ক্রিকেট উড়ে গেল ডাংগুলি হয়ে (প্যাসেজ টু হেভেন-পর্ব ১৫)

৯৪ পঠিত ... ১৭:২২, মে ৩০, ২০২৪

33

বেহেশতে অনেকদিন পর একটু উৎসবের আমেজ। সবাই জমিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখছে। ফলে কট্টর মোল্লা আর কট্টর পুরুতকে ঘিরে ঝামেলাটা একটু স্তিমিত। দেবদাস যেহেতু সফট মুভমেন্টে আছে তাই সফট ইভেন্ট হিসেবে একটা পার্কে জায়ান্ট স্ক্রিন লাগিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখার বন্দোবস্ত করে। বেহেশতের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই খুশি ।

দেবুদার রাশান বান্ধবী আনা ক্রিকেট বোঝে না। কিন্তু ইনফ্যাচুয়েশানের কারণে মেয়েরা অনেক ট্র্যাশ নেয়; তাই দেবুদার এই সফট ইভেন্টের সব কাজ সেই করে। বাঙ্গালী অলস ছেলেদের পাল্লায় পড়ে মেয়েদের জীবন ত্যানা হতে বাধ্য। দেবুদার ভাবখানা এমন যে ইভেন্ট ডেকে দিলেই হলো; আনা তো আছেই।

খেলা দেখতে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন। জিন্নাহ-নেহেরু একসঙ্গে বসে খেলা দেখেন, সিগার মুখে নিয়ে ক্রিকেট গ্যালারিতে শৈশবে দেখা বৃটিশদের মতো অভিব্যক্তি দেন। বৃটিশ তাড়িয়েছিলেন তারা আসলে নিও-ব্রিটন হতে।

কৰি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্রোহী কৰি কাজী নজরুলকে পাশে নিয়ে খেলা দেখেন। স্বর্গের আধুনিকারা খেলা দেখার পাশাপাশি উনাদের অটোগ্রাফ নিয়ে যায়।

নেহেরু জিন্নাহকে জিজ্ঞেস করেন

--মেয়েরা পোয়েট পছন্দ করে; পলিটিশিয়ান নয়।

--মেয়েরা পলিটিকস বোঝে না। আমার মেয়েটা মুসলিম ছেলে বিয়ে না করে পার্সি বিয়ে করে কী বিপদেই না ফেলল আমাকে।

--আমার মেয়েও লন্ডনে পড়তে গিয়ে এক পার্সি ছেলের পাল্লায় পড়ে গেল।

-হয়তো পলিটিকস মানেই আগুন নিয়ে খেলা; তাই আমাদের দুজনের মেয়েই অগ্নি-উপাসক বিয়ে করেছে।

জিন্নাহ অপস্তুত হয়ে যান। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পুড়তে থাকা লাহোরের হিন্দু পাড়ার ছবি।

নেহেরুর মনে পড়ে যায় কীভাবে পাকিস্তানগামী মুসলমান শরণার্থীদের ট্রেনে আগুন জ্বলেছিল। আবেগ সামলে বলেন,

চলুন ক্রিকেটে কনসেনট্রেট করি।

জিন্নাহ পাংশু চেহারা করে বলেন, পাকিস্তান টিমের যে পারফরমেন্স;

কনসেনট্রেট করার উপায় নেই ভাই। কনসেনট্রেট করলেই উইকেট পড়ে যায়।

নেহেরু হাসিমুখে বলেন, সে তুলনায় ভারত টিমটা ভালোই খেলছে; কী বলেন?

হঠাৎ গান্ধীজী আসেন লায়লা আর জুলিয়েটের কাঁধে হাত রেখে। জিন্নাহ নেহেরুকে বলেন, বাপুজীও তো পলিটিশিয়ান; উনাকে তো দেখি মেয়েরা ভালোই পছন্দ করে।

নেহেরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বাপুজির কপাল ভায়া। পলিটিশিয়ান হয়েও

পোয়েটের সব সুযোগ সুবিধা পান।

ওদিকে এক ভারতীয় আর এক পাকিস্তানী বচসায় জড়িয়ে একে অপরের দিকে তেড়ে যাচ্ছে।

জিন্নাহ আর নেহেরু একসঙ্গে বলেন, এই রোমান মবগুলো ক্রিকেট খেলা নিয়ে মারামারি করে; এতই কোন্দলের নেশা । এরা জীবনেও হিন্দু-মুসলমান মিলে মিশে থাকার পাত্র নয়। দেশ বিভাগের জন্য মাঝখান থেকে দোষ হয় আমাদের দুজনের ।

গান্ধীজীর হস্তক্ষেপে দুই ভারত-পাকিস্তানী ক্রিকেট সমর্থক প্রশমিত হয়। চুনিলাল দুটোকে কলার ধরে পার্ক থেকে বের করে দেয়। গান্ধীজী বলেন, আহা থাক না।

চুনিদা বলে, বাপু এসব জিনিস আপনি চেনেন না; এখানে থাকলে চুলকানির মওকা খুঁজবে।

ভারতের সাবেক ক্রিকেটার পতৌদির নবাব আসেন। তিনি দেবুদাকে ডেকে বলেন, ক্রিকেটে অনেক কমার্শিয়ালিজম ঢুকে গ্যাছে। আইসিসি এখন ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়াল ক্রিকেট । ক্রিকেটের মজাটা চলে গ্যাছে।

দেবুদা বলেন, ধরেন গান্ধীজীর হত্যাকারী নাখুরাম গডসের ধর্ম নাতি সিমেন্ট ব্যবসায়ী শ্রীনিবাসন এই ক্রিকেটের দোকান চালাচ্ছে। এর কাছ থেকে আর কী আশা করেন?

পতৌদির নবাব বলেন, ও বুঝেছি। তাহলে তো ঠিকই আছে।

আনা এসে দেবুদাকে ডেকে নিয়ে যায় ঝোপের আড়ালে। এক চড় দিয়ে বলে একটু আগে তোমার ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো এক দেশের অসভ্য লোক আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেছে। এসব জংলীদের মাঝে আমাকে নিয়ে আসো কেন?

দেবুদা স্তম্ভিত হয়ে যায়। আনা এমন মেয়ে নয়; নিশ্চয়ই লোকটা খুবই বাজে কোনো কথা বলেছে।

দেবুদা বলে, সরি আনা; আমাদের উপমহাদেশে ছেলে-মেয়ে মেলামেশার ব্যাপার খুব প্রচলিত নয়। তাই পুরুষদের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা বেড়েছে; ওটা যখন করতে পারে না; তার পরিবর্তে ইভটিজিং করে; বা সাইবার বুলি করে আজকাল ।

আনা দেবুদার চড় খাওয়া গালে একটি প্রজাপতি চুম্বন এঁকে দেয়।

দেবুদা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, আনা প্লিজ সম্ভব হলে প্রতিদিন একটা করে চড় দিও।

আনা দেরুদাকে একটা উষ্ণ হামটি ডামটি হাগ দিয়ে বলে, আমি ওভার রিঅ্যাক্ট করেছি। আর কখনও এমন হবে না বেব।

বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচের সময় বঙ্গবন্ধু আসেন; লর্ড মাউন্ট ব্যাডেন এসে উনার পাশে বসেন। পাইপ মুখে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত রিল্যাক্সড মুডে খেলা দেখছেন। ব্যাডেন সাহেব ঘামছেন। এও দেখতে হলো বাংলাদেশের কাছে নাকানি চুবানি খাচ্ছে ইংল্যান্ড!

বাংলাদেশ জিতে যাবার পর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরে বাংলাদেশিদের উৎসব চলতে থাকে। ব্যাডেন সাহেব টুক করে গাড়িতে উঠে কেটে গড়েন।

বাংলাদেশ-ভারত খেলা সামনে রেখে বেহেশতে বিরাট অশান্তি শুরু হলো। মোল্লার অনুসারীরা সক্রিয় হয় বাংলাদেশের পক্ষে আর পুরুতের অনুসারীরা সক্রিয় হয় ভারতের পক্ষে ।

উভয়েই জঘন্য ভাষায় একে-অপরের জাত-ধর্ম-বাপ-মা-বৌ তুলে গালি দিয়ে বেহেশতটাকে গোবরডাঙ্গা বানিয়ে ফেলে । এরা হয়তো ক্রিকেট খেলাও বোঝে না; কিন্তু অক্ষমের আশ্রয় উগ্র জাতীয়তাবাদ । তাই কট্টর মুসলমান-হিন্দুগুলো ৪৭ সালের জোশে ফিরে যায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপক্রম হয় বেহেশতে ।

গান্ধীজী অনশনে বসে যান; এরা দাঙ্গা না থামালে উনি জলস্পর্শ করবেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

অবশেষে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচটি হয়। আম্পায়ারের দু-তিনটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ফুঁসে ওঠে বেহেশতের বাংলাদেশিরা । দেবুদাকে বাংলাদেশের বন্ধু ফারহা খান ভাইবারে কল করে বলে, দেবুদা অনেক বড় অন্যায় হয়েছে দেবুদা। জোর করে বাংলাদেশকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। তুমি একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে এর প্রতিবাদ করো । তুমি দেবুদা আসলে মানুষ না; একটা রোবোট। তোমার এই জন্য কোনো বন্ধু নাই; আমি ফারহা খান বলছি, তোমার কোনো বন্ধু নাই। 

দেবুদা বিপদে পড়ে যায়। একটা ক্রিকেট ম্যাচই তো; এ নিয়ে এত উত্তেজিত হবার কী আছে! গভীর চিন্তা করে দেখে তার তো বন্ধু গিজ গিজ করতেছে; আর ফারহা বলে কীনা; কোনো বন্ধু নাই আমার!

এমন সময় ভারতীয় বন্ধু রোদেলা সিং ফোন করে, দেবু ডার্লিং তোমার ফেসবুক স্ট্যাটাস কোথায়! ইন্ডিয়া জিতল অথচ তোমার কোনো সাড়াশব্দ নাই। ব্রুটাস! বিট্রেয়ার সারাক্ষণ ব্যালেন্স করে চলো। লাগবে না তোমার মতো বন্ধু আমার । আইসো স্যাটারডভ নাইটের শিভা লাউঞ্জের ডান্স ফ্লোরে । নাচার সময় আছ; একটা স্ট্যাটাস দেওয়ার সময় নাই।

এত মহাভেজালে পড়া গেল! ফেসবুক খোলার উপায় নাই। শুধু গালিগালাজ । কেউ-কারও চেয়ে কম নয়। বাংলাদেশের বাঁশের কেল্লা আর ভারতের বাঁশের কেল্লা একে অপরকে মালাউন ও যবন বলছে; এবং উভয়েরই গালিগালাজে জীববিজ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য। ৪৭'এর নোয়াখালী আর কলকাতার দাঙ্গার একটা ফেসবুক ডেমোনস্ট্রেশন হয়ে যায়। দেবুদা বোঝে এদের পক্ষে একসঙ্গে থাকা অসম্ভব ছিল। ফলে দ্বিজাতি তত্ত্ব ঠিক আছে। ফেসবুকের বেজাতি তত্ত্ব দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়।

দেবুদা নেতাজী সুভাষ বোসকে ফোন করে, গুরু উপায় বলো না; ক্রিকেট নিয়ে তো মানুষের মন ভাগ হয়ে গেল!

নেতাজী বলেন, কেউ কম নয় বুঝলে । কলকাতার একটা দাদাগিরির স্বভাব আছে; আর ঢাকার একটা পট করে ক্ষেপে গালিগিরি আছে। ধরো কলকাতার প্রসেনজিৎ নীরবে ঝাঁটা দেখায় আর ঢাকার আসিফ চেঁচায়। প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা দুজনের মনেই আছে, অনুকূল পরিবেশে ফুঁড়ে বেরোয়।

দেবুদা বলে, কলকাতার দাদাগিরি তো হিন্দুদের সঙ্গেও দেখেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্য পড়ে আসা জীবনানন্দ দাশ আর বুদ্ধদেব বসুকে তো কলকাতায় মূল্যায়ন করা হয়নি।

সুভাষ বোস বলেন, বগুড়ার গালিগিরির শিকার অবশ্য শান্তি নিকেতন থেকে পড়ে যাওয়া সৈয়দ মুজতবা আলী হয়েছেন। একই ব্যাপার । বাঙ্গালীর মাঝে আসলে নানারকম জটিলতা ।

দেবুদা বলে, ঢাকায় জীবনানন্দ পুরস্কার পাওয়া জনৈক কবি সাইবার বুলিয়াড় এক হিন্দুকে মালাউন বলে গালি দেয়; বিচিত্র; ওরে তোর মালাউনের নামে পুরস্কার নিতে বাধলো না কেন!

সুভাষ বোস বলেন, এসব কলকাতাতেও হয়েছে, স্লেচ্ছ মুছুম্মান, নেড়ে কত আজে বাজে নামে ডেকেছে দাদারা। একই জীন মানচিত্র; নামেই হিন্দু-মুসলমান।

কৰি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এ সময় একটা বিয়ারের ক্যান হাতে এগিয়ে আসেন। দেবুদাকে বলেন, দেখেছো কাণ্ড কারখানা; এই ঢাকার মুসলমান আর কলকাতার হিন্দুরা লেবু কচলে তেতো করে ফেলল। এদের কাদার মধ্যে কাবাডি খেলা উচিত; জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা উচিত; আর ক্রিকেট খেলতে বলেছে কে ভারতীয় উপমহাদেশের চুলকানি

প্রোটোজায়াগুলোকে। ধুতি-্লুঙ্গি কাছা মেরে এদের ডাংগুলি খেলতে নামা উচিত।

হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন

রতনে রতন চেনে; ইয়ে চেনে কচু!

(চলবে)

১৬তম পর্বের লিংক

১৪তম পর্বের লিংক

৯৪ পঠিত ... ১৭:২২, মে ৩০, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top