২০১৯ সালে আমার দেখা প্রিয়তম মুভিটা একটা ফরাসি এনিমেটেড ফিল্ম। নাম: আই লস্ট মাই বডি।
জানি, মুভি রিভিউ এই ভঙ্গিতে লেখা হয় না। প্রচলিত না। তবে, রুচি যেহেতু ব্যক্তিভেদে বদলায়, আর আমিও যেহেতু আমার ভাল্লাগা বা মন্দলাগারে এবসলিউট কিছু মনে করি না, আমার চোখে গত বছরের শ্রেষ্ঠতম বা প্রিয়তম মুভিটা নিয়া কিছু কথা বলতে এবং কেন এত ভাল্লাগার সেই নিয়া কয়েকটা মন্তব্য করতেই পারি।
শুরুতে জানায়ে রাখি আমি আইরিশম্যান, জোকার, ম্যারিজ স্টোরি, দ্য লাইট হাউস, ১৯১৭ বা প্যারাসাইটের মতো ২০১৯-এ রিলিজ হওয়া ডাকসাইটে মুভির চাইতে আই লস্ট মাই বডি'রে আগায়ে রাখতে চাই।
স্পয়লারে যাদের সমস্যা তাদেরকে এলার্ট দিয়া শুরু করি।
মুভিতে দুইটা গল্প সমান্তরালে চলতে থাকে। একটা বিছিন্ন কাটা হাতের আরেকটা প্রেমের বা জীবনের মিনিং খুজে পাওয়ার। এবং দুইটা গল্প আসলে একই এবং একটার দাথে আরেকটা জড়িত।
প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় একটা মেডিকেল রেফ্রিজারেটর থেকে কাটা একটা হাত পালায়ে যাইতেছে। জ্বি, জাস্ট একটা কাটা হাত। পলিথিনের ব্যাগ থেকে বের হওয়া থেকে শুরু কইরা যে আশ্চর্য এক জার্নি শুরু হয় হাতটার৷ হাতটা কোথায় জানি যাইতে চায়। কেন চায়? কার কাছে যাইতে চায়? কাহিনীর একদম শেষে না গেলে সেইটা বোঝা যায় না। কিন্তু হাতটার পথে পথে কঠিন রোমহর্ষক সব বাধা।
হাতটা সমস্ত ধরণের থ্রেট আর বাধা পারায়ে যাইতে চেষ্টা করে নগর প্যারিসের রাত্রির এই জার্নিতে৷ চলমান সাবওয়ে ট্রেনের নিচে ইদুরের সাথে লড়াইয়ের দৃশ্যটা দেখলে আপনার পক্ষে ভোলা কঠিন হবে। তবে হাতটা হার মানে না। আমরা জানি না সে কী চায়,,কোথায় যায়, শুধু বুঝি সে কোথাও পৌছাইতে চায়। শুধু জানি কোনো এক অন্ধ বাসনা, গোপন মিশন নিয়া সে আগাইতে থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ড্যান লেভির অসাধারণ স্কোরের পাশাপাশি এই দৃশ্যগুলা মোটামুটি সংলাপবিহীন।
আমার তো মনে হয় জাস্ট ৩-৪ ঘন্টা শুধু হাতের জার্নিই আমি দেখতে পারতাম। আর লেভির স্কোর এতো সুন্দর আর আবেগ জাগানিয়া যে আপনি আলাদাভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা সাউন্ডট্র্যাক শুনতে পারবেন।
মুভিটায় এমন অদ্ভুত সুন্দর কিছু মুহূর্ত আছে যা ভোলা কঠিন। আমি নিজেও ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে দেখে এখন স্মৃতি থেকে লিখতেছি। আর প্রতিটা দৃশ্যই আমার চোখে ভাসে। অনেক জায়গায় মনে হয় যেন স্বপ্নদৃশ্যে আপনি হাজির হইছেন, অন্তত ঘুম আর জাগরণের মাঝে আটকা পড়া অবস্থার মতো লাগতে পারে।
সমান্তরাল দুই গল্পের ২য়টায়, নওফেল নামের পিজা ডেলিভারি বয়ের গ্যাব্রিয়েলে নামের হিপ মেয়ের প্রতি ভালোলাগায় আমার আগ্রহ কম কাজ করছে। এক বৃষ্টিবিঘ্নিত রাতে পিজ্জা ডেলিভারি দিতে গিয়া, -পিজ্জা অবশ্য সাইকেল এক্সিডেন্টে ভাইঙা যায়- গ্যাব্রিয়েলের কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়। প্রথাগত রোমান্টিক গল্পের প্লটের মতো মনে হইতেছে না, যেখানে নায়ক নিজে যতটা ভাবে তার চাইতেও অনেক বেশি ক্রিপি। গ্যাব্রিয়েলরে দেখার পর নওফেলের মধ্যে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ও অর্থহীন জীবনে পরিবর্তনের চেষ্টা দেখা যায়।
আমার আগ্রহ বেশি কাজ করছে, নওফেলের প্রেমে না, নওফেলের সুখের লাগি চেষ্টা করার পরিণতি দেখতে৷
এইটার কারণ হইতেছে চিত্রনাট্যকার জেরেমি ক্লাপি আর সহলেখক গুলিয়ামে লরেনের করা হাত নিয়া অসাধারণ দৃশ্যকল্পের ব্যবহার। একটা কাটা হাতের মধ্যেও এতখানি মানবিক ইমোশন যে নিয়া আসা সম্ভব তা এই মুভি না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
[আপনি ফরাসি মুভি অল্পস্বল্প দেখলেও লরেনের সাথে পরিচিত হওয়ার কথা৷ চমৎকার, মধুর কমেডি ফিল্ম 'এমিলি'-এর লেখক লরেন। না, দেখলে বলবো 'এমিলি' দেইখা ফেলেন। দেখলে সম্ভবত আফসোস করবেন না। আমারে ধন্যবাদও দিতে পারেন।]
কর্তিত, বিচ্ছিন্ন এই হাতের জার্নি আর নওফেলের প্রেমের জার্নি সমান্তরালে চলতে থাকে। গল্পবয়ানের কৌশলগুণে আরও হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে যখন সমান্তরাল দুই গল্পের মেল্পবন্ধন সিনেমার শেষে গিয়া হয়। আমরা জানতে পারি হাতটা কার কাছে যেতে চায়, সে কার হাত আসলে, কোন অন্ধ বাসনায় প্যারিসের রাস্তার বিপদসংকুল এতটা পথ সে পাড়ি দিয়া আসছে।
আমার দেখা সবচাইতে ক্রিয়েটিভ, এনিমেটেড ফিল্মগুলার একটা। এইরকম ফিল্ম কয়টা আছে যা একই সাথে, রোমহষর্ক, মন্ত্রমুগ্ধ কইরা রাখা অথচ অসম্ভব পোয়েটিক মেলাঙ্কোলিয়ার সৌন্দর্যে ভরা?
নিশ্বাস বন্ধ কইরা দেখার মতো নফেল যখন ফ্ল্যাশব্যাকে বিস্ময়ভরা শৈশব থেকে দেখতে থাকে তার শৈশবের নভোচারী আর পিয়ানিস্ট হওয়ার স্বপ্ন কিভাবে রূপান্তরিত হয় পিজ্জা ডেলিভারির বয়ের বাস্তবতায়। হ্যান্ড-এনিমেটেড এই ফিল্মে এক বিষন্ন করুণ মায়াময় সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়।
আপনার সিনেমারুচি আমার সাথে যদি সামান্যতমও মেলে তাহলে খুব সম্ভব মুভিটা দেখতে গিয়া আপনি প্রতিনিয়ত আমাদেরকে টুকরা টুকরা করে ফেলা এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়ার সংগ্রামে পাওয়া ক্যাথারসিস ও এক গভীর স্বপ্নময় আনন্দের মুখোমুখি হবেন।
আপনি বুঝবেন আই লস্ট মাই বডি যতটা না প্রেমের গল্প, তার চাইতে অনেক বেশি আসলে ট্রাজেডি পরবর্তী জীবনের মুখোমুখি হওয়ার গল্প। সারফেসে থ্রিলার বা হরর টাইপ মনে হইলেও মূলত মুভিটা নস্টালজিয়ায় মাখামাখি, মেলাঙ্কোলিক। ক্রিপি কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর।
ক্রিপি ওই হাতটার দ্বন্দ্বমুখর, আধার ঘনায়ে আসা, যাত্রার মধ্যে নিজেরে হঠাৎ আবিষ্কার কইরা বসলেও অবাক হয়েন না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন