বেহেশতে খবর রটে যায় গোলাম আজম দোজখে এসেছে। দেবুদার ইচ্ছা হয় প্রাণীটাকে দেখতে যাবে। ফোন করে বেহেশতের এক আধিকারিককে। সে খেঁকিয়ে ওঠে,
: আপনি কী বাচ্চা ছেলে মশাই; এমন বায়না ধরেছেন যেন চিড়িয়াখানা দেখতে যাবেন।
দেবুদা দমে যায়।বেহেশতের কর্মকর্তারা দেবুদার থার্ড ফোর্স মুভমেন্টের জন্য বেশ বিরক্ত। সাম্যবাদী আর কাম্যবাদী দুটো দলতো আছেই; এইখানে জনপ্রিয়তাহীন তৃতীয় শক্তি নিয়ে হাজির হবার দরকার কী!
এর আগে বেহেশতের প্রেসক্লাবে সেমিনার করে ফিটলার কে এনে তাকে নিয়ে দেবুদা যে সিনক্রিয়েট করেছিল; এরপর দেবুদা আর প্রেসক্লাবের বুকিং পায়না।
দেবুদা সাম্যবাদী দলের নেতা গান্ধীজীকে ফোন করে,
: গান্ধীজী কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম দোজখে এসেছে শুনলাম। একটু দেখে আসতে চাই জিনিসটাকে।
গান্ধীজী ব্যস্ত ছিলেন লায়লা আর জুলিয়েটকে অহিংস মতবাদ শেখাতে। পার্বতী এই সেশানে আসার সময় পায়না; ভীষণ ব্যস্ত স্টার জলসার নাটক দেখতে। বেহেশতে আসার পর লায়লা-মজনু; রোমিও-জুলিয়েট;দেবদাস-পার্বতীকে বিয়ে দিয়ে বিরাট ঝামেলায় পড়েছে কতৃপক্ষ। গান্ধীজী সেই ম্যারেজ কাউন্সেলিং করছেন। দেবুদার ফোন পেয়ে গান্ধীজী বুঝতে পারেন দেবুর মাথায় রাজনীতির পোকাটা চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। যার স্ত্রী সারাক্ষণ টিভিসোপ দেখে আর খিল খিল করে হাসে; সে হয় দার্শনিক হবে বা রাজনীতিক হবে এতো জানা কথা।
গান্ধীজী ফোন করে দেবুদার জন্য দোজখের টিকেট জোগাড় করে দেন। সঙ্গে চুনিলালও যাবে। চুনি বেহেশতে ট্যাক্সি চালায়। দেবুদার তাবত একটিভিজমে চুনিদা আছেই।
দেবুদাকে চন্দ্রমুখী ফোন করে, তুমি নাকি দোজখে যাচ্ছো!
: একেবারে যাচ্ছি না; মানব সভ্যতার শত্রু কিছু ঘৃণ্য ঘাতককে দেখতে যাচ্ছি।
: তুমি এসব আজেবাজে লোক দেখতে এতদূর যেতে পারো; আর আমার এপার্টমেন্টে আসার সময় পাওনা।
: রাখি চন্দ্র।
দেবুদার আজকাল পারু-চন্দ্র দুজনের সঙ্গে কথা বললেই কেমন ভয় ভয় লাগে। অনেক দেরীতে হলেও দেবুদা বুঝে গেছে; নারী মূলতঃ টেনশান সেন।
চুনি লাল যথাসময়ে তার ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে পৌঁছে যায়। অনেক দিন পর লং ড্রাইভ। চুনিলালের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে; বেহেশতে সে রুহ আফজা স্পর্শ করতে পারবে না। আজ অনেক দিন পর যেন মুক্তির আনন্দ। দোজখের চেকপোস্ট পার হবার পর চুনিদা লেগে যায় তার হোমিওপ্যাথ পরিসেবায়। দেবুদাও একটু গলা ভিজিয়ে নেয়।
দোজখের একজন সহকারী কমিশনার দেবুদাকে রিসিভ করে। বেশ হাসিখুশী লোক।
: দেবুদা পশুগুলি রেডি।চলেন ভিজিট শুরু করা যাক।
চুনিলাল টলতে টলতে তার হ্যান্ডিক্যাম অন করে।
গোলাম আজমকে একটি বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে হেলান দিয়ে বসে পিয়াস করিম।
দেবুদা বলে, গোলাম সাহেব কেমন লাগছে!
গোলামের চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, এখানে খুব খাওয়ার কষ্টে আছি; দিনগুলি মোর পোলাও খাঁচায় রইলো না।
পিয়াস করিম বলে, এইখানে আমি একটা কাউন্টার হেজিমোনি দিতে চাই; এই পোলাও-ই আমার কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার কারণ।
চুনিলাল জিজ্ঞেস করে,কাউন্টার হেজিমোনি কী দাদা!
পিয়াস বলে, আমাদের পুরোজীবনটা হেজিমোনির বৃত্তে আটকানো। কার্ল মার্কস এই হেজিমোনি চলতে দিতে চেয়েছেন। যেমন আপনি বেহেশতে থাকেন আমি দোজখে এটা প্যারালাল হেজিমোনি। কিন্তু আমাদের একটা ডায়ালগ দরকার তাইতো আপনারা এখানে।
চুনিলালের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরে।
: ও দেবুদা এ যে ইংরেজীতে গালাগাল করছে।
পিয়াস বলে, গালাগাল বলে কিছু নেই; সবটাই ডিসকোর্স।
দেবুদা গোলামকে জিজ্ঞেস করে এই লোক কে!
গোলাম বলে, মার্ক্সিস্ট পিয়াস।
দেবুদার অবাক লাগে। মার্ক্সিস্ট আবার বসে আছে গোলামের সাথে।
দেবুদা কার্ল মার্ক্সকে একটা ফোন দেয়।
: স্যার মার্ক্সিস্ট পিয়াস বলে কাউকে চেনেন!
: কোথাকার সে!
: আজ্ঞে বাংলাদেশ।
: শোন দেবু সূর্যসেন আর প্রীতিলতা ছাড়া আর কাউকে চিনিনা। এ কী তোমার কাছে চাঁদা চাইছে; আমার নামে আজকাল চাঁদাবাজি করে অনেকে; সাবধান।
ওদিকে পিয়াস থেমে নেই,এই যে দোজখ ও বেহেশতের কনসেপ্ট; এটি ইক্যুয়ালিটির মূল সূত্রকে অবজ্ঞা করে। আপনি আমাকে সাব-অল্টার্ণ বলতে পারেন; কিন্তু দাবীর প্রশ্নে আমি ভীষণ একরোখা।
চুনিদা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে,থামুন মশাই; গেলোতো রুহ আফজার মৌতাত কেটে; কীসব কঠিন কথা বলেন!
দেবুদা গোলামকে জিজ্ঞেস করে, আপনার আদর্শ কে!
: ফিটলার এবং মওদুদী।
: একাত্তরের গণহত্যার জন্য অনুতাপ হয়না!
: কিসের অনুতাপ; আমিতো শান্তিপ্রিয় কমিটিতে ছিলাম।
: তাহলে ফিটলার আপনার আদর্শ কেন!
পিয়াস কথা কেড়ে নেয়, ধরে নিন ফিটলার যদি যুদ্ধটা জিতে যেত তাহলে ওয়ার্ল্ড পলিটিক্সে একটা ইকুইলিব্রিয়াম তো আসতো।
দেবুদা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, হলোকস্টে সিক্স মিলিয়ন মানুষ হত্যা কিছু নয় আপনার কাছে।
এমন সময় সহকারি কমিশনারমনে করিয়ে দেন এদের ইলেকট্রিক শক ও লাঞ্চের সময় হয়েছে।
দেবুদা গোলামের ঘর থেকে বেরুতেই একলোক লম্বা সালাম দেয়।
চুনিদা কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, এই কাদেরই সেই কাদের।
দেবুদা জিজ্ঞেস করে,কেমন আছেন!
কাদের বলে, দেবুদা আপনার তো অনেক প্রভাব; আমাকে বেহেশতে একটা ডেপুটেশান জোগাড় করে দেন; না হয় শহীদুল্লাহ কায়সার সাহেবের বাসায় মেঝে ধোওয়া-মোছার কাজ করবো।
দেবুদা বিরক্ত হয়।
: দেখুন তদবির করবেন না;আর যুদ্ধাপরাধীদের বেহেশতে ডেপুটেশানের নিয়ম নেই।
কাদের চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে যায়; জলন্ত কয়লায় ওপরে হাঁটার সেশানে।
দেবুদা অবাক হয়, এইলোক গুলোর কোন অনুতাপ নেই ৩ মিলিয়ন মানুষ খুন করে। কী পিশাচ এরা।
ঘরের মধ্যে থেকে পিয়াস বলে, আমাকে কিছু বললেন!
সহকারী কমিশনার আঙ্গুল নির্দেশ করেন, ঐ যে দেখুন মওদুদী তাকে ফাঁটা বাঁশের চিপায় নাচানো হচ্ছে।
: এ তো আদিবাসী নৃত্য।
: নাচতে জানলে আদিবাসী নৃত্য; না জানলে কষ্টের ব্যাপার।
ফিটলারকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে উলটো করে। মাথার কাছে বার বি কিউ চুলো।
সহকারী কমিশনার জানায়,ধাপে ধাপে গোলামকেও এসব পানিশমেন্ট দেয়া হবে।
চুনিদা জিজ্ঞেস করে, ঐ জটিল করে কথা বলা লোকটার কী করবেন!
: ওর জন্য জিলাপী গ্রাউন্ড তৈরী করা হচ্ছে; মোটা শরীর নিয়ে জিলাপীর প্যাঁচে প্যাঁচে এক্সট্রা ড্রিল করালেই ঠিক হয়ে যাবে।
দেবুদা সহকারী কমিশনারকে ধন্যবাদ দেয় দোজখে ট্যুর করানোর জন্য। জিজ্ঞেস করে,
: এরা কী খায়!
: সেদ্ধ করলা, কাঁকর অলা ভাত, ঠান্ডা নানরুটি, আধা সিদ্ধ কচু ইত্যাদি।
: বাহ বেশ হেলদি ফুড।
সহকারী কমিশনার রসিকতা করে, খাবেন নাকি!
: না থাক।
বারান্দায় বেরিয়ে পিয়াস দেবুদাকে বলে; দুটো ভিন্ন থট প্রসেসের মাঝে ডায়ালগের আয়োজন করুন। কারণ বেহেশত-দোজখের মধ্যে ইন্টেলেকচুয়াল এক্সচেঞ্জ জরুরী।
চুনিদা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,আপনার একটা কথারও মানে বুঝি না। আপনি কোন ভাষায় কথা বলেন?
: একাডেমিশিয়ানের ভাষায়; অনেকগুলো স্কুল অফ থটকে একসঙ্গে নিয়ে চলি। পোস্ট মডার্ন অ্যাপ্রোচে দেখি কনফ্লিক্ট পয়েন্টগুলো।
দেবুদা সহকারী কমিশনারের কাছে জিজ্ঞেস করে, আপনার কাছে কি মাথাব্যথার কোনো ওষুধ আছে?
পিয়াস এগিয়ে দেয়, আমি পকেটেই রাখি; কারণ আমার সঙ্গে কথা বলার পর সবাই মাথাব্যথার ওষুধ চায়।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন