ছেলেবেলায় আমি তো একটু দুষ্টু ছিলুম। সবাই বলত, ভীষণ দুষ্টু। একদণ্ড স্থির হয়ে বসতে জানে না। আমার মা বলতেন, ‘ওইটাকে নিয়েই হয়েছে আমার ভীষণ জ্বালা। সারাদিন আমার এতটুকু শান্তি নেই।’
আমি লক্ষ্মী হওয়ার চেষ্টা যে করতুম না তা নয়। বইপত্র নিয়ে বসতুম। দু-এক পাতা হাতের লেখা করতে না করতেই মাথাটা কেমন হয়ে যেত। নীল আকাশে নিলুর ঘুড়ি লাট খাচ্ছে, পাশের মাঠে প্রতাপ আর গোপাল ডাংগুলি খেলছে। মাথার আর কী দোষ!
আমরা তখন খুব একটা পুরোনো বাড়িতে থাকতুম। বাড়িটার দুটো মহল ছিল বারমহল আর অন্দরমহল। অনেক ঘর। চওড়া, টানা-টানা বারান্দা। তিনতলার ছাতটা ছিল বিশাল বড়। ইচ্ছে করলে ফুটবল খেলা যেত। সেখানে পাশাপাশিদুটো ঘর ছিল। কেউ একটু নির্জনে থাকতে চাইলে থাকতে পারত। একটা ঘরে থাকত আমার দিদির যত খেলনা—বড় পুতুল, ছোট পুতুল। দিদির বন্ধুরা বিকেলে এসে খেলা করত। আমি মাঝে মাঝে এসে দুষ্টুমি করতুম। দিদি তখন তার বন্ধুদের বলত, ‘দ্যাখ, ভাই কী বানর ছেলে!’ দিদি আমাকে বানর বললে আমার খুব ভালো লাগত। আমি দুষ্টুমি করলে দিদিরও খুব ভালো লাগত মনে হয়। মাঝে মাঝে প্রবল লড়াই হত। তখন দিদি বলত, ‘দেখবি, যখন কোথাও চলে যাব তখন বুঝবি ঠেলা। কে তোকে গরমের ছুটিতে আচার তৈরি করে খাওয়ায় দেখব।’
রোজ রাত্তিরে বাড়িতে একটা কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হবেই হবে। বাবা অফিস থেকে এসে আমাকে পড়াতে বসবেন। সারাদিনের লাফালাফিতে ঘুমে আমার চোখ দুলে আসবে। জানা জিনিসও ভুল করব। বাবা পরপর যোগ করতে দেবেন। একটাও ঠিক হবে না। ‘উইক’ বানানটা ভুল হবেই হবে। দুর্বলটা সপ্তাহ হবে, সপ্তাহটা দুর্বল। বাবা মাকে ডেকে বলবেন, ‘সারাটা দুপুর তুমি করো কী? ছেলেটাকে একটু দেখতে পারো না!’
মা তখন ফিরিস্তি দেবেন ছেলে এই করেছে, ওই করেছে। বাবা গম্ভীর মুখে উঠে গিয়ে লম্বা বারান্দায় পায়চারি করবেন আর আক্ষেপ করবেন, ‘নাঃ, হল না, কিছুই হল না। ফেলিওর, ফেলিওর।’ রাতে খেতে বসে বলবেন, ‘কালিয়া, পোলাও খেয়ে কী হবে, ছেলেটাই যার মানুষ হল না!’
এত কাণ্ডতেও আমার কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ব। একসময় দিদি এসে আস্তে আস্তে ডাকবে, ‘চল, খাবি চল। কাল থেকে একটু ভালো করে পড়বি। তোকে বকলে আমার খারাপ লাগে।’ কোনও-কোনওদিন দিদি আমাকে খাইয়ে দেয়।
এইভাবেই চলতে চলতে গরমের ছুটি পড়ে গেল। একদিন দুপুরবেলা সবাই ঘুমোচ্ছে। আমিও মায়ের পাশে শুয়েছিলুম। দিদি কয়েকদিনের জন্য মামার বাড়ি গেছে। শুয়ে থাকতে থাকতে উঠে পড়লুম। ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। মা যে-ঘরে, তার পাশের ঘরে একটা টেনিস বল নিয়ে কেরামতি করছি। এখন থেকে প্র্যাকটিস না করলে, বড় হয়ে পেলের মতো খেলোয়াড় হব কী করে! বাবাই তো বলেছেন, ‘সাধনাতেই সিদ্ধি।’
প্রথমে সাবধানেই সবকিছু করছিলুম, হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মারলুম এক শট। বাবার বইয়ের আলমারির সব কাচ ভেঙে চুরমার! পাশের ঘর থেকে মা দৌড়ে এলেন। ধড়াধ্বাম। মারাটাই আমাকে উচিত ছিল; কিন্তু বাবা বলেছেন, ‘একদম গায়ে হাত তুলবে না। ভয় ভেঙে যাবে। অন্য শাস্তি দেবে।’
মা আমাকে টানতে টানতে ছাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে দিলেন, ‘থাকো এইখানে, বাবা এলে তোমার বিচার হবে। বড্ড বেড়েছ তুমি। নির্জলা উপবাস।’
চারপাশে খাঁ-খাঁ করছে রোদ। দুপুরের নীল আকাশে গোটাকতক চিল উড়ছে। জানলার ধারে বসে আছি মনখারাপ করে। বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আলমারির সব কাচ চুর হয়ে গেল। খুব অন্যায় হল। কবে যে আমি মানুষ হব! এইসব ভাবছি। ভীষণ গরম। একটুও হাওয়া নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। শেষকালে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। গায়ে কেউ হাত রাখল। ধড়মড় করে উঠে বসলুম। সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। আকাশে তখনও শেষবেলার রোদ। ভয়ে কুঁকড়ে গেলুম। বাবার মুখের দিকে তাকালুম, হাসছেন। স্বপ্ন দেখছি না তো! দরজার দিকে তাকালুম। হাটখোলা। তখন আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘বাবা! আজ আপনি এত তাড়াতাড়ি এলেন?’
কোনও উত্তর নেই। বাবা হাসছেন। কেবল হাসছেন।
আমি বললুম, ‘বাবা, আমি সব কাচ ভেঙে ফেলেছি। আমি খুব অন্যায় করেছি বাবা।’
বাবা তবু হাসছেন। মুখে এতটুকু রাগ নেই। আমি তখন প্রণাম করার জন্য বাবার পা স্পর্শ করতে গেলুম, দেখি কেউ কোথাও নেই। ঘর ফাঁকা। দরজাটা হাটখোলা। খুব জোর হাওয়া ছেড়েছে গ্রীষ্মের বিকেলের।
আমি ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেলুম! স্বপ্ন দেখেছি। নিশ্চয় স্বপ্ন। সাহস একটু ফিরে পেতেই এক ছুটে নীচে। দেখি মা রান্নাঘরে ঘুগনি তৈরি করছেন। আমাকে দেখে অবাক, কী করে এলি, কে তোকে দরজা খুলে দিল?’
বাবা ঘুগনি খেতে ভালোবাসেন, মা সেই জন্যই করছেন। কাচ ভাঙা নিয়ে ভীষণ কাণ্ডটা হয়ে যাওয়ার পরেই ঘুগনি এসে অবস্থাটাকে সামাল দেবে।
মাকে আমি সব কথা বললুম।
‘তোর বাবা এসেছে? কোথায়?
‘দরজা তো বাবাই খুলে দিলেন।’
সদরের দরজা আমি খুলে না দিলে আসবে কী করে?
গোটা বাড়িটা সার্চ করা হল। বাবার পড়ার ঘর, শোওয়ার ঘর, ঠাকুরঘর, বাথরুম। আলনাটা দেখা হল। সেখানে বাবার অফিসের জামাকাপড় ছাড়া নেই। বাড়িতে ফিরে যা পরবেন। সেইগুলোই গুছোনো রয়েছে।
আমরা তখন পাশের বাড়িতে গিয়ে বাবার অফিসে ফোন করলুম। অফিসের বড়কর্তার সঙ্গে মা কথা বললেন। জানা গেল। বাবা অনেক আগেই সাইটে গেছেন। সাইট মানে উলুবেড়িয়ায়। সেখানে কোম্পানির নতুন ফ্যাকট্রি তৈরি হচ্ছে।
মা খুব অনুরোধ করলেন, ‘আপনি নিজে একটু খবর নিন। মনে হচ্ছে, একটা কিছু হয়েছে।’ ফোন নম্বরটা তাঁকে দেওয়া হল। টেলিফোনটাকে ঘিরে আমরা বসে আছি। বসেই আছি। ওদিকে মায়ের ঘুগনি পুড়ে ছাই। এক ঘণ্টা পরে ফোন বাজল।
কনস্ট্রাকশন সাইটে একটা লোহার বিম ক্রেন ছিঁড়ে বাবার মাথায় পড়ে গেছে। তখন বেলা ঠিক সাড়ে চারটে। আমি এমন বোকা ছিলুম, সেই খরবটা পেয়েই আমি নাকি মাকে বলেছিলুম, ‘জানো, আমি কাচ ভেঙেছি বলে বাবা একটুও রাগ করেননি। শুধু হাসছিলেন।’
তখন আমার বয়েস ছিল আট। আজ আশি। আমি আর কোনওদিন কিছু ভাঙিনি। না কাচ, না সম্পর্ক, না পরিবার, না জীবন। বাবার সেই হাসি-হাসি মুখের হাসি যাতে কখনও না মিলিয়ে যায়, সেই চেষ্টা আমি করেছি।
[সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়: জনপ্রিয় বাঙালি লেখক, মূলত রম্য রচনার জন্য খ্যাত। বেশ কিছু উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস 'লোটাকম্বল', যা দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন