গালিবের জন্য সাঁঝের দিকটা ছিলো আমের রসনা আর তারপর খুশীজলের ফোয়ারা। দিল্লীওয়ালাদের সঙ্গে ছোট সুগন্ধী মিষ্টি আর চুষে খাওয়া আমের আড্ডায় গালিব বলে, আমার ব্যাপারে দুটো জিনিসই বলার আছে আমার।
সবাই ঔতসুক্য নিয়ে তাকায় কবির দিকে।–অনেক সুস্বাদু হতে হবে; আর অফুরান হতে হবে।গালিব রাতের খাবার বলতে আম খেতেন। ছোট আকারের আম হলে দশ বারোটা; আর বড় আকারের হলে ছয় সাতটা।
হাসতে হাসতে গালিব বলেন, আমার ছোটবেলার বন্ধুদের একজন আম খেতে পছন্দ করতো না। সবাই তাকে এজন্য বেশ দুয়ো দিতো। একবার সবাই বসে আম খাওয়ার সময়; এক গাধা হাঁটতে হাঁটতে এসে ফেলে দেয়া আমের টুকরায় গন্ধ নিয়ে; না খেয়ে ফিরে যায়।
আমের শত্রু বন্ধুটি বলে, দেখো দেখো তোমরা সবাই চেয়ে দেখো; গাধাও আম খেতে চায় না; আর তোমরা খাচ্ছো।গালিব বলেন, শুধু গাধারাই আম পছন্দ করে না।
গালিব তার আমের রসনা তৃপ্ত করে এরপর তার খুশীজলের বোতল খুঁজতেন। এসময় যমুনা নদীর ওপার থেকে আসা দিনমজুরেরা তড়িঘড়ি করে তাদের গ্রামে ফিরে যেতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনে দিল্লীতে দ্রুত ধনীর সংখ্যা গাণিতিকভাবে বাড়ছিলো। আর গরীবের সংখ্যা বাড়ছিলো জ্যামিতিকহারে। গরীবকে টাকা ধার দিতো যে মহাজনেরা, তারা চাঁদনীচক বাজারে তাদের দোকানগুলো বন্ধ করে দিচ্ছিলো।
ইংরেজ বেনিয়াদের সঙ্গে হাত মেলানো দিল্লীওয়ালা সহমত ভাইদের কপাল খুলছিলো। একটু চালাক চতুর লোকেরা; যারা তেলাঞ্জলি দিতে জানে; কৌঠেতে রূপকুমারীদের একজন ইংরেজ অতিথির সামনে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনে রাজি করাতে পারে; যমুনার ওপারে গ্রামগুলোতে আকালের সন্ধানে ক্ষুধা-বেদনার মড়ক লাগলে; সেখানকার রূপবতীদের মুঘল খানা-খাজানার লোভ দেখিয়ে; তুলে দিয়ে আসতে পারে বৃটিশ সাহেবের বুভুক্ষু বিছানায়; তারাই রাতারাতি নতুন ধনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
খুশী হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক মহাজন বলে, আমি থাকবো ভারতে; আর উপাঙ্গ প্রক্ষালন করবো ইংল্যান্ডে গিয়ে তাতো হয়না। বরং ভারতীয় রাজপুত্রীদের আঙ্গুল হারমোনিয়ামের রিড থেকে তুলে পিয়ানোর রিডে রাখা গেলে, একসময় বদলে যাবে মানুষ-মানচিত্র। সভ্য মানুষের আরাত্রি কৃষকতায়, ভারতীয় শস্যক্ষেত্রে সভ্য সন্তান জন্ম নেবে। তোমরা কী জানো সভ্যতা কী! শিক্ষা কী! কী আছে তোমাদের দেশে; তোমাদের সম্রাট সারাদিন কবিতায় চুর হয়ে থাকে; তার চারপাশে আবিসিনিয়া আর তুর্কী রমণীরা দেহরক্ষী হয়ে তীর ধনুক নিয়ে ঘুরছে। বৃটিশ স্বর্ণ জীনের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে স্বর্ণফসলা করে দেবো রাজকীয় অমরাবতীদের।
কোম্পানীর সাহেব আত্মবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বলে, ভারতের লোকেরা তো ব্যবসা জানে না। আরে গান-কবিতা কী সম্পদ তৈরি করতে পারে! বাহাদুর শাহ জাফর কোন কাজের না; সূফি ফকিরের মতো দিনমান গোলাপ উদ্যানে হেঁটে বেড়ায়। আমার আবার গোলাপ অমন গাছের ডালে পছন্দ নয়। আমার ভালো লাগে গোলাপ খেতে; কড়মড় করে ভারতীয় গোলাপ চিবিয়ে খেতে অপূর্ব লাগে। এই তো আর কটাদিন, তারপর একদিন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বো লালকেল্লায়। তারপর আবিসিনিয়, তুর্কী গোলাপ খাবো। আর তোমাদের সম্রাটটাকে খাঁচায় পুরে, চিড়িয়াখানায় রেখে দেবো।
লালকেল্লার মাঝে মাহতাববাগে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গে হাঁটছিলেন গালিব। গাছে ধরে আছে থোকা থোকা আম। গালিব বার বার তাকায় সেদিকে। সম্রাট একবার জিজ্ঞেস করেন, বার বার কী দেখছেন কবি!গালিব বলে, সম্রাট এক প্রাচীন কবি লিখেছেন,
প্রতিটি ফলের ওপরে স্পষ্ট করে লেখা থাকে
এটা ক এর সম্পত্তি, যে খ-এর সন্তান, যে খ গ-এর সন্তান।
আমি তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, কোন আমের ওপর আমার, বাবার আর দাদার নাম লেখা আছে কীনা!জাফর হেসে বলেন, এখন না আপনার খুশীজলের সময়।
সম্রাটের দেহরক্ষী এসে মনে করিয়ে দেয় হেকিম সাহেব তাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে।সম্রাট তুর্কী রাজপুত্রী বীরগুলকে ডাকতে বলেন।
–গালিব বীরগুল শব্দের অর্থ প্রথম গোলাপ। আমাদের অতিথি। সে দিল্লীতে এসেছে কাব্য আর সুর শিক্ষায়। শাজাহানাবাদে গিয়ে ওস্তাদ তানসেনের কাছে তালিম নেয়। সুরের শরীরে কাব্যও তো লাগে। দেখুন বীরগুল আপনার কাছে তালিম নেবার যোগ্য কীনা!
বীরগুল এগিয়ে এলে, গালিব বলেন, মাশাল্লাহ, মুশায়ারায় দেখা হয়েছে তুর্কী অতিথির সঙ্গে। কবিতা তো সে বোঝে। সে আমার কবিতা বুঝেছিলো; যে কবিতার অর্থ দিল্লীর কবিরাজরা বুঝতে পারে না।
সম্রাট স্মিত হেসে এগিয়ে যান।বীরগুল গালিবের চোখে চোখ রেখে বলে, আপনাকে আমার কক্ষের লাগোয়া ঝুলবারান্দা থেকে যমুনা নদীর ওপর রুপা ছড়িয়ে দেয়া চাঁদ দেখাতে চাই।গালিব তাকে অনুসরণ করে চন্দ্রাহতের মতো। হলুদিয়া পাখী সোনারি বরণ; পাখীটি ছাড়িলো কে; যে উড়ে উড়ে আনতালিয়া থেকে বাইজেনটাইন প্রাসাদ থেকে উড়ে উড়ে এসে বাসা বেঁধেছে দিল্লীর লালকেল্লায়।
তুর্কী খুশীজলের বিষ পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বলে, আমরা কী এখন ঝুল বারান্দার গোলাপ বাগানে চাঁদ দেখতে যাবো জনাব!
গালিব স্বভাবসুলভ হাসিতে বলে,গোলাপের সৌরভ এখানে আছে,গোলগাল চাঁদ আছে; এতো ঘর নয়বারান্দা; আমার মুক্তির বারান্দা বীরগুল।
বীরগুল তার জাদুকরী লাস্যে বলে,
মুক্তি কোথায় খুঁজছেন কবি!
মুক্তিতো আপনার মনে;
মনেই ঘর, মনেই বারান্দা,
কারাগার থাকে চিন্তায়;
চাইলে সেখান থেকে উড়াল দিয়ে
গোলাপ বাগানের সৌরভ নেয়া যায়।
বীরগুল হেঁটে গেলে তার গ্রীবা মোহন ঘোটকীর মতো সোন্নত সাহসে; কারাগারের গরাদ উপড়ে; অনিষ্পন্ন আকাংক্ষার কাছে ছুটে যাবার ইশারা দেয়।
–কবি দেখুন কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে; আহা চাঁদ গলে রুপবৃষ্টি হচ্ছে যেন, যমুনার দরাজ বুকে। দেখলে মনে হবে , স্বর্গের আদম আর ইভের স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হবার গল্পটা লেখা হচ্ছে প্রেমময় রাতের বুকে!
–চাঁদ দেখবো কী বীরগুল। চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি দেখেছি প্রথম গোলাপ। আচ্ছা আজ রাতে কী চন্দ্রমুখী রুপালি রঙের সঙ্গে কোন গোলাপের রঙ মিশিয়েছে। জ্যোতস্না তো অনেক দেখেছি; আজ এমন রঙের বাড়ই কেন!
–কবি আমি তো সেই ব্রাহ্ম-সাঁঝেই আপনার কবিতার কারাগারে গ্রেফতার হয়েছি। আমাকে রাখবেন আপনার কাব্যের কারাগারে!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন