দেবদাসকে সেই শেষ দেখেছি পার্বতীর বাড়ির গেটের কাছে মরে পড়ে থাকতে। কী যে ছিল এই পারুর মাঝে! দেবদাস যে কী পেয়েছিল তা আমার মাথায় ঢোকে না। আরে বাবা যেখানে চন্দ্রমুখী আছে; তার ঔদার্য আছে; বুকের গহীনে দেবুদার জন্য ভালবাসা আছে; সেই খানে এই এক পার্বতী, যে দেবদাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এক বড়লোক জমিদারকে বিয়ে করলো; যার নাম পার্বতী তার বিয়ে হবে মোহরের পর্বতের সঙ্গে এ আর বিচিত্র কী! পারু অন্তত একবার যদি বলতো সে সুইসাইড করবে তবু বুঝতাম; একটু ফস ফস করে কেঁদে প্রেমের গভীরতা কী বোঝানো যায়!
অন্যদিকে কিছুই চায়নি চন্দ্রমুখী; চাঁদের আবার চাওয়ার কী আছে!
দেবুদার মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তা বেহেশতে একটি ‘দেবদাস কোটা’চালু করেন হিন্দুদের জন্য। মুসলমানদের জন্য মজনু কোটা; খ্রিস্টানদের জন্য রোমিও কোটা আগেই ছিল। ফলে দেবদাস বেহেশতে ঐ পার্বতীর টাকার পাহাড় হাবির চেয়ে বড় বাড়ি-গাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স পেয়ে যায়। আর সেই দেব প্রাসাদের সামনে রামজলের রঙ্গিন ফোয়ারা।
দেবুদা তখন সাসপেন্ডের ওপরে। সেন্টার ফর পারু ডার্লিং (সিপিডি)র সিনিয়র ফেলো হয়। বেহেশতে একটি তৃতীয় শক্তি তৈরীর চেষ্টা করে। বেহেশতের প্রধান শক্তি সাম্যবাদী দল, বিরোধীদল কাম্যবাদী দল। সাম্যবাদী দলে চে গুয়েভারা, গান্ধীজী, মার্টিন লুথার কিং, বঙ্গবন্ধু এরা আছেন। কাম্যবাদী দলে নেহেরু, জিন্নাহ, আনোয়ার সাদাত, জিয়াউর রহমান এরা। দেবুদা সেখানে তৃতীয় শক্তি তৈরী করতে উঠে পড়ে লাগেন। নোবেল বিজয়ী মাদাম কুরী-জুলিওকুরী থেকে শুরু করে প্রফেসর সালাম, পরমাণু বিজ্ঞানী সুধা ওয়াজেদ সবাই আছেন। এই দলের নাম তৃতীয় চুমুক। দেবুদার দল যেহেতু।
এর মাঝে ধরাধাম ত্যাগ করে বেহেশতে আসে পার্বতী। দেবুদাকে বেহেশতের এক আধিকারিক জানায়; আপনার বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে। দেবুদার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। মস্কোর আনা কারেনিনার সঙ্গে তার মন দেয়া নেয়া চলছে; আনা থার্ড ফোর্সের অনেক ইভেন্ট ম্যানেজ করে। পার্বতী তো এসব কিছুই পারে না।
বেহেশতের একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার দেবদাসকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পার্বতীর সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেয়া হয় দেবুদাকে। আনা দেবুদাকে ফোন করে বলে, ইউ বেঙ্গলি লায়ার; আই হেট ইউ।
শুরু হয় দেবুদা আর পার্বতীর সংসার। বেহেশতে গৃহকর্মী দেয়া হয় শুধু যারা হুর প্রত্যাশী তাদের। ৭০ জন হুর বাড়ির সব কাজ করে দিলে বেহেশত বাসী মোল্লা-পুরুতেরা খুব আরামে থাকে খায় ঘুমায় মর্ণিং ওয়াক করে হুরদের নিয়ে। সে এক রঙ্গিন জীবন। এরা পৃথিবীতে চার বিবি বা আশ্রমের চার গোপিনী নিয়ে হেভেনে থাকে। বেহেশতে এসে ৭০ জন জীবন উতসবসঙ্গী। কপাল তাদের!
কিন্তু দেবদাস এসেছে প্রেমিক কোটায়। সে জন্য পার্বতী এসে হাজির হবার আগে পর্যন্ত বেহেশত বাসিনীর সঙ্গে একটু প্রেম করার অনুমতি ছিল। সেই সূত্রে মস্কোর মেয়ে আনাই রেঁধে বেড়ে খাওয়াতো। দেবদাসের অনুরোধে আনাকে ভাত, ডাল, থানকুনি পাতার ঝোল, ইলিশ ভাজা এসব রেসিপি শিখতে হয়েছে। এখন আনা নাই। দেবদাস ভোরবেলায় উঠে থার্ড ফোর্সের মিটিং-এ যাবার আগে পাউরুটি-কলা খেয়ে যায়। পারু নাক ডেকে ঘুমায়। সাবেক জমিদারের বউ। সে রান্নাঘরে যায় কী করে।
বেহেশতের প্রেসক্লাবে সাম্যবাদী ও কাম্যবাদী উভয়ের বিরুদ্ধে কিছু গরম বক্তৃতা দিয়ে বাড়ী ফেরে দেবু। পারু তখন বসে টিভি সিরিয়াল দেখছে। ধমক দিয়ে বলে, এতো দেরী হলো যে; যাও আমার জন্য একটু ভাত রান্না করো; ডিম ভাজি করো, ফ্রিজে ডাল আছে ঐটা গরম করে দিও। সেমিনারে পাওয়া বিরিয়ানীর প্যাকেটটা পারুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেবুদা খুব মন খারাপ নিয়ে ব্যালকনীতে বসে চিপস খায়, সঙ্গে একটু পুরনো আঙ্গুরের রস। হঠাত সামনের ব্যালকনীতে দেখে চন্দ্রমুখী দাঁড়িয়ে। সে হাত নাড়ে। দেবুর কান্না পায়। আহারে চাঁদ পানা মুখখানা। পারু বিরিয়ানী খেয়ে সোফায় কাত হয়েছে। ধমক দিয়ে ডাকে, দেবু এইদিকে আসো পা টিপে দাও। ভদ্রলোকেরা বউদের পা টিপে দেয়। কিছু শেখো। গবেট কোথাকার। দেবুদা একটা টুলে বসে পারুর পা টেপে। মেয়েটা আনন্দে শিশুদের মতো ঘুমিয়ে যায়।
দেবু টুক করে বেরিয়ে যায়। চন্দ্রমুখীর এপার্টমেন্টে বেল বাজায়। চন্দ্র দরজা খোলে। হঠাত যেন জ্যোতস্না নেমে আসে। চন্দ্র হাত ধরে দেবুকে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসতে দেয়। দৌড় ঝাঁপ করে লুচি-ভাজি-সন্দেশ-রসগোল্লা খেতে দেয়। চন্দ্র চেয়ে থেকে দেবুর খাওয়া দেখে। চন্দ্র একটু কাগজী লেবুর সরবত দেয়। বেশী আঙ্গুরের জুস খাওয়া শরীরের জন্য ভালনা; তুমি ওগল্যা খায়োনা দেবুদা বলে। চন্দ্র দেবুর কপালে হাত রাখে। চুলের মধ্যে ফালি ফালি নরম আঙ্গুলে বিলি কেটে দেয়। দেবুদা ঘুমিয়ে যায়। চন্দ্রমুখী বেহেশতে আসার পর তার একটাই চাওয়া ছিলো, দেবুদার বাড়ীর উল্টোদিকে একটা ছোট্ট এপার্টমেন্ট। সৃষ্টিকর্তা বেহেশতে নারীদের জন্য কোন হুর রাখেন নি। কারণ এরা সবাই প্রেমের কোটায় আসা। আর নারীদের ওসব বাজে আগ্রহ নাই। ফলে তারাই এই ঝামেলা বাদ দিয়েছে।জগতের জেলহাজতে সারাজীবন সংসারের ঘানি টেনে আসার পর কে চায় বেহেশতের নতুন জিগলোর পাল্লায় পড়তে।
তবে প্রেমের অনুমতি আছে এখানে। জীবনানন্দ দাশ, আবুল হাসান এসব কোমল কবি যাদের জীবদ্দশায় মেয়েরা কষ্ট দিয়েছে, তাদের সঙ্গে প্রেমে বাধা নেই হেভেনে। কিন্তু চন্দ্রমুখী জীবনে লুজার দেবদাসকে এতোই ভাল বেসে ফেলেছে যে আর কাউকে ভালো লাগে না তার। চন্দ্রের মত মেয়েরা খুব রোমান্টিক হয়। এরা সারাজীবন হয়তো কিছুই নাহি পাবো; তবুও তোমায় আমি দূর থেকে ভালোবেসে যাবো গেয়ে কাটায়।
মোবাইল ফোনের তীব্র আওয়াজে দেবুদার ঘুমভাঙ্গে। আর কে পার্বতী! ‘দেবু আসার সময় একটা পিটজা নিয়ে এসো। প্রতিদিন দেশী ফুড ভালো লাগে না।’
দেবুদা অনেক দুঃখ চেপে কান্না লুকিয়ে বলে, চন্দ্র এবার তবে যাই। চন্দ্র দেবুদার গালে একটা সুগন্ধী লেবু বাগানের চুমু দিয়ে বলে, যাই না আসি বলতে হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন