ধারাবাহিক উপন্যাস
প্যাসেজ টু হেভেন (পর্ব-৭)
পৃথিবীতে বড় ধরণের মানবিক বিপর্যয়ে বেহেশতে এলার্ম বাজে। আজকাল খুব ঘনঘন এলার্ম বাজছে। বড় ঘটনার বড় এলার্ম; ছোট ঘটনায় ছোট এলার্ম। গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলী গণহত্যা-ইরাক আর সিরিয়ায় আইএস-এর হত্যাযজ্ঞে বড় বড় এলার্ম বেজেছে। বেহেশতে সবাই চিন্তিত। পৃথিবী কী তবে নিমজ্জনের মুখে! দেবুদা বুঝতে পারেনা কী করণীয়। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে কাজ হচ্ছেনা। মানুষ হত্যা থেমে নেই; অমানুষেরাই বেশী সংঘবদ্ধ।
দেবুদা কবিগুরুকে ফোন করে, গুরু উপায় কী!
: দেবু চলে এসো আজ একটা অন্যধরণের প্রবলেমে আছি।
দেবুদা বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চরম অশান্তি কাটাতে শান্তি নিকেতনে যাওয়া শ্রেয়। কবিগুরুর সঙ্গটাই বা কম কীসে।
পথে সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে দেখা।
কোথায় চললেন সৈয়দ সাহেব?
: শান্তি নিকেতনে। গুরু ডেকেছেন।
আমিও যাচ্ছি; উঠুন মশাই সাইকেলে।
: হেঁটে যাওয়াই ভালো; রসগোল্লার হাঁড়ি ভেঙ্গে গেলে সর্বনাশ, গুরুর জন্য নিয়ে যাচ্ছি।
দেবুদা সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে থাকে মুজতবা আলীর সঙ্গে।
সৈয়দ সাহেব মিডল ইস্টের পরিস্থিতি তো ভয়াবহ।
: আমি ভায়া আদার ব্যাপারী; জাহাজের খবর রাখিনা। এসব নেভার এন্ডিং প্রবলেম।
তাই বলে আমরা কী কিছুই করতে পারিনা!
: আমরা আলোচনা করে নিজেদের সময় নষ্ট করতে পারি।
আলোচনাকে আপনি সময় নষ্ট বলছেন!
: অবশ্যই আমরা হলেম ঝগড়া-সমাজ; আলোচনা করার ম্যাচিউরিটি আমাদের নেই।
তা ঠিক; যুদ্ধ হচ্ছে আরব দুনিয়ায়; আর উত্তেজিত গোবর ডাঙ্গার লোকজন তা নিয়ে ঝগড়া-লাঠালাঠি করছে।
: সেইটেই বলছিলাম; সোজা হিসাব, পৃথিবীর যেসব এলাকায় শিক্ষা-দীক্ষা বিস্তার হয়নি সেখানেই হানাহানি।
আমাদের কী কিছুই করার নেই!
: দুঃখ প্রকাশ করতে পারি; প্রতিবাদ জানাতে পারি। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে পারি।
কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে আজ অনেকেই এসেছেন। সবাই বেশ উতকন্ঠা নিয়ে বসে। মৃদু হাসি মুখে বসে সত্যজিত রায়। যথারীতি ফেসবুকিং করছেন। মুজতবা আলী উনার পাশেই বসেন। ব্রজদার হাতে রসগোল্লার হাঁড়িটি ধরিয়ে দেন।
ব্রজদা খুশী হয়ে বলেন, আজকাল সবাই শুধু কেক-পেস্ট্রি নিয়ে আসে। আপনিই ‘রসগোল্লা’ নিয়ে আসেন কেবল!
সত্যজিত রায় বলেন, আমাকে দিও ব্রজদা।
কবিগুরু আসেন। মনটা ভারাক্রান্ত। হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন,
এই কপিরাইট আইনটাই ভুল বুঝলে মৃত্যুর পরেও শিল্পীর শিল্পের উপর একটা কপিরাইট থাকা উচিত।
মুজতবা আলী বলেন, কী হয়েছে গুরু!
কবিগুরু সত্যজিত রায়কে দেখিয়ে বলেন, মানিকই খবর দিলো; আমার গানের উপর কপিরাইট না থাকায় যা-তা হচ্ছে।
মুজতবা আলী বলেন, লোকজন নিজেরা নতুন কিছু করলেই পারে; অন্যের শিল্পের ভিটেতে গরু না চরিয়ে।
সত্যজিত রায় হো হো করে হেসে ওঠেন।
কবিগুরু গম্ভীর হয়ে যান।
মুজতবা আলী সত্যজিত রায়কে জিজ্ঞেস করেন কী ব্যাপার!
সত্যজিত রায় তার মোবাইল ফোনে একটা মিউজিক ভিডিও দেখান। দেবুদাও দেখেন। গানের মাঝামাঝি গিয়ে দুজনেই অজ্ঞান হয়ে যান। সবাই ধরাধরি করে সোফায় শুইয়ে দেন দু’জনকে। পানির ঝাপটা দিলে জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে নির্বাক হয়ে বসে থাকেন দুজন।
ব্রজদা রসগোল্লা পরিবেশন করেন। দেবুদা রসগোল্লা মুখে দিয়ে বলেন, গানটা দেখার পর রসগোল্লাও যেন তেতো লাগছে।
কবিগুরু হেলান চেয়ারে বসে। তার বিপি হাই হয়ে গেছে। ব্লাড প্রেশার কমাতে ওষুধ খেয়েছেন একটু আগে।
সত্যজিত রায় একটু বোঝাতে চেষ্টা করেন, শেক্সপীয়ারের নাটক নিয়েও যা-তা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে।
মুজতবা আলী বলেন, তা হয়েছে; কিন্তু এমন এক্সপেরিমেন্ট দেখিনি এর আগে।
দেবুদা বেশ বিক্ষুব্ধ, কিন্তু একে থামাবে কে!
সত্যজিত রায় বলেন, সুকুমার রায় থেকে জীবনানন্দ কেউ-ই রক্ষা পায়নি এই সব্বনেশে সংগীত শিল্পীর হাত থেকে। ভয়ে আছি, হীরক রাজার দেশের গানগুলোর দিকে নজর না পড়ে যেন এর।
কবিগুরুর মোবাইল ফোন ঘন ঘন বাজছে। যে-ই সব্বনেশে গান শুনছে; ফোন করছে। এখন উনি ফোন ধরাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
হঠাৎ পার্বতীর ফোন, হ্যালো দেবুদা ইউটিউবে একটা গান দেখলাম; হাহাহা
গান দেখেছ বেশ কথা এতো হাহা করার কী আছে!
ইন কেটে দিয়ে দেবুদা বলে, আজকাল যে কোন উদ্ভট কাজ করে বিখ্যাত হবার বাতিক হয়েছে।
মুজতবা বলেন, ও সব যুগেই ছিল; এখন মাধ্যম বদলেছে।
হঠাৎ দেখা যায় বেহেশতের পুলিশেরা একজনকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসেছে। পুলিশ অফিসার বলেন, কবিগুরু একে ঘুমের মধ্যে তুলে নিয়ে এসেছি, ভোর হবার আগেই পৃথিবীতে রেখে আসতে হবে। কারণ যমরাজ বলছেন, এ একশো বছর বাঁচবে প্রায়।
প্রায় সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, এই সেরেছে।
লোকটি দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসে। মুজতবা আলী জিজ্ঞেস করেন,
তোমার নাম কী হে বাপু।
আজ্ঞে রোদ্দুর রায়।
সবাই একযোগে সত্যজিত রায়ের দিকে তাকায়।
সত্যজিত রায় খানিকটা বিব্রত হয়ে বলেন, না না এ আমার ফ্যামিলির কেউ নয়।
রোদ্দুর রায় হাসি মুখ দাঁড়িয়ে। সে বুঝতে পারেনা; এটা সত্যিই ঘটছে; নাকি ড্রিম। পুলিশকে বলে, দাদা একটু চিমটি কাটবেন কী!
পুলিশ অবাক এরকম উদ্ভট প্রস্তাব কোন আসামী কখনো দেয়নি।
মুজতবা আলী বলেন, কেন নিজে নিজেকে চিমটি কাটতে পারেন না!
দেবুদা রেগে গিয়ে বলে, ও শুধু অন্যের শিল্পে চিমটি কাটতে পারে।
কবিগুরু বলেন, বাবা তোমার সমস্যা কী; হঠাৎ আমার পিছে লাগলে কেন!
রোদ্দুর কেঁদে ফেলে; সে অনেক কষ্টের কথা গুরুদেব।
সত্যজিত রায় বলেন, কী কষ্ট তোমার!
রোদ্দুর জবাব দেয়, তৃথা বলে এক মেয়েকে ভালোবেসে গান শিখিয়ে ছিলুম।
মুজতবা আলী বলেন, দেবুদা এতো আপনার পেশেন্ট। মন দিয়ে শুনুন। প্রেসক্রিপশান আপনাকেই দিতে হবে।
কবিগুরু বলেন, তো ভালোবেসেছিলে ভালকথা, সে কী তোমাকে ছেড়ে চলে গ্যাছে!
সত্যজিত গম্ভীরভাবে বলেন, সেইম ওল্ড কেস।
রোদ্দুর বলে, কক্ষণো না; এ ভালবাসা সে ভালোবাসা নয়।
দেবুদা বলেন, ভালবাসা আবার কয় প্রকার, তুমি প্রেম বিষয়ে জ্ঞান দেবে নাকি!
রোদ্দুর মন খারাপ করে বলে, শুনতে না চাইলে না বলি।
কবিগুরু সবাইকে থামান; বলো কী ব্যাপার!
রোদ্দুর কেঁদে ফেলে। পুলিশ টিস্যু এগিয়ে দেয়।
আমার লেখা ও সুর করা গান নিয়ে তৃথা প্যারিসে পালিয়ে যায়।
মুজতবা আলী টিপ্পনী কাটেন, ওরে বাবা এ যে দেখি ভিঞ্চি কোড।
দেবুদা উতসুক, তারপর!
প্যারিসের লোক তার কনসার্ট লুফে নেয়। রোদ্দুর গর্বিত ভঙ্গীতে বলে, আমার লেখা সুর করা "পাগলী" গানটি গেয়ে সে প্যারিস মাতায়।
মুজতবা বলেন, সেতো মাতাবেই; ওরা তো আর বাংলা বোঝেনা।
সত্যজিত যোগ করেন, তো সেই তৃথার গানটা দেখাও।
রোদ্দুর ইউটিউবে সার্চ করে সেটা বের করে। সে গান দেখে সত্যজিতেরও খানিকটা ফিভারিশ লাগে। উনি চিৎকার করে বলেন, এসব হচ্ছেটা কী!
মুজতবা আলী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন।
দেবুদা বলেন, তো তৃথা দেখি তোমার চেয়ে এক কাঠি সরেস।
কবিগুরু বলেন, তো বাপু তৃথার প্রতিশোধ আমার উপরে নিলে কেন!
রোদ্দুর অবাক হয়। সে মনে করে সে বিরাট এক্সপেরিমেন্ট করছে সংগীত নিয়ে।
গুরুদেব, কম্পিটিশানে টিকে থাকতে ধ্রুপদী বাণীপ্রধান গানের কোন বিকল্প ছিলোনা। আপনার গান গাওয়ার পর রেটিং-এ আমি তৃথার চেয়ে এগিয়ে।
মুজতবা আলী হাসেন। ভাগ্যিস গান লিখিনি। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।
সত্যজিত রায় বলেন, কে জানে আপনার ‘শবনম উপন্যাসের বারোটা কে কবে বাজিয়ে দেয়; রোদ্দুর তো একাই নয়; এরকম বহু প্রতিভা লুকিয়ে আছে।
রোদ্দুর খুব খুশী হয়। সে উচ্ছসিত হয়ে বলে, কেউ যদি শবনম নিয়ে ফিল্ম বানায়; আমি গানগুলো গেয়ে দেবো।
মুজতবা আলীর কান-মাথা গরম হয়ে ওঠে।
পুলিশ ওয়াকি টকিতে কথা বলে, তারপর কবিগুরুকে জানায় রোদ্দুর রায়ের ওপর সংক্ষুব্ধ ছড়াকার-কবিরা সদলবলে শান্তি নিকেতনে আসছে; একে এক্ষুণি মর্ত্যে ফিরিয়ে দিয়ে আসা জরুরী।
জীবন বিপন্ন, তবু রোদ্দুর কবি গুরুকে অনুরোধ করে, স্যার আপনি যদি কিছু মনে না করেন আপনার সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে চাই।
কবিগুরু অবাক, ও আবার কী!
সত্যজিত রায় বলে, নার্সিসিজমের নতুন প্রতিশব্দ। সে এখন একটা ছবি তুলতে চায় আপনার সঙ্গে।
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে প্রস্তুত রোদ্দুর রায়।
কবিগুরু বলেন, তোমাকে কোন কিছু নিষেধ করে তো লাভ নেই। সেলফি তুলে মানে মানে কেটে পড়ো বাপু।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন