টলস্টয়ের কালজয়ী গল্প 'সাড়ে তিন হাত জমি'

৪৩১৩ পঠিত ... ১৩:৪০, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২০

বড় কোন ব্যবসায়ীর স্ত্রী, থাকে শহরে। ছোট বোন কৃষকের স্ত্রী, থাকে গ্রামে। বড় বোন এসেছে ছোট বোনের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। চা খেতে খেতে দুই বোন গল্প করছিল। বড় বোন বলছিল শহরে থাকার সুযোগ সুবিধার কথা। বেশ বাড়িয়ে বলা। যাকে বলে গল্প দেওয়া। ছোট বোনও গ্রামে থাকার ভালো দিকগুলোর কথা বলে।

ছোট বোনের স্বামী পাখোম সব শুনছিল। সে বলল ‘কথা ঠিক। ছোট বেলা থেকেই মাটির কোলে পড়ে আছি। তাই বলে তেমন কোন অভাব নেই। অভাব কেবল একটিই, আমার জমি খুব কম। জমি যদি পাই তা হলে কাউকে পরোয়া করব না, স্বয়ং শয়তানকেও না।’

শয়তান শুনে বেশ খুশি হল। ভাবল, একে নিয়ে মজার একটা খেলা খেলবে। আগে অনেক জমি দেবে, তারপর কেড়ে নেবে।

 

পাখোমের জমি ক্রয়

পাখোমের বাড়ির কাছে একজন মহিলা বাস করতেন। তিনি ছিলেন ২৪০ একর জমির মালিক। ভালো মানুষ তিনি। প্রতিবেশীদের সাথে তার সম্পর্কও ভালো। অবসরপ্রাপ্ত একজন সৈনিক-কে জমিদারির ওভারশিয়ার নিযুক্ত করলেন তিনি। ওভারশিয়ার লোকটি ভালো নয়। নানা ছল ছুতায় কৃষকদের জরিমানা করে সে। কারো গরু, ঘোড়া, বাছুর জমিরাতে ঢুকলেই সে জরিমানা করে, অত্যেচার করে। এইে মধ্যে শোনা গেল জমিদার মহিলা তার সব জমি বিক্রি করে দেবেন। আর ওভারশিয়ার কিনে নেবে তার সম্পত্তি। কৃষকেরা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে। শেষে সবাই মিলে বেশী দামে জমি কেনার প্রস্তাব দেয় মহিলাকে। মহিলা রাজি হল। কিন্তু শয়তানের ইন্ধনে তারা একত্রিত হতে পারছিল না। তাই যা যার মতো জমি কেনার সিদ্ধান্ত হয়।

পাখোমের ১০০ রুবল আগেই ছিল। তারপর একটি গাধার বাচ্চা ও অর্ধেক মৌমাছি বিক্রি করল সে। ছেলেকে পাঠিয়ে দিল চাকরীতে। এভাবে বাকি অর্ধেক টাকা যোগাড় হল। সব টাকা জুটিয়ে সে তিরিশ একর জমি ও একটি ছোট বাগান ক্রয় করল। বেশ, পাখোম হয়ে গেল জমির মালিক। তারপর নতুন জমিতে বীজ বুনল, ফসল ফলল প্রচুর। এক বছরের মধ্যেই সে মহিলার সমস্ত টাকা শোধ করে দিল। এখন সে জমির পুরো মালিক। গভীর যত্ন আর মায়া দিয়ে ফসল ফলাত। ঘোড়ায় চড়ে সে জমিজমা দেখতে গিয়ে আনন্দে আভিভূত হয়। তার জমির ঘাসগুলো, ফলগুলো-সবই যেন আলাদা। মন তার আনন্দে ভরে উঠে।

 

পাখোমের বাড়িতে অতিথি চাষি 

একজন চাষি পাখোমের বাড়িতে আসে। পাখোম তাকে থাকতে দেয়, খেতে দেয়। সে জানায়, ভলগার ওপার থেকে সে এসেছে। সে আরো বলে, সেখানে নতুন একটি পত্তনি হয়েছে। গ্রাম্য পঞ্চায়েতে নাম লেখালেই ১০০ একর জমি পাওয়া যায়। আর সে কি জমি। সেনার টুকরো। লোকটি আরো বলে, একজন গরিব চাষি এল। কাজ করার দুখানা হাত ছাড়া কিছই ছিল না। এবার সে ১০০ একর জমিতে শুধু গমই ফলিয়েছে। গত বছর শুধু সে গম বেচে সে আয় করেছে ৫০০০ রুবল। শুনে পাখোম উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার বর্তমান সহায় সম্পত্তি দিয়ে সে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারল না। সুতারাং গরম পড়তেই সে বেরিয়ে পড়ল। ভলগা নদীতে ষ্টিমারে চড়ে পৌছাল সামারা। সেখান থেকে প্রায় ২৭৪ মাইল পায়ে হেঁটে পৌচল গন্তব্যে। গিয়ে দেখল, যা সে শুনেছে সবই ঠিক। অতি অল্প দামে উর্বর জমি কেনা যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রতি একরের দাম মাত্র ১.৫০ রুবল। পাখোম বাড়িতে ফিরে জমিজিরাত বিক্রি করে দেয়। বসন্তের শুরুতে সে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সে নতুন দেশে পাড়ি জমায়।

 

নতুন দেশে পাখোম

নতুন দেশে এসে পাখোম এ সমাজের সদস্য হয়। আর সদস্য হওয়াতে সে লাভ করে ১০০ একর জমি। গো-চারণ ভূমি তো আছেই। এখানে জীবনযাপন আগের চেয়ে দশগুণ ভালো। পাখোম নতুন নতুন জমি কেনে। ফসল বোনে। লাভ হয় প্রচুর। একবার তো ১০০০ একর জমিই মাত্র ১৫০০ রুবলে কিনে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু এ সময় একজন মহাজন বাড়িতে এসে উঠে। সে জানায় অনেক অনেক দুরের বাসকিরদের দেশ থেকে সে এসেছে। সেখানে জমির দাম খুবই সস্তা। ১০০০ রুবল দিয়ে সে ১০,০০০ একর জমি কিনেছে। সে পাখোমকে জমির দলিলটিও দেখাল। লোকটি আরো জানায় যে, সেখানকার মানুষগুলো একেবারে ভেড়ার মতো সরল। আপনি অনায়াসে যে-কোনো জিনিস তাদের কাছ থেকে বাগিয়ে নিতে পারেন। সুতারাং পাখোম কেন ১৫০০ রুবল দিয়ে ১০০০ একর জমি কিনবে? ঐ রুবল দিয়ে সে তো একজন জমিদারই বনে যেতে পারে।

 

বাসকিরদের দেশে পাখোম

একজন মজুর সঙ্গে নিয়ে বাসকিরদের দেশে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করল পাখোম। সঙ্গে নিল কিছু উপহার। প্রায় ৩৩২ মাইল পথ হেঁটে গেল তারা। তারপর সাত দিনের দিন বাসকিরদের তাঁবুতে গিয়ে হাজির হল। মহাজন যেমন যেমন বলেছিল সব ঠিক সেরকমই। খোলা প্রান্তরের নদীটির তীরে এরা বাস করে। ঘরবাড়ি নেই। আছে চামড়ার ছাউনি দেওয়া গাড়ি। এর মধ্যেই তাদের বসবাস। এরা জমি চাষ করে না, ফসল ফলায় না। জমিতে চড়ে বেড়ায় ঘোড়া, গরু, মহিষ। ঘোড়ার দুধ এদের প্রিয় খাদ্য। ভেড়ার মাংসও খায। দুধ থেকে তৈরী কুসিম তাদের পানীয়। এরা সহজ-সরল, দয়ালূ ও হাসিখুশি। পাখোমকে দেখেই তারা গাড়ি থেকে নেমে অভ্যর্থনা জানাল, আদর-অপ্যায়ন করল। পাখোমও তাদের উপহার দিল। বিনিময়ে তারা জানতে চাইল যে পাখোম কি চায়? তারা জানল, পাখোম জমি কিনতে চায়। শুনে তারা অতিথির প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হল। তারা বলল, ‘আপনি যত জমি চান তত জমিই আমরা বিক্রয় করতে রাজি‘। এ সময় তাদের নেতা স্টার্শিনা এসে সবকিছু শুনলেন। তিনিও জানালেন, পাখোম যত খুশি জমি ক্রয় করতে পারে। জমির দাম দিনপ্রতি ১০০ রুবল। ‘দিনপ্রতি‘ ব্যাপারটা পাখোম বুঝে উঠতে পারল না। নেতা জানালেন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যতটা জমি ঘুরে আসতে পারবে ততটুকু জমির মূল্য।

 

পাখোমের স্বপ্ন

পাখোম শুয়েছিল পাখির পালকের বিছানায়। খুব আরামদায়ক। কিন্তু তবুও তার ঘুম হয়নি। অনেক জমির মালিক হতে যাচ্ছে সে। ২০,০০০ একর তো বটেই। চিন্তায় উত্তেজনায় সারা রাত সে ঘুমোতে পারল না। কিন্তু ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়ল। একটা স্বপ্নও দেখল। বাইরে যেন কার হাসির শব্দ। স্বপ্নেই সে বেরিয়ে গেল। দেখল স্টার্শিনা। একটু এগিয়ে দেখল লোকটি স্টার্শিনা নয়, সেই মহাজন। এই লোকটিই এখানে আসতে বলেছিল। কিছু জিজ্ঞসা করতেই লোকটি যেন বদলে গেল। এখন সে ভলগান ভাটি থেকে আসা সেই চাষি। সব শেষে পাখোম দেখল, এ হচ্ছে একটি শয়তান; মাথায় শিং, পায়ে খুর। বিকট শব্দ করে সে হাসছে। অদুরে একটি লোক পড়ে আছে। তার মুখ কাগজের মতো সাদা। লোকটির দিকে তাকিয়ে পাখোম দেখল, লোকটি সে নিজে। তার দম যেন আটকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে গেল তার ঘুম। চারিদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। এখনই সূর্য উঠবে। তাকেও জমি-দখলের দৌড় শুরু করতে হবে।

 

পাখোমের প্রয়োজনীয় জমি

শিকান নামে একটি গোল পাহাড়। এই পাহাড়ের উপর স্টার্শিনা তার টুপি রাখল। টুপির মধ্যে পাখোমের ১০০ রুবল। এখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। পাখোম দেখল সবই উর্বর জমি, সোনার টুকরো। অনেক চিন্তা করে সে সূর্য-উদয়ের দিকে যাত্রা করল। আস্তেও নয়, খুব জোরেও নয়। ১১৬৬ গজ যাওয়ার পর সে একটু থামল। একটি খুঁটি পুতল। এখন সে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে লাগল। থেমে আর একটি খুঁটি পুতে দিল। সূর্যের দিকে তাকাল একবার। গোল পাহাড়টার উপর আলো পড়েছে। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর উপরও আলো পড়েছে। হিসেব করে দেখল, প্রায় সাড়ে তিন মাইল পথ হাঁটা হয়েছে। আরো সাড়ে তিন মাইলে হেঁটে সে বাঁ-দিকে মোড় নেবে। শরীর তার গরম হয়ে উঠেছে। কোট খুলে ফেলল, জুতাও। হাঁটতে তার খুব ভালো লাগছিল্‌ তাই ভালো ভালো জমি দেখে বাঁক-মোড় নিতে লাগল।

গোল পাহাড়টা আর দেখা যায় না। পাখোম ভাবল: মোড়টা বেশ বড় হয়েছে নিশ্চয়। তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। সে ক্লান্ত বোধ করছে। সে খানিকটা পানি খেল। একটি খুঁটিও পোতা হল। পথে বড় বড় ঘাস।

ঠিক দুপুরে সে সামান্য রুটি খেল। দাঁড়িয়ে সামান্য জিরিয়েও নিল। মাটিতে সে বসল না। কারণ বসলে শুতে ইচ্ছে হবে, আর শুলে গুমিয়ে পড়তে পারে। রুটি খাওয়ার পর হাঁটতে সুবিধা হল। কিন্তু সামান্য পরেই তার শরীর ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। কিন্তু শরীরকে আসকারা দিলে চলে না। কেননা সামান্য কষ্টেই তার অনেক লাভ।

সাড়ে ছয় মাইল পথ সে পেরিয়েছে। তার পরও কিছু উর্বর জমি ছেড়ে আসতে পারেনি। কি করে ছাড়ে। চমৎকার তিসি হবে এ জমিগুলোতে। গোল পাহাড় থেকে ১০ মাইলে পথ দুরে এসেছে সে। আর পশ্চিম আকাশে সূর্য অনেকটা হেলে গিয়েছে। এখন তাকে ফিরতে হবে। পাখোম গোল পাহাড়ের দিকে রওনা দিল। অথচ সে ফিরতে পেরেছে ১ মাইলের চেয়ে সামান্য বেশী। এ্‌খন সে আর কোন বাঁক নিচ্ছে না। সোজাসুজি হেঁটেও যে যেন এগুতে পারছে না। জুতা সে খুলে ফেলেছিলে অনেক আগেই। একন খালি পা কেটে ছিঁড়ে গিয়েছে। হাঁটতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। শরীর কাঁপছে। পা কাঁপছে। একটু বিশ্রামের বদলে সে সব কিছু দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিশ্রাম করলে চলবে না। তাই কে যেন চাবুক মেরে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কত পথ বাকি। অথচ সে মৃত প্রায়। এত পথ সে পেরিয়ে এসেছে। কি করে তা ফিরে যাবে।

কিন্তু ফিরতে তাকে হবেই। সব অর্থ, সব পরিশ্রম বৃথা যেতে পারে না। পা ফেটে রক্ত ঝরছে। তবুও সে দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। তবু যেন এগুতে পারছে না। কোট, জুতা, ফ্লাস্ক, টুপি সব চুড়ে ফেলে দিল। তবুও দৌড়াতে তার দারুন কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর কে যেন হাপড় টানছে। হৃদপিন্ডের ভিতরে মারছে হাতুড়ি। পা দটি দেহের ভার সইছে না, ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে।

জমির কথা সে ভুলে গেল। নিজেকে বাঁচানোই এখন একমাত্র চিন্তা। সূর্য এখন আস্ত যাওয়র পথে। গোল পাহাড়ের লোকগুলো তাকে ডাকছে। চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। সে শেয়ালের চামড়ার টুপিটি মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল। তার ভিতরে টাকা। তার পাশে দাঁড়িয়ে স্টার্শিনা। তার স্বপ্নের কথা মনে হল। তবুও সে পৌছাতে চায়। নিজেকে সে খুন করেছে। তবুও দৌড় বন্ধ করল না। সূর্য যখন আস্ত গেল তখন সে পাহাড় ছুঁয়েছে। একটি মুমূর্ষ জন্তুর মতো সে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে টুপিটি স্পর্শ করল। স্পর্শ করতে করতে সে নিচে পড়ে গেল।

স্টার্শিনা চিৎকার করে উঠল, ‘হায় যুবক, অনেক জমি তুমি পেলে বটে।’ পাখোমের মজুর ছুটে গেল তার কাছে। তাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল। তখন তার মুখ দিয়ে রক্তের ধারা বইছে।

পাখোম মারা গেল। স্টার্শিনা হাসতে লাগল। শেষে সাড়ে তিন হাত জমির মধ্যে পাখোমের সমাধি হল।

 

[রূপান্তর: সরকার আব্দুল মান্নান]

৪৩১৩ পঠিত ... ১৩:৪০, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top