চেয়ারম্যান সাহেব মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, এসিল্যান্ড স্যার, উচ্ছেদটা কইরেন না। অসুবিধা আছে।
এইসব কথার সরাসরি উত্তর হয় না।
আমি পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম। সিগারেট ধরানোর একটা মাজেজা আছে, তোমাকে আমি কেয়ার করি না।
অবশ্য মুখে একটা কাচুমাচু ভাব ফুটিয়ে তুললাম। লম্বা করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললাম- দেখেন চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি এইখানের স্থানীয় মানুষ। লোকজন যারা উচ্ছেদ হবে, তারাও স্থানীয়। তাদের কথা আপনি চিন্তা করবেন, এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার তো উপরের থেকে অর্ডার আছে। আপনি উপর থেকে অর্ডার ক্যানসেল করান, আমি ভাংবো না। অর্ডারের দাস আমি। আমারে বলে লাভ কী?
এইসব আসলে ভুজুং বিশেষ। খালের পাড়ে বিল্ডিং স্থাপনা মানেই অবৈধ। এইখানে কয়েকটা বিল্ডিং তুলে ফেলার জন্য হ্যাডম লাগে। যারা তুলেছে, তাদের সেই হ্যাডম আছে। পলিটিক্যাল হ্যাডম। বাংলাদেশে এই হ্যাডম থাকলে যুগে যুগেই তাদের বাঁচাতে চেয়ারম্যান সাহেবরা ছুটে এসেছে।
এই উচ্ছেদের ব্যাপারে অবশ্য উপর থেকে কোন নির্দেশনা আসেনি। তহশীলদারের রিপোর্ট দেখে আমিই ইউএনও স্যারকে জানিয়েছি। ইউএনও স্যার মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছেন- তুলে দাও। আমি ডিসি স্যারের সাথে কথা বলে রাখবো।
এইরকম উচ্ছেদ-টুচ্ছেদ না হলে দখলদারীদের মনে ভয়ডর থাকে না। সবার মনেই ডর-ভয় থাকার দরকার আছে।
চেয়ারম্যান সাহেব আবার আস্তে করে বললেন- বুঝতেছেনই তো স্যার। এরার পাওয়ার কিন্তু কম না। উচ্ছেদ হইলে আমার তো বিপদই, আপনের বদলির লাইগ্যাও এরা কিন্তু দেনদরবার করবো।
আমি মনে মনে হাসলাম। এদের করার দরকার কী? আমি নিজেই তো বদলির জন্য দেনদরবার কম করছি না। এই অজপাড়া উপজেলায় কয়দিন পড়ে থাকতে মন চায়?
তহশীলদার আগেই পুলিশ নিয়ে রওনা হয়ে গেছে। সাথে নিয়েছে বুলডোজার। খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না যদিও। ফোন দিয়ে বলেছে- স্যার, এইখানে তো গ্যাঞ্জাম করে।
আমি বলেছি- গ্যাঞ্জাম তো থাকবেই। আমিই আসতেছি। আপনার বেশি কথাবার্তা বলার দরকার নাই। চুপচাপ সাইডে থাকেন।
আবার ফোন আসছে। তহশীলদার ফোন দিলো? নাকি উপরমহল থেকে ফোন? চেয়ারয়ান সাহেব যেহেতু অফিসে এসেছে, একটা ফোনকলের ব্যবস্থা না করে আসার কথা না।
অপরিচিত নাম্বার। উপরমহলেরই হবার কথা। এইসময়ের ফোনের তাৎপর্য্য অনেক।
- স্যার, আমি জলিল মিয়া।
- কোন জলিল মিয়া?
- ইউএনও স্যার আপনার নাম্বার দিয়া কতা কইতে কইছে।
- আচ্ছা জলিল মিয়া, আমি এই মুহূর্তে একটু ব্যস্ত। পরে ফোন দিয়েন।
ফোন কেটে দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকালাম। সম্ভবত চেয়ারম্যান সাহেব ফোনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এইসব ক্ষেত্রে ডিল সামলানো খুব কঠিন কিছু না।
সিগারেটটা নিভিয়ে বললাম- চলেন আমার সাথে। খালের পাড়ে যাই। আপনার লোকদের আপনেই বুঝাইয়েন।
সরকার একটা ভালো সুবিধা দিয়েছে ইদানিং। এসিল্যান্ডদের একটা করে হুডি পিকআপ দিচ্ছে। ড্রাইভার অবশ্য দিচ্ছে না। বেতনের যা স্কেল তাতে নিজের টাকায় ড্রাইভার পোষা সম্ভব না। নিজেই চালাই। ড্রাইভার থাকলে একটু জুত হতো।
অবশ্য এসিল্যান্ডের চেয়ে এসিল্যান্ডের গাড়ির দাপট বেশি! এই গাড়ি দেখলেই মানুষের খবর হয়ে যায়। এই গাড়ির মানুষ যে ক্ষমতা ধরে, সাধারণ মানুষ সেটা জানে। দু'পেয়ে একটা মানুষের চেয়ে এই ক্ষমতার দাপট মানুষের কাছে বেশি ভীতিকর। সম্মানেরও।
খালের পাড়ে বুলডোজারের চাপে নরম মাটি দেবে গেছে। এই জিনিস আর বিল্ডিংগুলার কাছে নেয়া সম্ভব না। আর নিলেও কাজ হতো না। এতোই শক্ত করে বিল্ডিং বানিয়েছে, বুলডোজার দিয়ে ভাঙা সম্ভব না। বুলডোজার নিচের থেকে মাটি তুলে ফেলে। এই জিনিস ভাংতে হলে ভেক্যু লাগবে। উপর থেকে দুরমুশ দিয়ে বাড়ি দিয়ে দিয়ে ভাংবে।
আমার মেজাজটাই খিচড়ে গেলো। হারামজাদারা সরকারি জায়গায় এতো শক্তভাবে বাড়ি বানিয়েছে কেন? উচ্ছেদের ভয় নাই এদের? এতোই আত্মবিশ্বাস?
আসার সময় দূর থেকেই দেখছিলাম অনেক লোকের জটলা। এসিল্যান্ডের গাড়ি দেখে জটলা সরে গেছে। সবাই জানে এই অফিসার একটু পাগলা টাইপের আছে। জেল-জরিমানা দিতে কার্পন্য করে না। কে আর সাধ করে মাসখানেকের জেল খাটতে চায়?
চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম বিল্ডিংগুলার কাছে- এই বিল্ডিঙের মালিক কে?
লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরা এক লোক এগিয়ে এলো- আমি স্যার।
- এতো শক্ত করে বাড়ি বানাইছেন কেন সরকারি জায়গায়? ভাংতে কষ্ট হয় না?
- ভাংবেন ক্যান স্যার? অন্যভাবে ফায়সালা করোন যায় না?
আশেপাশে একঝাঁক কুকুর। ছাল ওঠা। দেখলেই বিরক্ত লাগে।
আমি গলা খাকারি দিয়ে থুতু ফেলে বললাম- যতোসব কুত্তার পাল।
চেয়ারম্যান সাহেব আর বিল্ডিঙের মালিক মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। গালটা তাদেরই দেয়া হলো কিনা বুঝতে পারছে না।
- কী নাম আপনের?
- জ্বি স্যার, আসগর আলী।
- শোনেন আসগর আলী সাহেব। আপনাকে তিনদিন সময় দেয়া হলো। তিনদিন পরে আমি এসে দেখতে চাই এইখানের সব বিল্ডিং ভাঙা কমপ্লিট। ভাঙ্গা ইট-সিমেন্ট-রড যা ইচ্ছা নিতে পারবেন। তিনদিন পর যদি এসে দেখি বিল্ডিঙের কোনকিছু এইখানে আছে, বাড়ি তো ভাঙ্গা হবেই, সিমেন্ট-রড সব নিলামে উঠবে। আর আপনাদের নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা হবে, দুই মাসের জেল। কথা ক্লিয়ার?
- জ্বি স্যার ক্লিয়ার।
আমি চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মধুর হাসি দিলাম। তেমন বড় কোন থ্রেট ছাড়াই কাজ সামাল দেয়া গেছে।
...
সন্ধ্যাবেলায় বাসার সামনে এসে দেখি বুড়োমতোন একটা লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ আবার কোন আপদ বাবা? সরকারি কোয়ার্টার পাইনি, ভাড়া বাসায় উঠতে হয়েছে। গার্ড-টার্ডের ব্যবস্থা নেই। ভয়ই লাগে।
- সালাম স্যার। আমার নাম জলিল মিয়া।
- কোন জলিল মিয়া?
- আমারে ইউএনও সাব আপনার কাছে পাঠাইছেন।
- কী ব্যাপারে বলেন তো?
- আপনার বলে স্যার রান্ধনের লোক লাগবো?
- ও আচ্ছা, আপনার কথাই ইউএনও স্যার বলেছিলেন? আসেন, ভিতরে আসেন।
কথায় কথায় সেদিন ইউএনও স্যারকে বলেছিলাম রান্নার কষ্টের কথা। তেমন যে খেতে পছন্দ করি আমি তা না, কিন্তু কিছু একটা খেতে তো হবে! কয়দিন আর হাত পুড়িয়ে ডিমভাজি, আলুভর্তা করতে ইচ্ছা করে? হোটেলের খাবারও গলা দিয়ে নামে না।
ইউএনও স্যার ভোজন রসিক মানুষ। কোন এক সভায় গিয়ে আইড় মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন। ভালো লাগাতে বাবুর্চির ঠিকানা সুদ্ধো নিয়ে এসেছিলেন। আমার রান্না করার বুয়া দরকার শুনে বলেছিলেন- আরে তুমি ব্যাচেলর এখনও, বুয়া-টুয়া রাখলে চৌদ্দ দরবার। আমি একটা বুড়ো লোক পাঠাচ্ছি, তোমাকে ফোন দেবে।
এই সেই জলিল মিয়া।
ঘরে ঢুকে আরাম করে বসে বললাম- বসো জলিল মিয়া।
চাকরি জীবনের একটা শিক্ষা, এদেরকে তুমি করেই বলতে হয়। তাহলে এরা আরাম বোধ করে। সম্পর্ক সহজ হয়। আপনি আজ্ঞে করলে ব্যাপারটা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো কিছু একটাতে গিয়ে ঠেকে।
জলিল মিয়া বসলো না। হে হে মুখ করে দাঁড়িয়েই রইলো। তার মানে সহবত জানে।
কী কী রান্না করতে জানো?
এই টুকটাক সবকিছুই পারি। স্যারের কি বাজার করন লাগবো?
হ্যাঁ, ঘরে তো কিছুই নেই। ডিম রাঁধবে না খালি। ঐ জিনিস খেতে খেতে বিতৃষ্ণা এসে গেছে।
জলিল মিয়া হাসলো। একটু পরে আমার থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
আমি জামাটা পালটে একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনের খোলা বাগানের মতো জায়গাটাতে আসলাম। কিছু গাছটাছ লাগাতে পারলে ভালো হতো। সময় কই? সন্ধ্যেবেলা বাসায় আসলে ভাত রান্নার কথা মনে হলেই জ্বর আসে। তখন এইসব বাগান-টাগান করার কথা মাথা থেকে পালায়।
ঢাকা থেকে সুমন একটা বইয়ের পার্সেল পাঠিয়েছে। ফেলুদা সমগ্র। আগেই সবগুলো পড়া। নতুন করে আবার পড়া যাবে। সময়গুলো খারাপ কাটবে না।
রাত্রিবেলা জলিল মিয়া এসে ডাক দিলো- স্যার, খাওন রেডি।
জটায়ু-তোপসেতে এমনভাবে ডুবে ছিলাম যে জলিল মিয়ার কথা খেয়ালই ছিলো না।
খাবার আয়োজন অসাধারণ কিছু না। শিমের বিচি দিয়ে শিং মাছের ঝোল। আলু দিয়ে লাউ শাক। আর মাষকলাইয়ের ডাল। আমি খাদ্যে মোটামুটি অনাসক্ত। পেট ভরলেই চলে। হাত ধুয়ে বসে গেলাম।
জলিল মিয়ার রান্নার হাত খারাপ না। তার ওপর টানা ডিমভাজি-ভাত খাবার পরে যে কোন রান্নাই ভালো লাগবে। জলিল মিয়াও উৎরে গেলো। শেষ করে বললাম- বাহ, ভালোই তো রেঁধেছো জলিল মিয়া!
প্রশংসায় সবাই খুশি হয়। জলিল মিয়াও হলো- এইটা আর কী এমন রান্না স্যার! রান্ধে আকবরের বউ। খাইলে আপনে হাত চাটবেন স্যার!
আকবরের বউ? মানে যোধাবাঈ? মনে মনে হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম- আকবরটা কে?
- আমার পোলা স্যার। পোলার বউরের রান্ধনের কতা কইতাছিলাম স্যার। খুব সোন্দর রান্না।
- আচ্ছা। তুমি তাহলে ছেলের সাথেই থাকো?
- জ্বি স্যার। এরাই তো আছে আমার দুনিয়ায়।
- ভালো কথা। জলিল মিয়া, তুমিও খেয়েদেয়ে চলে যাও। কালকে দুপুরে অফিসে এসে চাবি নিয়ে রান্নাবান্না করে যেয়ো। রাত্রেবেলা আমি গরম করে নিতে পারবো।
পরেরদিন সকালেই দেখি জলিল মিয়া এসে হাজির। সাথে একটা খুরপি নিয়ে এসেছে! এসেই বাগানে সমানে কোপাকুপি করছে।
আমাকে দেখামাত্রই নিয়ে এলো এককাপ ধোঁয়া ওঠা চা।
বাহ! এ তো ভালোই আরাম হলো! সকালবেলা আমিনের হোটেলের পরোটা ভাজি খাওয়া লাগছে না, চিন্তা করেই সুখ লাগছে।
এইভাবেই জলিল মিয়া পার্মানেন্ট হয়ে গেলো।
তার একটাই সমস্যা, কাজ করার সময় মুখ অনর্গল চলে। কথা বলার বিষয় একটাই- তার ছেলে আকবর। আর তার ছেলের বউ। আমি অর্ধেক শুনি, বাকি অর্ধেক শুনি না। সন্ধ্যাবেলায় আমি আপনমনে বই পড়ি, আর জলিল মিয়ার মুখ চলতেই থাকে। ইচ্ছা করলেই তাকে চুপ করিয়ে দেয়া সম্ভব, কী দরকার? ঘরের মাঝে একটা টিভি চললেও কেমন যেন জীবন্ত ঘর মনে হয়। জলিল মিয়া না হয় সেই টিভির কাজই করলো!
মোটামুটি মাসতিনেকের মধ্যেই আমি আকবরের সব বৃত্তান্ত জেনে ফেললাম। ক্লাস এইট পাশ করার পর আর পড়তে পারেনি। মা মরা ছেলে তো, এদের আর পড়াশোনা হয় না। তবে লেগে থাকলে এইটে বৃত্তি পেতো নির্ঘাত।
এ ছেলের অনেক গুণ! মাঝে চায়ের স্টল দিয়েছিলো। আকবরের হাতের চা খাবার জন্য দূরদুরান্ত থেকে লোক আসতো। বিশেষ করে গুড়ের চা। কিছু মস্তান এসে স্টলটা উঠিয়ে দিলো!
কিছুদিন একটা দোকান ভাড়া নিয়ে ভাঙ্গারির ব্যবসা করেছে। তাতেও পয়সা কামিয়েছে ভালোই। ভাঙ্গারির দোকানটা ফুলে-ফেঁপে বড় হওয়াতে দোকানের মালিক নিজেই দোকান নিয়ে নিয়েছে।
এখন আকবর রিকশা চালায়। এ ছেলে যেন এক পরশপাথর! রিকশা চালিয়েই সে ভালো টাকা জমিয়ে ফেলেছে। চেষ্টা করছে যদি আরও কিছু টাকা ধার করে একটা সিএনজি কেনা যায়। তারপরেই তাদের সংসারে কেবল সুখ!
আর আকবরের বউ? আহ! এই মেয়েটা একটা লক্ষ্মী! শ্বশুরের এমন সেবা কেউ করতে পারে জলিল মিয়া আগে চিন্তাও করে নাই। সকাল বেলাতেই তার ওযুর পানি তৈয়ার থাকে! রাত্রে সে না ফেরা পর্যন্ত ছেলে আর ছেলের বউ বসে থাকে। কখন বাজান আসবে?
মেয়েটার রান্নার হাতও মাশাআল্লাহ। খুব তাড়াতাড়িই জলিল মিয়া তার বাড়িতে আমাকে দাওয়াত দেবে। এমন রান্না আমাকে না খাওয়ালেই নয়! গচিহাটার মোড়ে আকবরের কথা বললেই সবাই একনামে চেনে। বিখ্যাত সন্তানের পিতা!
আমি অবাক হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলাম- তাহলে তুমি এইখানে এসে পড়ে থাকো কেন জলিল মিয়া? তোমার তো বয়স হয়েছে। যত্ন-আত্তি দরকার!
জলিল মিয়া হেসে বলেছে- ঘরে কি আর ভাল্লাগে স্যার? কাজেকর্মে থাকলে মন ভালা থাকে।
এইভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিন। হঠাৎ করেই জলিল মিয়া আসা বন্ধ করে দিলো। একদিন, দুইদিন। মোবাইলও বন্ধ। কী ব্যাপার, এমন তো হয় না? ঝড়-বৃষ্টি কোনসময়ই তো তাকে কামাই দিতে দেখলাম না!
চতুর্থদিন কী মনে হলো হঠাৎ, গাড়িটা বের করে গেলাম গচিহাটার মোড়ে। ঐখানে আকবরের নাম বললেই সবার চেনার কথা। এসিল্যান্ডের গাড়ি দেখে সবাই একটু থমকে গিয়েছে। আমারই ভুল। এই এলাকায় সরকারি গাড়ি এনে সবাইকে ভড়কে দেয়ার দরকার ছিলো না।
আমি নেমে জলিল মিয়ার নাম বললাম। ঐভাবে কেউ বলতে পারলো না। আকবরের কথা বললাম, এবার কাজ হলো। এক-দুইজন বলে উঠলো- ঐ আকবইরা? ঐ জানোয়ারটার কতা কইতাছেন?
কী বলে এইসব? আকবর কেন জানোয়ার হতে যাবে? কত কর্মঠ, পিতৃভক্ত ছেলে? কী করেছে সে?
যা শুনলাম, অবিশ্বাস্য! আকবর কোনকালেই কিছু করতো না। ভাঙ্গারির দোকানে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলো জলিল মিয়া, ওখান থেকে চুরি করে নেশা-ভাং করায় চাকরিটা যায়। এরপরে নেশার উপরেই সারাদিন থাকে। জলিল মিয়া বাইরে রান্নাবান্না করে যা পায়, তাই দিয়ে এদের সংসার চলে! ছেলের বউটাও নাক আরেক দজ্জাল! উঠতে বসতে শ্বশুরকে খোঁটা দেয়, আরও বেশি টাকা আনে না কেন সেইজন্য। এমনকি বাসায় থাকলে ভাতও দেয় না অনেকসময়!
কয়েকদিন আগে ঝগড়াঝাটি একটু বেশিই লেগেছিলো। সেইসময়ে নেশাসক্ত আকবর একটা চালুন কাঠ দিয়ে বাড়ি মেরেছে জলিল মিয়ার মাথায়। এতোই রক্ত বেরিয়েছে, সবাই ভেবেছিলো মরেই যাবে। হসপিটালে নেয়া হয়েছে, মরেনি লোকটা।
পুলিশ এসে কয়েকবার খুঁজে গেছে আকবর আর তার বউকে। ওরা পালিয়ে রয়েছে।
আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইলাম। দিনের পর দিন তাহলে কোন আকবর আর তার বউয়ের গল্প শুনিয়ে গেছে জলিল মিয়া?
আমি হসপিটালে যাবার জন্য গাড়িতে উঠলাম। তখনই ডিসি সাহেবের ফোন। ভূমিমন্ত্রী কালকে নাকি জেলায় আসবেন, আজকেই জরুরী প্রস্তুতি মিটিং। এক্ষন যেতে হবে! মন্ত্রী বলে কথা! আমি গাড়ি ঘুরিয়ে জেলা শহরের পথ ধরলাম।
...
দুইদিন পরের কথা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি টেবিলে গরম চা! জলিল মিয়া বাগানে নিড়ানি দিচ্ছে!
গতকাল মন্ত্রী সাহেবের ভিজিটে ভুলেই গিয়েছিলাম জলিল মিয়াকে দেখতে যাবার কথা। আজকে যেতাম, তার আগেই এই লোক এসে হাজির!
আমি কিছু বলার আগেই জলিল মিয়া বলে উঠলো- কইয়েন না স্যার। হেইদিন বাড়ি ফিরোনের পরেই মাতাডা এমুন চক্কর দিয়া উঠলো, ঠাস কইরা পইরা গেলাম সিঁড়ির উপ্রে। মাতাডা গেলো ফাইট্যা। তাও তো বালা যে আকবরের বউ আছিলো তহন, তাড়াতাড়ি আকবররে ডাইক্যা আনলো। হেয় রিকশায় তুইল্যা নিয়া গেলো হসপিডালে। পুলা আর পুলার বউয়ের সেবাযত্নে অহনও বাইচ্যা আছি। আকবরের বউ ডেইলি মুরগির স্যুপ রাইন্ধা খাওয়াইতো।
আমার মুখ থেকে অনেক কথাই আসতে চাচ্ছিলো। নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। কী দরকার তার স্বেচ্ছা বুদবুদটাকে ভেঙে। ওটা ছাড়া এরপরে সে আর কী নিয়েই বা কথা বলবে?
আস্তে করে বললাম- সত্যিই তুমি খুব ভাগ্যবান, জলিল মিয়া!
জলিল মিয়া আস্তে করে মাথা ঝাকিয়ে বললো- জ্বি স্যার।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন