শয়েলের এক কামড় বার্গার!

১৭৭৪ পঠিত ... ১০:৪৮, জুন ২৫, ২০১৭

ছবি: জন ম্যুলার হ্যানসেন

কাঁচের মধ্যে মুখ চেপে ধরলে বোঝা যায় মানুষের নিশ্বাস গরম, আর মুখে গন্ধ।

সোহেল, যে নিজের নাম বলে 'শয়েল' এই বিষয়টা টের পায় ৫ বছর বয়সে। 

শয়েল ওরফে সোহেল কাঁচের দেয়ালে মুখ লাগায়ে মানুষের খাওয়া দেখে। এই শহরে খিদা আর খাবার, কাঁচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। ডাচ বাংলা এটিম বুথ এর পাশে ফুটপাথে ছালার বস্তার সংসারে সোহেল থাকে আরো দুই পথশিশুর সাথে। তাদের একজন রতন, আরেক জন মিন্টু। তারা ভাংগারী টোকায়। সোহেলও টোকাই তবে সারাদিন ঘুরে ভাংগারী খুঁজে খুঁজে তারপর বিক্রী করে সেই টাকায় খাবার কিনে খাওয়া তার হয় না। মোটে বয়স ১০।

সোহেল বেইলী রোডে ঘুরে বেড়ানো বাচ্চা ভিক্ষুকদের একজন। রাস্তার দুই পাশ ধরে সার বাধা খাবারের দোকানে টেবিলে টেবিলে খাবারে-পানীয়ে তাদের চোখ, তৃষ্ণা, ক্ষুধা আটকানো। ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে সোহেলের কানের সামনে পীছে ঘামের ধারা গড়ায়ে গলার দিকে যায়। এই কড়া রোদের দুপুর গুলা খুব কষ্টের হয়, মাগনা ছায়া দেয়ার মত জায়গা এই শহরে খুব কম। ছায়া ছায়া জায়গাগুলায় ড্রাইভাররা গাড়ি পার্ক করে দরজা খুলে ঘুমায়। সোহেলের মতন পথের বাচ্চারা গাড়ির আশে পাশে গেলে তারা খ্যাক করে গালি দিয়ে মারতে আসে, তাই তপ্ত রোদের পথটুকুই সোহেলদের ভাগে পড়ে। সেই রোদে বসে, বা হেঁটে ছুটে না খাওয়া পেটের আগুন আর রোদের আগুন মিলে সোহেলকে পোড়ায়। মাঝে মাঝে কুই কুই করে নিজেই কাঁদে।

কাঁচের দেয়ালের বাইরে সকাল থেকে না খাওয়া পেটে, কেমন জানি পাক খাওয়া একটা শুন্যতা নিয়ে মুখ চেপে সোহেল আর তার মত বাচ্চা ভিক্ষুকরা দেখে কোনো টেবিলে হয়ত গরম, রসালো বার্গার আসে, ফুলা ফুলা গোল বন রুটিটা দেখেই বোঝা যায় নরম তুলতুলা, মাঝ খান থেকে উকি মারে মাংসের চপ, শসা, লেটুস, আর মাখন না ননী কি জানি (আসলে ক্র্যাফট চীজের স্লাইস, সোহেলরা এর নামও জানে না)! কড়া লাল লিপস্টিক লাগানো ঠোট হা হয়, ঝকঝকা সাদা দাঁত কেটে বসে বার্গারের রুটির কিনারায়, চোয়াল বন্ধ হয়, চিবায়। আর কাঁচের দেয়ালের এপারে নাকমুখ লেপ্টে দাঁড়ানো সোহেল ঢক করে খালি মুখের লালাটুকু ঢোক গিলে। ক্ষুদার্ত চোখে দেখা সেই বার্গারের অস্পৃশ্য স্বাদ তার মুখে পানির বান ডাকে। কাঁচের দেয়াল সোহেল আর খাবার কে আলাদা করে রাখলেও, সোহেল সেই খাবার কে মনে মনে ভোগ করার চেষ্টা করে। তাতে লাভ কিছু হয় না। ক্ষিধাটা আরো চাগা দিয়ে উঠে।

কাঁচঘেরা খাবারের দোকান সোহেলের একটা মোহতীর্থ। সে জানে এর ভেতরে সে কখনো ঢুকতে পারবে না। কিন্তু এর আকষর্ণ সে এড়াতেও পারেনা। ঘুরে ফিরেও এই খাবারের ঘরের পাশেই। যারা ঢোকে, যারা বেরোয় তাদের দিকে হাত পাতে। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। কেউ দুর দুর করে, কেউ হয়ত কালে ভদ্রে মায়া করে কথা বলে, 'তুমি' করে বলে। সোহেলের ভাল্লাগে। খুব জড়ায়ে ধরতেও মন চায়। আজকেও এক নীল জামা পরা ভাল আপু সেই কাঁচ ঘেরা খাবারের স্বর্গ থেকে বের হয়ে হাতের ছোট কাগজের বাক্স আর বরফকুচি দেয়া কি জানি একটা জুস সোহেলের হাতে ধরায়ে দেয়।

ফুটপাতে বসেই সোহেল বাক্স খুলে দেখে মাত্র দুই কামড় দেয়া একটা বার্গার আর কিছু ফ্রেঞ্চফ্রাই তার ভেতর। সোহেল এই খাবারের নামও জানেনা, তবে খাবলা দিয়ে গোগ্রাসে মুখে ভরে তার কি যে ভাল্লাগে...একটু খাবার চাবায়, একটু জুস খায় স্ট্র দিয়ে...আহারে এত মজা কেন...

মাথার পিছে চাটিটা খেয়ে সোহেলের মুখে স্ট্র ঢুকে যায় গলা পর্যন্ত। মোটাসোটা এক লোক দেখেই বোঝা যায় ভাল খেতে পায়, সোহেলের মাথায় চাঁটি মেরে বলে--

: ঐ ছ্যারা, রোজার দিনে রাস্তায় বইসা খাস ক্যারে? জানোস না মাইনসে রোজা রাখে, পানি খাইতে দেখলে রোজদারের খারাপ লাগে না? উট এহান তে, চিপাত যা। চিপাত গিয়া খা।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়ে থাকে সোহেল, খেতেও ভুলে যায়। সারাবছর খালি পেটে মানুষের খাওয়া দেখতে কি যে কষ্ট লাগে এটা সোহেলের চেয়ে কে ভাল জানে। সোহেলের হঠাৎ মনে হয়, এই লোকটা তার মত ভিক্ষুক হয়ে গেছে, তার হাতের বার্গার দেখে এই লোকের খালি পেট মানতে চাইতেসে না।

অনাহারীর সামনে খাবার যে কী জিনিস এটার উপলব্ধি থেকে সোহেলের খুব ইচ্ছা করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে--

: বেশি খিদা লাগসে? খাইবেন ভাই আমাত্তে এক কামড়?

১৭৭৪ পঠিত ... ১০:৪৮, জুন ২৫, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top