ওমরাও বেগম একজন কবির স্ত্রী হিসেবে খুশিই ছিলো। কিন্তু প্রতিবেশীরা এসে তাকে সারাক্ষণ এটা ওটা উপদেশ দিতো। পাশের বাড়ির চাচী আম্মা বলতেন, বাবার বাড়িতে থাকো। তোমাদের তো নিজেদের বাড়ি কোনদিনই হবে না। আমার মেয়ের জামাই দেখো, বাহাদুর শাহ জাফরের সচিবালয়ের সামান্য পেশকার হয়ে কী সুন্দর হাভেলি বানিয়েছে। ঈদে-পার্বণে নজরানা পাঠায় বড় বড় ডালায় করে। অথচ তোমার স্বামী কিছুই তো করতে পারলো না। বিশ্বাস হয়না যে ওর শরীরে মুঘলের রক্ত। ওর দাদা সমরখন্দ থেকে এসেছিলো; মুঘল জেলার প্রশাসনিক প্রধান ছিলো। ওর বাবা সাহসী বীর ছিলো; যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। অথচ সেই বংশের ছেলেটাকে দেখো। বংশের মান মর্যাদা ধূলায় মিশিয়ে দিলো। কবিতা লেখে; কবি হয়েছে; আরে কবিতা লিখে কী শান সোওকত হয়! জানিনারে ওমরাও কী হবে তোর।
ওমরাও পাশের বাড়ির চাচী আম্মাকে বিদায় দিয়ে জায়নামাজে বসে, বিধাতার কাছে প্রার্থনা করে। হে খোদা, গালিবকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দাও।
পাশের বাড়ির চাচী আম্মা যাবার পথে ওমরাও-এর বাবার কানভারী করে যায়, মেয়েকে এ কোন অকাল কুষ্মান্ড’র হাতে তুলে দিলেন গো ভাইসাব! কী হবে ওর!
ওমরাও নামাজ পড়া শেষ করে; সংসারের কাজ করার সময় তার বাবা এসে জিজ্ঞেস করে, গালিব কোথায়! ওকী দপ্তরে গেছে; নাকি খুশিজলের আসরে মত্ত!ওমরাও উত্তর দেয়, না আব্বাজান, ও তো চারদিন ধরে ঘরে। নতুন একটা কবিতা লিখছে!
: কবিতা দিয়ে কী হবে! ইতিহাস গ্রন্থণার যে কাজ দিয়েছেন সম্রাট, ওটা একটু মন দিয়ে করলেই তো পারে। কী মুশকিলে পড়লাম এই মদ্যপের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে। আমি যাই দেখি, সে কী করছে!
ওমরাও বাধা দেয় তার বাবাকে, ওকে ওর মতো থাকতে দিন।
এমন সময় গালিব সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সালাম দেয়, আব্বা হুজুর আপনি কী আজ সম্রাটের দপ্তরে কবিতা শুনতে আসবেন?
: দেখা যাক মিয়া।
কবিতার প্রতি তেমন আগ্রহ বোধ করেন না নবাব সাহেব। তার চিন্তা মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে; আর এই উদাসীন আলস্য বিনোদিত ভাবের জগতে খোয়া যাওয়া গালিবকে নিয়ে।
দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারে আজ তারকা কবিদের মেলা। দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন খ্যাতিমান কবিরা। আর আছেন দিল্লীর স্থানীয় কবিরা। দিল্লীর কবিরা অন্য কোন এলাকার কবিদের কবি বলে মনে করেন না। পরস্পর পরস্পরের কবিতার প্রশংসা করে; সৃজনশীল ও মননশীল ধারার পুরস্কারের জন্য একে অপরকে মনোনীত করেন।
একের পর এক আবছায়া কবিতা, বিমূর্ত কবিতা, সম্রাটের প্রতি তেলাঞ্জলির কবিতা পড়ে; কবিতার শামাটিকে পরিচিত কবিদের সামনেই ঘোরাতে থাকেন; অনুষ্ঠানের উপস্থাপক।শেষ পর্যন্ত গালিবের নামটি বলে একান্ত অনিচ্ছায়। গালিব আগ্রা থেকে এসেছে বলে, দিল্লীর উর্দু সাহিত্য মহলের মালিকানা নিয়ে বসে থাকা কবিরা তাকে পাত্তা দিতে চায় না। একজন তো বলেই বসে, মফস্বলে আবার কবিতা চর্চা হয় নাকি!
গালিব চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ ও ভারী হয়ে বসে বসে থাকা কবিদের দিকে একবার তাকান। ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা তার,
সেও আবার কবি যে খুশিজলের ফোয়ারায় স্নান করে না!
জুয়ার আসরে জীবন বাজি রাখে না; সেও আবার কবি!
কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যে দিনরাত গুজরান করেনি
সেও আবার কবি যে আইনের হাতে গ্রেফতার হয়নি কখনও!
গালিবের কথা কী করে বুঝবে সে; যে জীবনের গভীরের জীবনেউঁকি দিয়ে দেখেনি; কতসব রহস্য জুড়ে আছে কবিতার শরীর জুড়ে।
ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন দিল্লীর প্রধান কবিরা; হৈ চৈ শুরু হয়। গালিবের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে জাঢ্য জরদগব কবিদল। একজন তো আর্তনাদ করে বলে, জানি মিয়া জানি আগ্রায় কীসব কাব্যচর্চা হয়! আদব জানে না যে, তাকে কী আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আমাদের অপমান করতে।গালিব একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে কবিতার আসর ছেড়ে যান। তার পালকির বেহারাদের বলেন, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর একমুহূর্ত এখানে নয়; আমাকে নিয়ে চলো এমন কোথাও যেখানে খোলা হাওয়া আছে।
বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারে দিল্লীর কবিরাজদের দম্ভ; অকাব্যের গজদন্তের মিনার পেরিয়ে গালিবের পালকি লালকেল্লার পাশের চাঁদনী চকের গলিতে ঢুকে।
মন বিক্ষিপ্ত। আগ্রার জীবন তো অনেক ভালো ছিলো। সবাই ভালোবাসতো তাদের গালিবকে। প্রবীণ কবিরা ডেকে বলতেন, ওহে বরকন্দাজ তোমার কবিতার দিয়া জ্বলবে গোটা দুনিয়ায়। কোথায় যাচ্ছো এই প্রেমময় আগ্রা ছেড়ে। দিল্লীতে কী তুমি এমন মৌলিক মানুষের উষ্ণতা পাবে! ওখানে সবাই ভাগ্য বদলের ইঁদুর দৌড়ে মাতোয়ারা; নিজের গভীরে ডুব দেবার ফুসরত কোথায় রাজকবিদের; যারা পুরস্কারের জন্য দিল্লীশ্বরকেই খোদা মেনেছে। কিন্তু তোমার খোদা তো কবিতা গালিব; থেকে যাও আগ্রাতে। ফাঁপানগরের কর্কশ ইট-পাথরের কারাগারে তোমার দম আটকে আসবে।
গালিবের অনুতাপ হয়; বিবমিষা জাগে। ওমরাও বেগম সারাক্ষণ খোদার প্রেমে দিওয়ানা। কী কথা খোদার সাথে! কতবার নিষেধ করেছে,
ঐখানে যেওনা ওমরাও;
বোলোনাকো কথা তুমি খোদার সাথে।
কোথায় কার কাছে যাবে! মৃত্যু ছাড়া কী মুক্তি নেই এই জীবনের কারাগার থেকে।
চকিতে সুর ভেসে আসে; যে সুর বুকের ভেতরে তোলপাড় তোলে। বেহারাদের জিজ্ঞেস করে, কে গাইছে এমন সুরেলা গান; কে সেই সুরের ঈশ্বরী। নিয়ে চলো আমাকে। অসুরের কোলাহল থেকে আমাকে মুক্তি দাও।
আও হো চাহিয়ে ইক উমরে তাক আসর হোনে তাক
প্রার্থনার জন্য পুরো জীবন লেগে যায় উত্তর পেতে।
চেনা শব্দ চেনা চিন্তা চেনা গল্প চেনা বিষণ্ণতা চেনা হাওয়া চেনা ফুলের বাগান। অকস্মাত পুরো জীবন যেন গালিবের পক্ষে ষড়যন্ত্র করে; তাকে আগ্রার মায়ার কাছে নিয়ে যেতে।
কৌন জিতা হ্যায় তেরি যুলফেকে সার হোনে তাককে
বেঁচে থাকে তোর মাথার বেণী ঝুঁকে যাওয়া পর্যন্ত!
পালকি থেকে নেমে গালিব তার নিয়তির দিকে হেঁটে যেতে থাকে। সুরাহতের মতো মন্ত্রমুগ্ধ হানা মানুষের মতো গালিব অস্থির হয়।আশিকি সাবরি তালাব অউর তামান্না বেতাবভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আকাংক্ষা ঢেলে দিতে হয়।
গালিব বেলেপাথরের মিহরাবে নিপুণ কারুকাজ করা খিলানের নীচে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে সুরেশ্বরীর গান।
দিল কিয়া কিয়া রাং কারু খুন-ই-জিগার হোতে তাক
যতক্ষণ এই বেদনা আছে, কী করে আমার হৃদয় শক্তি ধরে রাখবে।
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে নওয়াবজান গান বন্ধ করে। কটাক্ষ করে, এ শহর থেকে কী আদব উঠে গেছে যে খবর না দিয়ে এতো রাতে এ শহরের শরীফেরা নারীর ঘরে উঁকি দেয়।
গালিব জিজ্ঞেস করে, অনুমতি দিলে জিজ্ঞেস করতে পারি, এ কবিতা কার লেখা; কে এই মায়াবী সুরের জালে জড়িয়েছে কাব্য!
: সে আমার প্রিয় কবি, এই জাহানের সেরা কবি; তার কথা ভেবে আমি অতন্দ্র নিশি কাটাই; সে আমার মনের মানুষ। আমিই তাকে আমার হৃদয়ের রেশমী সুরে জড়াই।
গালিবের মনের শূন্যতার হাহাকারের মাঝে একটা দমকা বাতাস বয়ে যায়। একটা বিশাল বজরা নৌকা এসে যেন দুলুনি দেয় গালিবের হৃদয়ের ডিঙ্গিটাকে। কয়েক পলের প্রথম দেখায়; গালিব স্বপ্নের ঘোরে অনুভব করে জ্বরের উত্তাপ। অনেকদিন পরে যেন এই শুষ্ক পাথুরে শহরের বুকে বৃষ্টি এলো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন