নওয়াবজান কালো বোরখা পরে মুখমণ্ডলের স্বচ্ছতোয়া পর্দা তুলে জিজ্ঞেস করে, এখানে কী গালিবের কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যাবে!
পুস্তকালয়ের মালিক উত্তর দেন, কাব্যগ্রন্থ তো এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে এখানে এসে বই পড়ার ফাঁকে কোন গজল লিখে গেলে; আমি তা যত্ন করে গুছিয়ে রেখে দিই।
–গালিব এখানে আসেন!
–আসবেন না কেন! এ যে জনান্তিকে তার প্রাণের বইঘর। সংসারের কারাগার থেকে যে কয়েকঘন্টা কবিতার সঙ্গে তার অভিসারের সময় মেলে; তার বেশ কিছুটা সময়; কবিতার সঙ্গে একটু একান্তে কাটাতে; এইতার প্রেমনগরী যে!
–আমাকে উনার হাতে লেখা গজলগুলো একটু দেখতে দেবেন জনাব!
–নিশ্চয়ই এই দেখুন। কাব্যের তখতে বসে আরাম করে পড়ুন।
নওয়াবজান একটা একটা করে অক্ষর-শব্দ-বাক্য পড়তে থাকে; তার সরু আঙ্গুলের ফালি গালিবের চিন্তা-অবয়বে ভালোবাসার বিলি কেটে দিতে দিতে যেন। তাকে নওজানজান চোখে দেখেনি; তার অনেক গল্প শুনেছে।
গালিবকে আরেকটু কাছে পেতে; আকাশের নক্সী চাঁদোয়ার নীচে ঝুলবারান্দার জেসমিন বাগানে বসে; গালিবকে পড়তে পড়তে; মধ্যরাত এসে গেলে; আলপনা আঁকা মেঝেতে সটান বসে, রেশমি আসনে আধশোয়া গালিবের দিকে খুশীজলের সঙ্গে গোলাপপানি মিশিয়ে; পানপাত্রের ওপরে জেসমিনের রেণু ছড়িয়ে দিয়ে তাতে; অদম্য আকুতিতে গাইতে ইচ্ছা করে, প্রিয় এমনো রাত যেন যায় না বৃথাই।
–জনাব আমি কী একরাতের জন্য গালিবের এই পদাবলীকে আমার ঘরে নিয়ে যেতে পারি। আমি সারারাত ধরে টুকে রাখতে চাই দুনিয়ার সেরা প্রেমের মহাকাব্য। আমি তাতে সুরের ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চাই; যেন সবাই আমার সঙ্গীতের অশ্বমেধযজ্ঞে সম্রাট গালিবের কাব্য সাম্রাজ্যের সুখী প্রজা হতে পারে!
–গোস্তাকি মাফ করবেন, কবিকে জিজ্ঞেস না করে তার আমানত অন্য কাউকে দিলে; আমার ঈমান নিমজ্জিত হবে বিশ্বাস ভাঙ্গার আত্মশ্লাঘায়।
এমন সময় গালিব প্রবেশ করেন তার কবিতার অভিসার গৃহে। ফুরফুরে মেজাজ তার। গৃহের কারাগার থেকে এই যে কয়েকঘন্টার মুক্তি; তাকে উদযাপনের রোমাঞ্চ তার চোখে মুখে।পুস্তকালয়ের মালিক বলেন, এই যে বলতে বলতেই এসে পড়েছেন আমাদের কাব্য সাম্রাজ্যের সম্রাট! তাঁর কাছ থেকেই অনুমতি নিয়ে নিন; সুরের সেনাপতি।
নওয়াবজানের পায়ের নীচের ভূভাগ যেন সরে যেতে থাকে; বসে থাকার আসনটি যেন ডিঙ্গি নৌকার মতো দুলে ওঠে গালিবের বজরার ঢেউয়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমি চাই আপনি হবেন ইতিহাসের সেরা কবি। এই ইতিহাসটা আপনি লিখবেন। আপনার প্রকাশক যেমন; আপনার কাব্য সাম্রাজ্য বিস্তারের সেনাপতি; আমিও তেমনি আরেকজন; আপনার আয়াত সুর করে; আমার সুর বাদ্য যন্ত্রীদলের কুচকাওয়াজের অনুশীলন শেষে, আমি লক্ষ্ণৌ এলাহাবাদ বানারস হয়ে পাটনা আর কলকাতায় পৌঁছে দিতে চাই আপনার সাম্রাজ্য বিস্তারে। হুকুম করুন জাঁহাপনা।
–ইচ্ছে তো আমারো করে নওয়াবজান, যার গান শুনতে তাবড় নবাবদের হাতজোড় করে অপেক্ষা করতে হয়; যাকে ছুঁতে গেলে ছোয়া যায়না; ধরতে গেলে ধরা যায়না। অথচ যার সুরের জাদুতে নবাবদের সংসার পুড়ে খাঁক হয়ে যায়। আমার কী ইচ্ছে করে না সেই আগুন পাখীর ডানায় কাব্যভ্রমণে যেতে। কিন্তু কী করবো; আটকে আছি গৃহস্থালীর কারাগারে। আচ্ছা বলুন তো নওয়াবজান, বাউল কী কখনো গৃহস্থ হয়!
পুস্তকালয়ের মালিক লাচ্ছি পরিবেশন করেন; তাতে পেশতা বাদাম আর কিশমিশের ডুব সাঁতার চলছে। গালিব বসে নওয়াবজানের মুখোমুখী আসনে। গালিব বলে আর নওয়াবজান শোনে গভীর মনোযোগে। যেন সেনাপতির সঙ্গে যুদ্ধকৌশলের আলাপ হচ্ছে।
নওয়াবজান শ্রাবস্তীর কারুকার্যের দীঘল কালো চোখে গভীর মায়ায় তাকিয়ে। …..নয়নো সারসী কেনো ভরেছে জলে, কত কী আছে যে লেখা কাজলে কাজলে…।
এই ভ্রমণের গন্তব্য নেই; অথবা গন্তব্য বলে জীবনে কিছুই থাকে না; ভ্রমণের আনন্দটাই সব। এতো তাড়াতাড়ি কোথাও পৌঁছানোর তাড়া নেই নওয়াবজানের। এই মুহূর্তে বাঁচা এই যে চারপাশের সমাজ সংসার প্রতিষ্ঠানের কারাগারের পর্যবেক্ষণ চৌকিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে; কিছুক্ষণ উর্ধশ্বাস দৌড়ে জীবনকে ধরার চেষ্টা; সে ধরা দিক বা না দিক; জীবনের সঙ্গে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে লুকোচুরি খেলার যে রহস্যময় বিকেল। যখন দিল্লীতে জেসমিন ফুলের বৃষ্টি হয়, যমুনার জলকলকল ঢেউয়ের শব্দ শোঁ শোঁ হাওয়ায় মিশে; চঁদভি কি চাঁদনির মুখের পর্দা উড়িয়ে নেয়; উড়িয়ে নেয় আড়াল।
আপনি কী শুধু একবার শুধু একবারের জন্য আপনার কাব্যের জাদুঘরে আসবেন জনাব; যার দেয়ালে দেয়ালে উতকীর্ণ গালিবের পদাবলী; যেখানে বাদ্যযন্ত্রীরা গালিবের জন্য সুরের সাধনা করে; যেখানে এক ডোমনি; যার নাম চঁদভি; কাব্যগুলোকে স্মৃতির আসবাবের থাকে থাকে সাজিয়ে রাখে; যেন ইতিহাস এখানে খুঁজে পায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক প্রেমের ও দ্রোহের কবির রেখে যাওয়া গুপ্তধন।
–নিশ্চয়ই আসবো নওয়াবজান। আমি তো সম্মানিত হলাম এই ভেবে যে, আগ্রার অখ্যাত গালিবকে কেউ এতো ভালোবাসতে পারে। আগ্রা ছাড়ার পর থেকেই তো ভালোবাসার কাঙ্গাল এক মুসাফির আমি। আমার পায়ে বেড়ির চিহ্ন। এখন আবার কারাগারে ফিরতে হবে; কারাপ্রধানের কাছে ফিরে গিয়ে বেড়ি পড়তে হবে। তবু এই জনান্তিকে পুস্তকপ্রেমী ভাইজানের ভালোবাসা আর নওয়াবজানের ভালোবাসাটুকু মনের মাঝে মুক্তির ইচ্ছাটুকু জাগিয়ে রাখে; আমাকে তো ফিরে আসতেই হবে এই পুস্তকালয়ে আর নওয়াবজানের সুরের আলয়ে।
কীসিকো দেকে দিল কোয়ি নাওসাঞ্জেই ফাওয়া কিউ হো
নাহা যাব দিলহে শুননে মে তো ফির মু মে যবা কিউ হো!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন