দুল্লাহ মামুর জানান, ‘এমন অনেক ব্যাপারই থাকে যেগুলো আঁকার ইচ্ছে থাকলেও আঁকা সম্ভব হয় না। তারপরেও ঝুঁকি নিয়ে কিছু ছবি আঁকা যে হয়নি তাও নয়। মাঝে মাঝে কিছু গ্রাফিটি আঁকা হয় যেগুলো খুব বেশিদিন থাকে না। মুছে দেয়া হয়।’
ঘরে বসেই এক নজরে দেখে নিন রঙিন জাবি ক্যাম্পাসের কিছু চিত্র-
১#
২#
৩#
৪#
৫#
৬#
৭#
৮#
৯#
১০#
১১#
১২#
১৩#
১৪#
১৫#
১৬#
১৭#
১৮#
১৯#
২০#
২১#
২২#
২৩#
২৪#
২৫#
২৬#
২৭#
২৮#
২৯#
৩০#
৩১#
৩২#
৩৩#
৩৪#
৩৫#
৩৬#
৩৭#
৩৮#
৩৯#
৪০#
৪১#
৪২#
৪৩#
৪৪#
৪৫#
৪৬#
৪৭#
৪৮#
৪৯#
৫০#
৫১#
৫২#
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন