নওয়াবজান (২য় পর্ব)

১৬৪ পঠিত ... ১৭:১০, জুন ১৪, ২০২৩

মাসকাওয়াথ-আহসানের (1)

প্রথম পর্বের লিংক

 

কোন কোন রাতে কবিতা সংগীতকে মাঝরাতে ছুটি দিয়ে বাহাদুর শাহ জাফর অন্য রাতের চেয়ে একটু আগেই ঘুমাতে যেতেন। লাল কেল্লার জানালাগুলোতে পর্দা পড়ে গেলে; অনেক রাজপুত্রী হাওয়া রাতে চুপি চুপি পালিয়ে যেতেন চৌরিবাজারের কৌঠিগুলোতে। যেখান থেকে মৃদু্মন্দ গানের আওয়াজ, নাচের ঘুঙ্গুরের শব্দ ভেসে আসতো চাঁদনী চক পর্যন্ত। নারী সাজতো অপরুপ লাস্যে; দূর দূরান্ত থেকে অভিজাত অতিথিরা আসতেন সেখানে রহস্যদেবীদের গলায়, বাহুতে, কোমরে, পদযুগলে হীরে-জহরতের অলংকারের পূজা দিতে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন নবাবেরাও আসতে শুরু করেছিলেন; পুরোনো নবাবদের এই আনন্দগৃহে তাদের নতুন মোহর নিয়ে।

চৌরি বাজারের কোঠিগুলোর নক্সী বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নর্তকীদের এসো এসো ডাকে আলো অন্ধকারে যাই; খানিকটা ভালো লাগা, খানিকটা ললিতলোভনকাকান্তির লোভে; দিল্লীর দাপুটে অভিজাত সমাজ আত্মসমপর্ণ করতো নিজেদের; স্বপ্নবতীদের ঘুঙ্গুর শাসনের কাছে।

সেই যে আরো একশতক আগে আদ বেগম এমন আলো আঁধারিতে হাজির হতেন শৈল্পিক নগ্নতায়; মিহি রাম কাপড়ের পাজামার পরিবর্তে তার শরীরে আঁকা পাজামার চিত্রকলা; ফুল-লতা-পাঁপড়ি আঁকা ঐন্দ্রজালিক তৈলচিত্রে বোঝার উপায় ছিলো না; এই আলোছায়ার জলসাঘরে; নূর বাঈ ঠিক কী পরে আছেন; অমন মনোরম পোষাকের আভরণে; অথবা নিরাভরণে। তাদের দেখা যায়; কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। হীরে জহরত পায়ের কাছে সমর্পণ করলেও নূর বাইয়ের মন পাওয়া যেতো না যেন।

অনভিপ্রেত ভিড় এড়াতে হাতি দাঁড় করিয়ে বন্ধ করে দেয়া হতো নূর বাইয়ের গলির মুখ।

কিন্তু গালিবের কবিতার আসর যেন তার চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলো নবাবদের কাছে। কোঠির সংগীত নৃত্য ললিতলোভনকান্তির লোভ হেরে যাচ্ছিলো যেন; আজমেরি দ্বারের বাইরে জলসাঘরে কিংবা মুফতি সাদরুদ্দিন আযুরদার গৃহে; কবি যক আর গালিব যখন দিল্লীর বুকে তোলপাড় তোলেন তাদের কাব্যের আংরাখায়; আর রহস্যে রোমান্টিকতায় তা যেন নূর বাঈয়ের চিত্রকলার পোষাকে নৃত্যকে পিছে ফেলে দেয়।

চৌরি বাজারের রাজপুত্রীরা কবি গালিব কখনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ফুল ছুঁড়ে মারতো; কিংবা রেশমী রুমালে প্রেমের সুগন্ধী ভরে তাকে তাবিজের মতো দিয়ে আসতো গালিবের শেরওয়ানির বুক পকেটে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সাম্রাজ্য দখল করে বাহাদুর শাহ জাফরকে চারপাশ থেকে ঘেরাও করে ফেললে; থাগস অফ ইন্ডিয়ার চোরের খনি ঠিকই তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। সম্রাটের সচিবালয়ের কেরানিরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তেলাঞ্জলি দিয়ে; বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট নবাবের পদ-পদবী জিতে নিচ্ছিলো। ইংরেজ সাহেবদের ঘরে পালকিতে করে দারিদ্র্য বিশীর্ণ উপশহরের; যমুনার ওপারের গ্রামের উচ্চাভিলাষী পিউপাপিয়াদের পৌঁছে দিয়ে রাজবদরেরা বুলবুলি আখড়াইয়ের মাঝে ধীরে ধীরে শেষ নবাবকে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো প্রাণহীন করে তোলে। যাকেই বিশ্বাস করেছেন বাহাদুর শাহ জাফর একজন কবির সরলতায়; সেই যেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলো।

তবুও কবি বাহাদুর শাহ জাফরের দিল্লীতে আখেরি শামা জ্বলতে থাকে মুশায়রার সাঁঝে। স্যার ডেভিড অক্টারলনির বিধবা স্ত্রী মুবারাক বেগমের আলোকজ্জ্বল রাজকীয় উঠোনে জাফরের কবিদল আর রাজপুত্রীরা জড়ো হতে থাকে। সেখানে গালিবও যেতেন।উঠোনের উঁচু করে বানানো কাঠের পাটাতনের ওপর সুতির চাদর পাতা হতো। ঝাড়বাতি, দেয়াল লন্ঠন,ঝুলানো বাতি, চীনে বাতি দিয়ে সাজানো হতো কবিতার আনন্দগৃহ। ছাদের মধ্যবিন্দু থেকে ঝোলানো হতো ঝাড়বাতি; জেসমিন ফুলের মালা-স্তবক। গৃহময় ছড়িয়ে থাকতো নানারকম স্নিগ্ধ সুগন্ধ।

কবি জক আর মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের কবির লড়াই উত্তুঙ্গ মুহূর্তে পৌঁছালে; সঙ্গীত আর কাব্যপ্রিয় রাজপুত্রীরা ভিড় জমাতো গালিবের চারপাশে। জক তাকে রমণীমোহন বলে মৃদু টিটকারী দিলে; গালিব মুচকি হেসে এক রাজপুত্রীর দিকে তাকিয়ে একদিন বললেন,

ইশক মুঝকো তো নেহি রাহেশাত হি সাহি

মেরি রাহেশাত তেরি শাহারাত হি সাহি

হাম ভি দুশমন তো নেহি হ্যায় আপনে

গার তো তুঝসে মোহাব্বাত হি সাহি।

গালিব তখন ভাবছিলেন নওয়াবজানের কথা। কিন্তু এক তুর্কী রাজপুত্রী গালিবের দৃষ্টিকে প্রেমের আমন্ত্রণ ভেবে আরো কাছে এসে দাঁড়ান।

ঘর অথবা কারাগারে

গালিব তার দোতলার হাওয়াখানায় বসে একটা অস্পূর্ণ কবিতা শেষ করার দুর্মর লড়াই করছে। নওয়াবজানের জলসাঘরে প্রথম দেখায়, গালিবের প্রতি সুরেশ্বরীর প্রেমের গভীরতায় ভয় পেয়ে গালিব নিজের পরিচয় গোপন করেছিলো। ঝামেলা এড়াতে নিজেকে গালিবের বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। কারণ নিজেকে নওয়াবজানের প্রেমের যোগ্য মনে হয়নি গালিবের।

এই যে তার ওমরাও বেগমের সঙ্গে সম্পর্কের কারাগার; দুটো পরিবারের পুরোনো জানাশোনার সূত্র ধরে যে সম্মন্ধ স্থাপিত হয়েছে; সমাজ-সংসার আর প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত দেখভালে; সারাক্ষণ গালিবের দোষত্রুটি ধরতে ওঁত পেতে বসে থাকা পাশের বাড়ির চাচীরা; আর তাদের সুমন্ত্রণায় তেতে ওঠা চাচাসমাজের গম্ভীর অসন্তুষ্ট চেহারাকে পাশ কাটিয়ে; দোতলার এই হাওয়াখানার ঘরে; কবিতার সঙ্গে সংসার করে সে; তীব্র অভিমানে।

ওমরাও বেগম ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, এতো উদাস লাগছে যে জনাব; কেউ কী আপনার আর আমার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে!

–আর কে আছে বলো আমার। ঐ তো একটু খুশিজল আর পাশা খেলা। ওটুকু নাহলে যে আমি নিজের মধ্যে গুমরে মরে যাবো ওমরাও!

–আর কেউ এসে দাঁড়ায়নি তো আমাদের মাঝে!

গালিব কিছু বলতে গেলে; হঠাত মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে। ওমরাও উঠে যাবার ভঙ্গি করে বলে, যাই নামাজের ওয়াক্ত হলো।

গালিব বলে, আমাদের দুজনের মধ্যে কে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারো ওমরাও। কী এতো কথা তোমার প্রেমিকের সঙ্গে। দিনে পাঁচবার তার সঙ্গে দেখা নাহলে কী হয়! এবেলা নাহয় আমাকে সময় দিলে।

ওমরাও দুকানের পাশে আঙ্গুল দিয়ে বলে, তওবা, এমনি তো নামাজ পড়েন না; তারপর যত গুনাহর কথা!

–আচ্ছা বলো তো ওমরাও; বাচ্চারা কী তার বাবা-মা’র সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে কিছু চায়; খোদার তো আমরা সন্তান। আমাদের কেন এতো ঝুঁকে ঝুঁকে তার ভালোবাসা আর অনুগ্রহ চাইতে হবে!

–আপনি নিজেও নামাজ পড়বেন না; আমাকেও পড়তে দেবেন না দেখছি; ইয়া খোদা, মাফ করো এই না বুঝ ইনসানকে।

–তুমি কী জানো ওমরাও; তুমি খোদার বেশি প্রিয় নাকি আমি! এমনও তো হতে পারে; আমাকেই তিনি বেশি ভালোবাসেন; আমাকেই তো তিনি কবিতা দেন!

–আপনার কথার হেয়ালিতে আমি আর পড়ছি না! আমার পরকালের ভয় আছে।

–কিয়ামতের পর দেখবে, তোমরা সব মাঠের মধ্যে নীল তসবিহ নিয়ে লম্বা সারিতে বসে থাকবে; কতক্ষণে বেহেশতে একটু জায়গা দেবে সে অপেক্ষায়। আর আমাকে দেখবে অত্যন্ত গুরুত্ব অতিথিদের সঙ্গে, নমরুদ-ফেরাউনের রাজকীয় সারিতে গালিবকে দেখবে।

ওমরা তওবা তওবা জপ করতে করতে তীরের বেগে বেরিয়ে যায়। গালিব অনেকদিন পর একটু প্রাণখুলে হাসে। আগ্রা থেকে দিল্লিতে এসে এই ইটপাথর,চুনসুড়কির শহরে তো হাসতেই ভুলে গেছে গালিব।

বাড়ির চৌকিদার এসে খবর দেয় কে একজন দেখা করতে এসেছে গালিবের সঙ্গে। গালিব সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে প্রবেশদ্বারের দিকে যাবার পথে দেখে, ওমরাও জলচৌকিতে বসে নামাজ পড়ছে। গালিব পায়ের খড়ম খুলে হাতে নিয়ে যাবার সময় বিড় বিড় করে, বাড়িটাকে এক ভীতিপ্রদ জায়গা বানিয়ে ফেলেছে ওমরাও; খোদার ভয়ের চেয়ে এখন ওমরাওয়ের খোদাপ্রেমের ভয় বারবার অপরাধবোধ আর স্নায়ুচাপে ফেলে দেয়।

সালাম দিয়ে আগন্তুক নিজের পরিচয় দেয়, জনাব আমি নওয়াবজানের মুলাজিম। জনাব আপনি গালিবের কবিতার একটি ছত্র নওয়াবজানকে বলেছিলেন। আপনি উনাকে কথা দিয়েছেন, গালিবের কাছ থেকে পুরো কবিতা সংগ্রহ করে নওয়াবজানকে দেবেন। উনি পাঠালেন কবিতা সংগ্রহে। অনুগ্রহ করে কী দেবেন জনাব!

–আপনি আমার বাড়ি চিনলেন কী করে!

–আপনি নওয়াবজানের কৌঠের সামনে যে পুস্তকঘরে যান, ওখানে আপনাকে দেখে সেখানে নওয়াবজান আমাকে পাঠিয়েছিলেন, আপনার ঠিকানা সংগ্রহ করতে।

গালিব লোকটার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,–চলুন দেখি দোতলার হাওয়াখানায় যাই; দেখি গালিবের কোন কবিতা টুকে দেয়া যায় কীনা! আমার সংগ্রহ থেকে!

গালিব বলতে থাকে,

মুদ্দাত হোয়ি হ্যায় ইয়ার কো মেহেমান কিয়ে হুয়ে

যো শের কাদাছে বেইযমি চেরাগো কিয়ে হুয়ে;

কারতা হু জামা ফির যিগারে লাখত লে লাখতকো

এইসা হুয়া হে দাওয়াতে মিসদা কিয়ে হুয়ে।

 

তৃতীয় পর্বের লিংক

১৬৪ পঠিত ... ১৭:১০, জুন ১৪, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top