গণতন্ত্র উপভোগ করুন (প্যাসেজ টু হেভেন: পর্ব ২০)

১৪৭ পঠিত ... ১৮:০৭, জুন ১২, ২০২৪

19 (7)

বেহেশতে দেবুদার মনটা ক্রমেই বিষিয়ে উঠতে থাকে। কারণ গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরের সাধুবাবা ও পীরসাহেব বড় রকমের বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর গৃহকর্মী মুশতাক আর গান্ধীজীর আশ্রমকর্মী নাত্থুরাম গডসের নিয়মিত যাতায়াত গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরে। মুশতাক গিয়ে মন্দির ভাঙ্গার উস্কানি দিয়ে আসে; গডসে গিয়ে গোরু জবাই বন্ধের বুদ্ধি দিয়ে আসে স্ব স্ব গোত্রে। সেই যে এক হিন্দু-মুসলমান কচলানির বদ-অভ্যাস এতো দূর হবার নয় ভারতবর্ষের বেহেশতবাসীদের। ফলে বেহেশতটাকে নরক বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে মুশতাক-গডসে চক্রটা। এরা মাঝে মাঝে দোজখে গিয়ে জামাত-আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আসে। বেহেশতের পরিবেশটা কী করে হুবহু দক্ষিণ এশিয়ার মত বর্জ্য-ঝুড়িতে পরিণত করা যায়; সেই লক্ষ্যে তাদের এতো আয়োজন।

শান্তিনিকেতনে যাবার পথটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। গোবরডাঙ্গা এবং শিয়ালনগরের লোকেদের নারী দেখলেই জিভ লক লক করে। একটি-দুটি ধর্ষণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে বেহেশতের পুলিশ বিভাগের সহায়তায়। ভাগ্যিস এরা দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশ নয়; নইলে এরি মাঝে অঘটন ঘটে যেত। দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশ কাজের চেয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদলিপিটা খুব সুন্দর লিখতে শিখেছে; আর কিছুই যে শেখেনি। দেবুদা বেহেশতের পুলিশেরা খুব ভালো এমন একটি সন্তোষ নিয়ে কফিতে চুমুক দিতেই খবর আসে, চুনিলাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে; নারী পাচারকারী হিসেবে। তাজ্জব ব্যাপার চুনিলাল এবং নারী পাচার-তা আবার বেহেশতে।

শিয়ালনগর ও গোবরডাঙ্গায় গুজব রটে যায় চুনিলাল বেহেশত থেকে চারটে হুর দোজখে পাচারের চেষ্টা করার সময় ধরা পড়েছে। পুলিশস্টেশানে গিয়ে দেবুদা দেখে, পার্বতী-চন্দ্রমুখী-লায়লা-জুলিয়েট আর চুনিলাল মুখ পাংশু করে বসে আছে। চুনিলালের ট্যাক্সিতে চারজন একটু লং-ড্রাইভে গিয়েছিলো। বেহেশতের পুলিশের সেটাকে নারী পাচার মনে হয়েছে। দেবুদা মনে মনে ভাবে, পুলিশ পুলিশই; তা সে বেহেশতেরই হোক বা ঢাকার রামপুরারই হোক। রামপুরা থেকে পুলিশ চারজন স্বেচ্ছাসেবীকে গ্রেফতার করেছে শিশু পাচারকারী হিসেবে। অথচ স্বেচ্ছাসেবীরা অধিকার বঞ্চিত শিশুদের স্কুল চালাতো। চুনিলালেরও একই অবস্থা বেহেশতের পুলিশের হাতে। চুনিলালকে তারা রিমান্ডে নিয়ে যাচ্ছে; জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। দেবুদার সঙ্গে চোখ গরম করে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলে, আপনি আমাদের কাজে ইন্টারফেয়ার করবেন না। আমি আইন-কানুন আপনার চেয়ে বেশী জানি।

দেবুদার কাছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফোন আসে, খুব বাজে ঘটনা ঘটে গেছে দেবু। শান্তি নিকেতনের টিউশান ফি’র ওপর ভ্যাট আরোপিত হয়েছে। শিক্ষার ওপর ভ্যাট; এ কেমন কথা! ছাত্ররা রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। তবে শিয়ালনগরের কিছু সন্ত্রাসী ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। তারা তো চায় শান্তিনিকেতন বন্ধ হয়ে যাক। সবাই শিয়ালনগরের বা গোবরডাঙ্গার লোকের মত অশিক্ষিত হয়ে থাকুক। কিছু একটা করা দরকার দেবু।

দেবুদার ভীষণ দিশেহারা লাগে। এসব কী শুরু হলো! এ কী বেহেশত!

বঙ্গবন্ধুর ফোন আসে, দেবুদা ঘটনা খুব খারাপ। কারা যেন গোবরডাঙ্গার মন্দিরে প্রতিমা ভেঙ্গেছে। প্রতিমা ভাঙ্গার সময় জয় বঙ্গবন্ধু বলে শ্লোগান দিয়েছে। এরা কারা দেবুদা। আমাদের সাম্যবাদী দলের লোকেরা তো প্রতিমা ভাঙ্গার কথা নয়। ছি ছি; খুব খারাপ লাগছে দেবুদা।

দেবুদা দেখে আরেকটা কল ওয়েটিং-এ। গান্ধীজীর ফোন। দেবুদা বঙ্গবন্ধুকে বলে, বঙ্গবন্ধু যে কেউ যে কোন জায়গায় গিয়ে আপনার নামে শ্লোগান দিয়ে অপরাধ করলেই; এটা আপনার ইমেজ নষ্ট করতে পারবে না। সবাই আপনাকে চেনে আপনি কেমন মানুষ। আমি গান্ধীজীর সঙ্গে একটু কথা বলে আপনাকে ফোন করছি বঙ্গবন্ধু।

গান্ধীজী ভীষণ বিক্ষুব্ধ। শিয়ালনগরের এক লোক গরু নিয়ে যাচ্ছিলো; বোধ হয় কুরবানী দেবার জন্য। গোবরডাঙ্গার কিছু দুবৃত্ত লোকটাকে মেরেছে। তারা জয় গান্ধীজী জয় গান্ধীজী বলে শ্লোগান দিচ্ছিলো লোকটাকে মেরে গরুটা কেড়ে নিয়ে যাবার সময়। আমার তো মাথায় আসেনা সাম্যবাদী দলের লোকেরা এমন কাজ কেন করবে!

দেবুদা সময় ক্ষেপন না করে ঈশ্বরের দপ্তরে যায়। একজন কর্মকর্তাকে জানায় সমস্যার কথা। কর্মকর্তা কুমড়োর মত মুখটা বেশ গম্ভীর করে বলে, বেহেশতে আমরা আপনাদের গণতন্ত্রের স্বাদ দিতে চেষ্টা করছি নানাভাবে। একে উপভোগ করার চেষ্টা করুন।

শান্তিনিকেতনের দিকে যাওয়ার পথে দেবুদা দেখে গোবরডাঙ্গার লোকেরা বঙ্গবন্ধুর কথিত অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করছে। বঙ্গবন্ধুরও সমালোচনা চলছে বক্তৃতায়। দেবুদা তাদের এক নেতা গোছের লোককে গিয়ে বলে, যারা মন্দিরের প্রতিমা ভেঙ্গেছে; এরা জামাতের লোক। মুশতাকের মাধ্যমে সাম্যবাদী দলে ঢুকেছে।

প্রতিবাদ সভার মাঝ থেকে কে একজন দেবুদাকে দালাল বলে গালি দেয়। গোবরডাঙ্গার লোক তো দালাল শব্দটা এদের জিভের আগায় লটকে থাকে।

দেবুদা গালি খেয়ে আরেকটু এগিয়ে দেখে শিয়ালনগরের লোকেরা, কুরবানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং গান্ধীর সমর্থকদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দেবুদা এগিয়ে গিয়ে বলে, ওরা আর এস এস-এর লোক; নাত্থুরামের মাধ্যমে সাম্যবাদী দলে ঢুকেছে। একজন ভেংচি কেটে দেবুদাকে দালাল বলে গালি দেয়। আইডেন্টিক্যাল গালি। এখান থেকে বোঝা যায় গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরের লোকের ধর্ম আলাদা; কিন্তু জিন একই। বাইরে শুধু হিন্দু মুসলমান; ভেতরে একই অন্ধকার।

দুর্ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনা। শিয়ালনগরে এক সন্তানের সামনে মার সম্ভ্রমহানি করে একদল সাম্যবাদী দলের হাইব্রীড ক্যাডার।

শিয়ালনগরবাসী প্রতিবাদে ফুঁসে উঠলে; পুলিশ গুলি চালায়। ৪ জন নিহত হয়।

দেবুদা ঈশ্বরের দপ্তরের কর্মকর্তাকে ফোন করে, কিছু করুন প্লিজ। এ তো অকথ্য ঘটনা।

কর্মকর্তা হেসে বলে, কিছু পুলিশকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাদ দিন না। গণতন্ত্রের স্বাদ নিন। উপভোগ করুন।

এরপর ঘটে আরো এক ভয়ংকর ঘটনা। প্রগতিশীল সাম্যবাদী দলের ক্যাডার এক তরুণীকে ধরে নিয়ে গিয়ে সারারাত নির্যাতন করে।

দেবুদা পুলিশকে ফোন করে, কী ব্যাপার আপনারা পেয়েছেনটা কী!

পুলিশ বলে, আসামী সহৃদয় ব্যক্তি; সে মেয়েটিকে নির্যাতন করলেও; ভোরে পৌঁছে দিয়েছে বাসায়। কজন নারী নির্যাতকের এমন দায়িত্ববোধ থাকে বলুন। প্লিজ গণতন্ত্র উপভোগ করুন।

এরমধ্যে কবিগুরুর ফোন আসে, সর্বনাশ দেবু শান্তি নিকেতনের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। সব শেষ হয়ে গেলো দেবু সব শেষ; কখনো এমন ভাবিনি এসব নিজ চোখে দেখতে হবে।

: কী করবেন কবিগুরু গণতন্ত্র উপভোগ করুন।

মানে! এখানে উপভোগ করার কী পেলে; সবই তো দুঃসংবাদ।

: কবিগুরু ঈশ্বরের দপ্তরে ফোন করলে ওরা শুধু বলে, গণতন্ত্র উপভোগ করুন।

গোবরডাঙ্গায় প্রকাশ্যে নেমে পড়ে আর এস এস-এর পান্ডারা। তারা ঘোষণা দেয়, শিয়ালনগরের মুসলমানেরা কীভাবে কুরবানী ঈদে গোরু জবাই করে তা তারা দেখে নেবে। গোবরডাঙ্গা থেকে শিয়ালনগরে গোরু নিয়ে যেতে বাধা দেয়। মুসলমানেরা গো-মাংস ভক্ষণ করতে পারবে না সাফ কথা।

শিয়ালনগরে জামাত থেকে সাম্যবাদী দলে ঢোকা মুশতাক পান্ডারা প্রকাশ্যে নেমে পড়ে। অঘোষিত প্রতিমা ভাঙ্গার কাজ চলতে থাকে। এরমধ্যে জমিদখল, বাড়ী থেকে উচ্ছেদ এসব তো লেগেই আছে। বাড়ীতে তরুণী মেয়ে থাকলে বাবা-দাদা রাত জেগে পাহারা দেয়। কখন সাম্যবাদী দলের মুশতাক পান্ডারা এসে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে এই ভয়ে।

বিবর্ণ বেদনায় ঈদ এবং পুজা এই দুটো উতসবই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

দেবুদার মাথায় খুন চড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর গেট থেকে মুশতাককে একপাশে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি কী চান! কেন আপনি জামাত থেকে সাম্যবাদী দলে লোক ঢুকিয়েছেন! কেন তারা প্রতিমা ভাঙ্গছে; কেন মানবী প্রতিমার সম্ভ্রমহানি করছে! এসব অনেক তো করেছেন। এবার একটু ক্ষান্ত দিন। আর কত বর্বর হলে আপনার বর্বরতার ক্ষুধা মিটবে?

মুশতাক মুচকি হেসে বলে, একবার বঙ্গবন্ধুকে খুন করে আমরা যে তাকে হত্যা করতে পারিনি; আমি এবার তার প্রগতিশীল সাম্যবাদী দলের লোকদের দিয়েই তাকে আবার হত্যা করবো! আই মিন তার ইমেজ। তার স্বপ্ন।

দেবুদা গান্ধীজীর আশ্রমে গিয়ে নাত্থুরামকে ধরে। ব্যাপারটা কী! আর কত ধর্ম নিয়ে খেলবেন আপনারা। আর এস এস-এর পান্ডাদের দিয়ে এসব কী শুরু করেছেন! মানুষ ঈদ করতে পারবে না; সে গরু কুরবানী দিতে পারবে না! এসব অনর্থক বিদ্বেষের নেশা ছাড়ে না কেন আপনাদের! আর কতো বিভাজিত হলে আপনাদের বিভাজনের ক্ষুধা মিটবে!

নাত্থু গম্ভীরভাবে বলে, বাপুজীকে একবার হত্যা করে আমি যে তাকে হত্যা করতে পারিনি; আমি এবার তার ভাস্কর্যে ফুল দেয়া লোকদের দিয়েই তাকে আবার হত্যা করবো। তার সুনামটাকে আর কী! তার স্বপ্নটাকে।

(চলবে)

২১তম পর্বের লিংক

১৯তম পর্বের লিংক

১৪৭ পঠিত ... ১৮:০৭, জুন ১২, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top