বেহেশতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কেন এ বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন শান্তিনিকেতনে পালিত না হয়ে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বাড়িতে পালিত হলো; এতে রবীন্দ্রানুভূতিতে আঘাত লেগেছে লোক দেখানো রবীন্দ্রভক্তদের। বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক বলদা রায় এই ঘটনার মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। দেবুদা কি তবে বৃটিশের দালাল সেইতো কবিগুরুর জন্মদিন শান্তি নিকেতনে হতে না দিয়ে উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের বাড়িতে নিয়ে গেছে; কত পাউন্ড খেয়েছে দেবুদা! এই প্রশ্ন বলদা রায় ছুঁড়ে দিয়ে দিয়েছে বেহেশতের সুধী মহলে।
ব্যাপারটা শুনে কবিগুরুর চক্ষু কপালে উঠে গেছে। উনি বুঝে পারছেন না।
রবীন্দ্রানুভূতি বিষয়টা আসলে কী! আর এই বলদা রায়টা কে! ওর মধ্যে এতো রবীন্দ্রানুভূতি এলো কোথেকে!
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কবি কাজী নজরুলের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান ফোনে। দুঃখ প্রকাশ করেন, দেখো নজরুল আমার শান্তি নিকেতনে আসার পথে গোবরডাঙ্গার সাধুবাধার আশ্রমের লোকগুলো আজকাল কোন মুসলমানকে শান্তি নিকেতনের পথে দেখলে ত্রিশূল নিয়ে তেড়ে আসে । আর তারপর আছে শিয়ালনগরের মোল্লার মাজার। তারাও তো তোমাকে নাস্তিক মনে করে। তোমাকে এ পথে আসতে দেখলে চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসবে। এই কারণে ইচ্ছা থাকা সত্বেও তোমার জন্মদিন শান্তি নিকেতনে করা গেলো না। ক্ষমঃ মোরে ভ্রাতঃ।
বিদ্রোহী কবি বলেন, কবিগুরু কোন দরকার নেই। শান্তিনিকেতনে আমার জন্মদিন হলে, কোন এক বলদা ফারাবীর নজরুলানুভূতিতে লেগে যাবে। এরাই একদল আমাকে মুরতাদ বলে; আবার একদল আমাকে মুসলিম কবি হিসেবে পীর মেনেছে; খাদেম হয়েছে। কী মুশকিল! গুরু করি কী?
বেহেশতে কবি নজরুলের জন্মদিন কেন পালিত হচ্ছে না এই নিয়ে মুসলমান সমাজে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গৃহকর্মী খোন্দকার মুশতাক ফোন করে বলদা ফারাবীদের নজরুলানুভূতিটি আরেকটু ঘন করে দেয়।
বেহেশতের গান্ধীজীর আশ্রমের সেবা কর্মী নাত্থুরাম গডসে ফোন করে বলদা রায়কে। রবীন্দ্রানুভূতির ‘ ইস্যুটা' যেন হারিয়ে না যায় এবং এই ইস্যুতে দেবুদাকে সাইজ করে দেবার সংকল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।
দেবুদা এপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকায়। একটু বুক ভরে অক্সিজেন নেয়। আনা মিট মিট করে হাসে।
: কী দেবুদা তোমার সফট মুভমেন্টের শখ কি মিটেছে? কবি নজরুল আমাকে ফোন করেছিলেন, বলেছেন উনার জন্মদিনে কোন পার্টি দেয়ার দরকার নাই। এমনি বলদা রায়দের ‘ রবীন্দ্রানুভূতিতে’ লোগেছে; আবার যদি বলদা ফারাবীদের 'নজরুলানুভূতিতে’ লেগে যায় তুমি এতো ঝামেলা সামলাবে কী করে? বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট ইজ ‘ বলদা’ ?
: তোমার জানার দরকার নাই আনা।
: ঠিক আছে। আচ্ছা দেবুদা হোয়াট ইজ ‘অনুভূতি'?
: এইটা তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না। তুমি তো অনুভূতি মানে শুধু মানবিক অনুভূতি জেনে বড়ো হয়েছো রাশিয়ায়। কিন্তু আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মানবিক অনুভূতি বাদে বাকি সব বিচিত্র অনুভূতি আছে। আমাদের সমাজে এ পীরপ্রথা বা সাধুপন্থা চালু থাকায় এক একজন ব্যক্তিকে ঘিরে তার খাদেম সমাজ গড়ে ওঠে । তুমি যদি এই খাদেমদের পুজনীয় কাউকে সমালোচনা করো; এ ব্যক্তির চেয়ে তার খাদেমদের ‘অনুভূতিতে' বেশি আঘাত লাগে।
: সত্যি দেবুদা তোমার সঙ্গে পরিচয় না হলে আমি অনেক ‘বিনোদন' থেকে বঞ্চিত হতাম।
গান্ধীজী ফোন দিয়েছেন, দেবু কী করা যায় ভায়া! নজরুলের জন্মদিন কি হবে না? আমার আশ্রমে করা যায়। কিন্তু জানো তো আমার আগে থেকেই মুসলমান প্রীতির দুর্নাম আছে। দেখো ভেবে কী করবে!
: বাপু বলদা রায়রা কবিগুরুর জন্মদিনের দাওয়াত না পেয়ে এমনিতেই যা: তা বলছে; এখন আবার নজরুলের জন্মদিন করতে গিয়ে বলদা ফারাবীদের গালি খেতে হবে। কারণ আমার করা অতিথি তালিকায় কখনো বলদা রায় বা বলদা ফারাবীরা থাকবে না; সে তো সুনিশ্চিত।
চুনিলালের ফোন আসছে, জরুরি কিছু; বাপুর কাছ থেকে একটু চিন্তার সময় চেয়ে নেয় দেবুদা।
: হ্যালো চুনিদা কী হয়েছে।
: দেবুদা যত্রতত্র মৃত্র বিসর্জন বন্ধে মোল্লা-পুরুতের বুদ্ধিতে আর কথিত 'প্রগতিশীল'দের সমর্থনে সেই যে দেয়ালে আরবি লেখা হলো আর দেবদেবীর ছবি আঁকা হয়েছিলো; ওটা ব্যাক ফায়ার করেছে। বিসর্জন অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার লোক দাদা এরা; স্বর্গে এসেও যত্র: তত্র মূত্র ত্যাগ করবে; এতো জানা কথা।
: এইটা কোন খবর চুনিদা! নতুন কোন আপডেট থাকলে দাও ।
: বঙ্গবন্ধুর বাড়ির চাকর মুশতাক আর গান্ধীজীর বাড়ির চাকর নাত্থুরাম বেহেশতে বিরাট সেলিব্রেটি হয়েছে। লোকজন এদের সঙ্গে সেলফি তোলে। এগুলোকে দোজখ থেকে ডেপুটেশানে বেহেশতে আনাই ভুল হয়েছে; এবার শুরু হয়েছে নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে বেড়ানো; আর পানি ঘোলা করে বেড়ানো ।
: বুঝেছি চুনিদা এরা বেহেশতে আরেকবার বঙ্গবন্ধু এবং গান্ধীজীর ইমেজ হত্যা করবে । ব্যাপারটা উনাদের জানানো দরকার ।
: দ্যাখো যা ভালো বোঝো করো ।
হঠাৎ আনার চেহারায় গভীর মেঘের ঘনঘটা । এক মগ কফি এগিয়ে দিয়ে বলে,
: দেবুদা তোমার কি মনে হয় না তোমার জীবনে আমার আসলে কোন প্রয়োজন নেই: তোমার প্রতিটি কাজে আমি পাশে থাকি। মাঝে মধ্যেই তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে বিপদে পড়ো। তখন কাউন্সেলিং করে তোমার কনফিডেন্স ফিরিয়ে আনার কাজে আমিই আসি। কিন্তু তুমি কি কখনো আমার মনের খবর জানতে চেয়েছো?
: সেইরেছে; এতো আসল ‘অনুভূতি’ র কবলে পড়া গেলো ।
: ফান করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা কোরো না; আই এম সিরিয়াস।
: আনা এইটা ব্যক্তিগত ঝগড়ার সময় না। চারিদিকে অনেক সমস্যা। তোমার প্রবলেম হচ্ছে তোমার কোন প্রবলেম নাই। কিন্তু এই মোল্লা: পুরুত আর নানারকম হাস্যকর অনুভূতি বেচে খাওয়ার যে সাম্প্রদায়িক ও অব: গ্রগতিশীল দোকানদারিগুলো চলছে; এগুলো বন্ধ করা করা দরকার ।
: তো আমাদের ব্যক্তিগত ঝগড়ার একটা এপয়েনমেন্ট কৰে পেতে পারি!
হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর ফোন এসে দেবুদাকে বাঁচিয়ে দেয় আনার ঝগড়া পর্ব থেকে।
: দেবুদা আপনি কই? বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে কোন সাড়া শব্দ নেই?
: বঙ্গবন্ধু রবিদার জন্মদিন শেক্সপীয়ারের বাসায় করায় রবীন্দ্রানুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
: হাহ হাহ হাহ শোনেন কিছু লোক থাকেই এরকম অনুভূতির রোগী; এই মুশতাকটাই তো বঙ্গবন্ধু অনুভূতি বিক্রি করে বেড়ায়। কিন্তু আসলে কী জিনিস সে তো জানেনই। যাদের মনে প্রকৃত শ্রদ্ধাবোধ থাকে না তাদের এরকম অনুভূতি চেটে খেতে হয়। আমি তাই এদের ‘ চাটার দল’ বলি। তো এই চাটার দল কে কী বলছে তার জন্য কি দেবুদার থেমে থাকা উচিত?
: বঙ্গবন্ধু আপনি সত্যিই আত্মবিশ্বাসের যাদুকর। কাজীদার জন্মদিন আজ সন্ধ্যায় হবে।
: এবং সেটা আমার বাড়িতেই । কাকে কাকে ডাকতে চান সেটা আপনার ব্যাপার।
: ঠিক আছে বঙ্গবন্ধু সে চিন্তা আপনি করবেন না।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির লনে সাঁঝ নামে। রঙ্গিন বাতিতে স্বপ্নময় মনে হচ্ছে সবুজ ঘাসের ফুল: বাগান; রজনীগন্ধার সুঘ্রাণ মৌ মৌ করছে। সৈয়দ মুজতবা আলী দেবুদার কানে কানে বলেন, বেগম মুজিবের হাত যশ আছে; দেখছেন মশাই একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসছে কিচেন থেকে। সাক্ষাৎ অন্নদাত্রী তিনি।
কৰি কাজী নজরুল ইসলাম গান্ধীজী আর বঙ্গবন্ধুর মাঝে বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথ গল্প করছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে ।
: আপনার ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ সত্যিই একটা ক্লাসিক। আজো কতো প্রাসঙ্গিক দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায়।
: ঠাকুর আপনার এই প্রশংসায় আমার খুব খুশি হবার কথা; কিন্তু তা হই কেমন করে? আমি তো এই 'পুতুল নাচের ইতিকথার' অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা দেখতে চাইনি; আশা করেছিলাম মানুষের ভাগ্য বদলাবে; পুতুল নাচের ইতি টানবে জনমানুষ।
নজরুল আওয়াজ দেন, মানিকদা সাম্যের গান গেয়ে আমিও বার্থ হয়েছি; সমাজে মানুষকে অভুক্ত রেখে মোল্লা: পুরুত সিন্নি: প্রসাদের ঘরে তালা দেয়। আজ মান পরিচয় তো নই, সব অতি হিন্দু: মুসলমান । আর লুন্ঠক: ভোগী: ঠগীদের মুল্লুক ভরে গেছে ‘ অনুভূতি’ র উল্লুকে।
সৈয়দ মুজতবা আলী মুচকি হেসে বলেন, উল্লুক নয় এরা বলদ; কারণ বলদের অনুভূতিতে আঘাত লাগলে সে তেড়ে ফুঁড়ে আসে।
গেটের কাছে একটা জটলা । মুশতাক খবর দিয়ে বলদা ফারাবী গ্যাং আর বলদা রায় গ্যাংকে নিয়ে এসেছে ক্যাচাল পাকাতে।
দেবুদা এগিয়ে যায় গেটের দিকে; নজরুল তাকে থামিয়ে নিজে এগিয়ে যান, ধমক দিযে বলেন: শোন হে বলদ ফারাবী তোমাদের মত অনুভূতিবাজরই একসময় আমাকে নাস্তিক: মুরতাদ যা: তা বলেছো; আজ এসেছো দরদ দেখাতে!
কবিগুরু এসে বলেন, ওহে বলদা রায় তোমাদের মত অনুভূতির রোগীরা আমার ব্রাহ্ম জীবন চর্যা নিয়ে কমতো ঝামেলা করোনি? কবি: সাহিত্যিককেও তোমরা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করো । কেন বুঝতে চাও না আমরা সবাই মানুষ ।
অগত্যা বলদায়তনের লোকগুলো ফিরে যায়।
আনা একটা মাইক্রোফোন নিয়ে ঘোষণা দেয়, কিংবদন্তীর শিল্পী মোহাম্মদ রফি ‘ আলগা করগো খোপার বাঁধন' গাইবেন কাজীদার সম্মানে ।
কাজীদা বলেন, সেতো বুঝলাম আনা; কিন্তু তোমার এই শর্ট হেয়ার কাটের সঙ্গে এই গানটা কি যাবে?
সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে । অকস্মাৎ গেট দিয়ে বিনুনী দুলিয়ে অথৈ গভীর হরিণ চোখের একজন প্রবেশ করেন।
কাজীদা প্রায় বিস্ময়মাখা আনন্দে বলেন, সুচিত্রা সেন!
রফি তার কণ্ঠের অলংকারে জমিয়ে তুলেছেন মজলিশ।
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফঁস্ গ্যেয়ি।
বিনোদ বেণীর জরীন ফিতায়
আন্ধা ইশক্ মেরা কাছ গ্যেয়ি।
তোমার কেশের গন্ধে কখন
লুকায়ে আসিলো লোভী আমার মন।
বেহুঁশ হো কর্ গির্ পড়ি হাথ মে
বাজু বন্দ মে বাছ গ্যে...
কানের দুলে প্রাণ রাখিলে বিঁধিয়া
আঁখ্ ফিরা দিয়া চোরী কর্ নিন্দিয়া।
দেহের দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া
অর নেহিঁ উয়ো ওয়াপস্ গয়ি।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন