তৈলব্রত ও বোমাব্রত (প্যাসেজ টু হেভেন: পর্ব ২১)

৮৭ পঠিত ... ১৬:৫৩, জুন ২৫, ২০২৪

20 (13)

বেহেশতে গান্ধীজীর আশ্রমে জরুরী বৈঠক বসেছে। ঘটনা গুরুতর। গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরে হিন্দু-মুসলিম, শিয়া-সুন্নী দাঙ্গা পরিস্থিতি। ঈশ্বরের দপ্তর থেকে গান্ধীজীর কাছে চিঠি এসেছে। এরকম চলতে থাকলে ভারতীয় উপমহাদেশের লোকদের বেহেশত থেকে বহিষ্কার করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। গান্ধীজী উদাস চোখে বসে। সুভাষ বোস বলেন, গান্ধীজী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আপনি সবসময় এমন মৌনব্রতে চলে যান কেন!

গান্ধীজী একটা কাগজে খসখস করে পেন্সিল দিয়ে লিখে দেন, জিন্নাহ আর নেহেরুকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা উচিত। কেন ভারতীয় উপমহাদেশের লোকের আজ অবস্থা তার উত্তর দুজনকেই দিতেই হবে।

নেহেরু-জিন্নাহ একসঙ্গেই প্রবেশ করেন।

সুভাষ বোস নেহেরু-জিন্নাহকে গান্ধীজীর প্রশ্নটা করেন।

নেহেরু বলেন, আগে জিন্নাহ বলুন।

জিন্নাহ বলেন, আমি তো ৪৭ এর পর বেশীদিন বাঁচিনি। আমি কী করে বলব!

গান্ধীজী একটা কাগজে লিখে দেন, ইয়াং এজে থিয়েটার করেছো ভালো কথা; আমার সামনে নাটক কোরো না।

নেহেরু সেটা পড়ে বলেন, গান্ধীজী আপনি ভারতবর্ষের লোককে চেনেননি। এরা বিভাজনের আর সংঘর্ষের ছুঁতো খোঁজে। ভালো থাকতে এদের একদম ভালো লাগে না।

জিন্নাহ বলেন, গান্ধীজী এইটা তখন বুঝি নাই যে পাকিস্তানে যা হিন্দু আছে তাদের উচ্ছেদ করে; এরপর মুসলমানরা  শিয়া-সুন্নী দাঙ্গা শুরু করবে।

নেহেরু ম্লান হাসি হেসে বলেন, আমি ভেবেছিলাম অনেকদিন আলাদা থেকে এরা বুঝবে একসঙ্গে থাকাই ভালো ছিলো। জার্মানীর লোক বুঝলো। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা বুঝলোনা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নীরবতা ভেঙ্গে দেবুদাকে জিজ্ঞেস করেন, ইতিহাস নিয়ে ইউটোপিয়ান সেমিনার করে লাভ নেই বাপু। গোবরডাঙ্গা আর শিয়ালনগরের আপডেট দাও।

দেবুদা জানায়, বেহেশত কতৃপক্ষ জানাচ্ছে, যেসব পুলিশ সেখানে নিয়োগ করা হয়েছে এলাকাবাসী তাদের ঘুষ খাওয়া শিখিয়েছে। বেহেশতের কোন কর্মকর্তা শিয়ালনগরে গেলে তারা তোরণ নির্মাণ করে, গোবরডাঙ্গার লোকেরা সেলফি তুলে তাদের ভি আইপি করে তোলে। এতে বেহেশতের অন্য এলাকায় এসব পুলিশ বা কর্মকর্তা রাখা যাচ্ছে না; কারণ তারা ইউরোপের লোকের কাছে তোরণ এবং ক্যানাডার লোকের কাছে সেলফি তুলে তাদের সেলিব্রেটি বানানোর জন্য ফেসবুকে ছবি আপলোড করার ও তৈলঘন পোস্ট দাবী করছে। বেহেশত কতৃপক্ষ অভিযোগ করছে, ভারতীয় উপমহাদেশের লোক তৈলব্রত পালনের মাধ্যমের বেহেশতের সৌম্য ও সুশ্রী সমাজটাকে স্থূল করে দিচ্ছে।

সত্যজিত রায় মুচকি হেসে বলেন, স্থূলতার আর দেখেছে কী! ষোলকলা পূর্ণ করবে এরা।

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, এই তৈলশাস্ত্রে দক্ষতা না থাকায় আমাকে পূর্বপাকিস্তানের কিছু লোক ভারতের দালাল বলতো আর ভারতের কিছু লোক বলতো পাকিস্তানের দালাল। ভারতবর্ষের জীবনে তৈলব্রতটা মাস্ট। তাহলে পদ-পদক অনায়াসে জুটে যায়; রথী-মহারথী হওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনার সমকালে যারা তৈলব্রত পালন করতো তাদের কাউকে এই বৈঠকে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি।

দেবুদা কথাটা লুফে নেয়, এই ব্যাপারটাই গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগরের উঠতি বুদ্ধিজীবীদের বোঝানো যায়না। এমন কী বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-দের বোঝানোও অসম্ভব।

গান্ধীজী কাগজে খসখস করে লিখে দেন, এখন কী করা যায় ?

ইন্দিরা গান্ধী সুতীক্ষ্ণ গ্রীবা উঁচিয়ে বলেন, এসবকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় ওঠানো ঠিক নয়। গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরে অভিযান চালিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা উচিত। বঙ্গবন্ধু কী বলেন!

বঙ্গবন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, পুলিশ এবং প্রশাসনকে যেহেতু তারা তৈলব্রতে হাত করে ফেলেছে; দেখা যাবে কতৃপক্ষ নিরাপরাধ লোকদের ধরে আনবে। চোরের খনির চাটার দলগুলো ঠিকই রয়ে যাবে।

গান্ধীজী কাগজে খসখস করে লেখেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহমত। অহিংস কোন সমাধান যদি আসে!

নেহেরু এবং জিন্নাহ উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় প্রার্থনা করেন, প্রিয় গান্ধীজীর এই অহিংসার বাণীতে আমরা ক্লান্ত। ক্ষমা করবেন লিডার।

সুভাষ বোস বলেন, আমার মত লোক এখনো শান্ত হয়ে অনাসৃষ্টির কথা শুনছি; আর আপনারা এতটুকুতেই অধৈর্য্য হয়ে গেলেন।

গান্ধীজী কাগজে লেখেন, যেতে চায় যাক; কী আর করা!

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সভায় ঢুকেই জানান, প্রতিমা ভাঙ্গার মাঝ দিয়ে শেষ হলো পুজো। বোমা হামলার মাঝ দিয়ে চলছে আশুরা। মুসলমানরা বেশ বোমাব্রত পালন করছে। বেহেশত থেকে এরপর ভারতবর্ষের লোকদের ঘাড় ধরে বের করে দিলে; আমাদের কী প্রতিবাদের কোন মুখ রইলো!

বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ান, আমি যাবো গোবরডাঙ্গা আর শিয়ালনগরে; মানুষের সঙ্গে কথা বলবো!

তাজউদ্দীন থামিয়ে দিয়ে বলেন, লিডার আপনার কী দ্বিতীয়বার ওদের হাতে খুন হবার স্বাদ জেগেছে।

গান্ধীজি লিখে দেন, আমিও যেতে চাই।

সুভাষ বোস বলেন, চলুন যাওয়া যাক। শেরে বাংলা সাহেব আছেন ভয় কী!

শেরে বাংলা বলেন, আমার সুস্বাস্থ্যটাকে সবাই ঈর্ষা করেন।

খুব বিষণ্ণ মুহূর্তের নীরবতা ভাঙ্গে হাসির রোলে।

প্রথমে গোবরডাঙ্গায় গিয়ে দেখা গেলো কিছু লোকের মুখে কালি লাগানো।

দেবুদা জিজ্ঞেস করে, ব্যাপার কী!

সত্যজিত রায় বলেন, এটা কালিব্রত; গরুর মাংস খেলেই আরএসএস পান্ডারা মুসলমানদের মুখে কালি ছুঁড়ে মারছে।

শিয়ালনগরের একাংশে চলছে হিন্দুদের পুজা মন্ডপ ভাঙ্গার উতসব, শিয়াদের ওপর হালকা বোমাব্রত। আর এক অংশে হিন্দু নেই তাই শিয়াদের ওপর চলছে বোমা উতসব। এগুলো জামাতের পান্ডাদের কাজ।

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, এগুলো দেখলে আমার দোজখে গিয়ে মওদুদী আর গোলাম আজমের মুখে ঝামা ঘষে দিতে ইচ্ছা করে। ঝামাব্রত।

সত্যজিত রায় হাসেন, আর আমার বালথ্যাকারের মুখে একটা বানরের স্কেচ আঁকতে ইচ্ছা করে।

ভারতীয় উপমহাদেশের শীর্ষ নেতারা এলাকা পরিদর্শনে এসেছে শুনে জামাত ও আরএসএস-এর লোকেরা দ্রুত কিছু তোরণ বানিয়ে ফেলে। জামাতের লোকেরা নেতাদের গায়ে গোলাপজল ছিটায়। আর-এস-এস-এর লোকেরা পুষ্পবর্ষণ করে। শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে মুশতাক। বঙ্গবন্ধুকে বলে, এতোটা পথ হেঁটে এসেছেন। পায়ে একটু তেল মালিশ করে দেবো লিডার। তাজউদ্দীন রেগে তাকাতেই মুশতাক কেটে পড়ে।

নাত্থুরাম গডসেই একটি তেলের বোতল হাতে গান্ধীজীর দিকে এগিয়ে আসে, বাপু পা ব্যথা করছে কী; একটু তেল মালিশ করে দেবো কী! ইন্দিরা গান্ধী বলেন, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হয়না। খুনী কোথাকার। নাত্থু ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যায়।

দেবুদা আর এস এস-এর এক পান্ডাকে জিজ্ঞেস করে, এই ভদ্রলোকের মুখে কে কালি ছুড়েছে?

পান্ডা উত্তর দেয়, উনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ কালিঝুলি লাগতেই পারে।

মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে এমন এক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তরুণ গুহ। তাকে জামাতের লোকেরা (কেউ কেউ সাম্যবাদী দলে নতুন যোগদান করেছে) নিয়ে এসেছে নেতাদের সামনে সাক্ষী দেয়াতে। তরুণ গুহ বলেন, মন্দির মেরামতের টাকা আমার ছিলোনা। এসময় আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন এক সহৃদয় ব্যক্তি; যার বাবাও শান্তিকার ছিলেন। উনাদের পরিবার শান্তির কৈলাস পর্বত। নতুন একটি মন্দির তৈরীর জন্য এ মন্দিরটি ভাঙ্গা হয়েছে আমার পূর্ণ সম্মতিতে। কিছু সুশীল ষড়যন্ত্রকারী এই শান্তিকার পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার লক্ষ্যে আপনাদের বিভ্রান্ত করে এখানে এনেছে। এটা বেহেশতের মধ্যে সেরা স্বর্গ আমার।

বঙ্গবন্ধু বলেন, বুঝেছি; আমার আর বুঝতে বাকী নেই কিছু। তবে তরুণ বাবু আপনার বাবা আমার পরিচিত ছিলেন। উনি আমাদের সবসময় উপদেশ দিতেন, সদা সত্য কথা বলিবে।

এরপর বোমা হামলার কথা জিজ্ঞেস করতেই পান খেতে খেতে এক জামাতের লোক বলে, সামান্য পটকা ফুটেছে স্যার!

ভীড়ের মাঝে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে এগিয়ে আসে সুনীতি নামের একটা মেয়ে। সে বলে, আমাকে সাইবার হ্যারাসমেন্ট করা হয়েছে। সাম্যবাদী দলের নাম ভাঙ্গিয়ে একটা বর্বর দল অশ্রাব্য গালি দিয়ে অনলাইনে নারী নিগ্রহ করে।

পরিদর্শক দলে চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন ছিলেন। তিনি এগিয়ে আসেন। সুনীতির কাঁধে হাত রাখেন।

এমন সময় অভিযুক্ত আসামী কাভি খান কাঁচুমাচু তৈলব্রত ভঙ্গিতে একটি কাগজ নিয়ে এগিয়ে আসে। সুচিত্রা সেনকে দেখায়, আমার আইডি হ্যাক হয়েছিলো মহামান্য। অন্য কেউ আমার নামে গিয়ে পরম শ্রদ্ধেয়া সুনীতিদিকে গালি দিয়েছে। আমি ভাজা মাছ উলটে খেতে পারিনা; সাদাসিধে তরলপায়ী অসহায় মানুষ। আমি ছোট আমাকে মারবেন না। আমি আমার আইডি হ্যাক হওয়াতে জিডি করেছিলাম, বেহেশতের পুলিশ সাক্ষী। এই তার কপি।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন কাগজটা পড়ে বলেন, জিডিতো ঠিকই আছে; তাছাড়া কাভি খান সাম্যবাদী দলে খুব সুনামের সঙ্গে কাজ করে।

সত্যজিত রায় বলেন, কাভি খানের মত এমন জাত অভি’নেতা পেলে আমি সত্যিই তাকে আমার ফিল্মে নিতাম। ছবির নাম দিতাম ‘এলিবাই’। আসলে গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগরের সমস্যাগুলো সবই মিডিয়ার সৃষ্টি! আমরাই ভুলবশত পরিদর্শনে এসেছি।

কাভি খান তুমুল উৎসাহিত হয়ে তৈলব্রতঘন কণ্ঠে বলে জি স্যার চারিদিকে ষড়যন্ত্র। উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।

(চলবে)

২২তম পর্বের লিংক

২০তম পর্বের লিংক 

৮৭ পঠিত ... ১৬:৫৩, জুন ২৫, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top