ফোনের আওয়াজে সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল সফা সাহেবের। একের পর এক নোটিফিকেশনে কাঁচা ঘুম ছেড়ে উঠে বসতে বাধ্য হলেন তিনি।
ব্যাপারটা কী?
মনে মনে ভাবতে ভাবতে মোবাইলের লক খুললেন।
ফেইসবুকে একটা ছোট গল্প লেখার গ্রুপ চালান সফা সাহেব। সেখানেই কেউ একটা নতুন গল্প পোস্ট করেছে যাতে একের পর এক গ্রুপ মেম্বাররা রিপোর্ট করছে।
এটা একটি সাধারণ ঘটনা। প্রায়ই এর ওর গল্পে গ্রুপ মেম্বাররা রিপোর্ট করে। কখনও অশ্লীলতা আবার কখনও সহিংসতাকে কারণ দেখিয়ে। তখন সফা সাহেব যাচাই বাছাই করে দেখেন যে কার অভিযোগ কতটা যুক্তিযুক্ত। তবে যে হারে রিপোর্ট আসছে, তাতে সফা সাহেব বুঝতে পারছেন এটা বড় দুটা কারণের যে কোনো একটা হবে। একটা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আরেকটা…
ঠিক যা ভেবেছিলেন তাই। অ্যাডমিন প্যানেলে সবগুলো রিপোর্টের মুল বক্তব্য: 'ধর্মানুভূতিতে আঘাত'।
সফা সাহেব বেশ কয়েকবার গল্পটা উলটে-পালটে পড়ে দেখলেন।
মাইনরিটি গ্রুপদের অধিকার নিয়ে নিতান্তই সাদামাটা একটি গল্প । যেখানে লেখক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া অত্যাচারকে তুলে ধরতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বিমুখী আচরণকে বর্ণনা করেছেন। তার ওপর দেখা যাচ্ছে লেখক নিজে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য।
ব্যস! আর পায় কে? এতেই দলে দলে রিপোর্ট আসা শুরু হয়ে গেছে।
খুব বিরক্ত লাগছে সফা সাহেবের। রিটায়ার্ড করার আগে জীবনের একটি বিশাল অংশ তিনি সাংবাদিকতা করে কাটিয়েছেন। মানুষজন আজকাল এত অসহনশীল হয়ে গেছে! ভাবলেন তিনি। আসলে সারা জীবন বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সফা সাহেব অন্য কারও বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করার চিন্তায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আর গল্পের কাজই যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে বুঝতে চেষ্টা করা, এটা তো ঘরের বাচ্চা কাচ্চারাও জানে!
অস্বস্তি কাটিয়ে বাস্তবে ফেরত আসেন সফা সাহেব। সাংবাদিক হওয়ার কারণেই হয়তো তিনি এই পরিস্থিতির গুরুত্ব খুব ভালো করে বোঝেন। তাই তিনি ভালো ভাবে জানেন যে সময় মত অ্যাকশন না নিলে তার জন্য ঘোর বিপদ অপেক্ষা করছে!
লেখক-গল্প-গ্রুপ সব তো যাবেই, তার ওপর অনলাইন নিউজ পোর্টালরা এই নিউজ পিক করলে আগামীকাল সকালের মধ্যে সফা সাহেবের ফাঁসী চাই কর্মসূচী শুরু হয়ে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই।
এসব ভেবে আঁতকে ওঠেন সফা সাহেব। গলা শুকিয়ে আসে। তবে সময় থাকতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরকম সময়ের জন্যই আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
গ্রুপ রুলগুলোর মধ্যে পরিষ্কার করে বলে দেয়া আছে যে কোন রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত কিংবা ধর্মীয় আক্রমণ কিংবা মানহানী ঘটে এমন কোন লেখা লিখলে গল্প তো ডিলিট করা হবেই, সাথে লেখককেও গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।
রিপোর্টের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। তিনি জানেন তার কী করতে হবে।
গল্পটি ডিলিট করার আগে লেখককে একটা নোট লিখতে বসলেন সফা সাহেব। যদিও নোট লেখাটা ম্যান্ডাটরি না, তবুও ফেইবুকে অপশনটা দেয়া থাকায় খানিকটা হয়ত নিজের ভেতরের সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা থেকেই লিখতে বসলেন নোট।
সফা সাহেব নোটটি তে যা লিখলেন তা হচ্ছে:
লেখক যে নিয়ম ভেঙ্গেছেন তা অমার্জনীয়। তবে সাংবাদিক এবং একজন লেখক হিসাবে তিনি লেখকের সাথে (অফ দা রেকর্ড) একাত্মতা প্রকাশ করছেন। তিনি লেখককে জানান যে আর কেউ বুঝুক না বুঝুক তিনি লেখকের বক্তব্য বুঝতে পেরেছেন। তবে সব কিছুরই তো একটা সীমা-পরিসীমা আছে। লেখকের উন্নতি কামনা আর ভবিষ্যতে পাব্লিক প্ল্যাটফর্মে লেখককে আরো সাবধানতার সাথে গল্প লেখার উপদেশ দিয়ে নোটটি শেষ করেন সফা সাহেব।
নোটটি শেষ করে তিনি ‘রিমুভ পোস্ট ও ব্লক ইউজার’ বাটনটি প্রেস করলেন। গল্পটি মুছে যাওয়ার পর পরই একটা স্বস্তির নিশ্বাস বের হলো সফা সাহেবের ভেতর থেকে।
এখন বেশ ভারমুক্ত লাগছে। মনে মনে ভাবলেন তিনি। একটু পর বাজারে যেতে হবে, ইফতারির প্রস্তুতি নিতে হবে, কাজের লোকটাও আসেনি আজকে।
ভার্চুয়াল জগত থেকে বের হয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সফা সাহেব। তার বিরক্তি চলে গেছে, মন এখন অনেকটাই প্রশান্ত।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন