সাবধান ডাক্তার ভাই ও বোনেরা

৬৭৩ পঠিত ... ১৭:৪৫, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৩

ডাক্তাররা-সাবধান

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করার মধ্যে এক ধরনের মজা আছে। আমাদের আশেপাশে দেশি-বিদেশী গুপ্ত সংঘটন এবং ভয়ংকর সব গোয়েন্দা সংস্থার দুর্ধর্ষ সব এজেন্ট গিজগিজ করছে, এটা ভাবলে নিজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। পৃথিবী নামক এই বিরাট নাট্যশালায় নিজেকে তখন আর আ.খ.ম হাসান কিংবা সাজু খাদেম মনে হয় না। নিজের ভিতর তখন কিছুটা আফরান নিশো বা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব ভাব চলে আসে।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলি।

একবার হলো কী... হাসপাতালে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়-হয় অবস্থা। আমরা দেশ-বিদেশ, বাইডেন-পুতিন, ইমরান-মোদি ইত্যাদি বিষয়ে হেভি আলোচনা করছি।

আড্ডার মাঝখানে এক বড় ভাই হঠাৎ করে গলার স্বর নিচু করে, একটু মাথাটা সামনে এনে আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা জেনে অবাক হবে, এই দেশে বিদেশি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা একদম গিজগিজ করছে।‘

তিনি আরেকটু নিচু গলায় আবার বললেন, ‘তোমরা জেনে আরো অবাক হবে, গোয়েন্দারা সবচেয়ে বেশি বিচরন করে এইসব সরকারী হাসপাতালে।‘

আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘বলেন কী!’

তিনি একদম হাত নাড়িয়ে আমাদেরকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন, ‘এই যে এক যায়গায়, এক ছাদের নিচে এত এত লোক, এটা আরো কোনো অফিসে গেলে পাওয়া সম্ভব?’

আমরা বললাম, ‘আপনার কথা সত্য। আসলেই সম্ভব না।‘

তিনি আমাদেরকে বললেন, ‘এই যে আউটডোর, ওয়ার্ডের বিছানা, বারান্দা, ফ্লোর, কোরিডোর সবখানে  কাতারে কাতারে মানুষ, আবার একই সময়ে হাসপাতালে একসাথে অনেকগুলো সরকারী কর্মচারী... এই মানুষগুলোকে লক্ষ্য রাখাই হচ্ছে গোয়েন্দাদের কাজ। এদেরকে কঠিন নজরে রাখলেই একটা দেশকে অনেকটা সাইজ করে ফেলা যায়। আর এদেরকে শেষ করে ফেললে দেশও শেষ। এজন্য হাসপাতালে এত এত গোয়েন্দার আনাগোনা।‘

বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে ভাই তারপর বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, এই হাসপাতালে এই মুহূর্তে কমপক্ষে ২০ জন 'র' এজেন্ট, ১৫ জন 'আইএসআই' এজেন্ট এবং অন্তত ৭ জন 'মোসাদ' এজেন্ট ঘুরঘুর করছে।

আমার তখনই পালটা প্রশ্ন করা উচিত ছিলো – ‘ভাই, এই যে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অশীতিপর বৃদ্ধা, জর্দা কিনলে যার চুন কেনার টাকা থাকে না। কিংবা এই যে মলিন অ্যাপ্রোন পরা ডাক্তার, যার চেয়ারের হাতল ঠিক করার ক্ষমতা নাই তাকে নজরদারীতে রাখলে কী ঘন্টাটা হবে, একটু যদি বুঝিয়ে বলতেন...’

কিন্তু আমি তা করলাম না।

উলটা আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করে ফেললাম।

কারণ, আমি খেয়াল করলাম, তাঁর কথা বিশ্বাস করার সাথে সাথে শরীরে একটা থ্রিল চলে আসছে।

চিন্তা করে দেখেন, আমার বেতন যা-ই হোক, আমাকে নজরে রাখার জন্য আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত, ইসরাইল, পাকিস্তানের মতো দেশ কোটি কোটি ডলার দিয়ে এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে রেখেছে – এটা কী কম আনন্দের কথা?

এরপর থেকে আমি খুব বেশি সাবধান হয়ে গেছি এবং আমার জীবনটাই পালটে গেছে।

সকালবেলা দশ বছর পুরোনো এপ্রোন কাধে নিয়ে, জং ধরা সাইকেলে অলস দেহখানাকে বসিয়ে, ক্লান্ত ভঙ্গীতে প্যাডেল চেপে হাসপাতালে যাওয়া... হাই তুলতে তুলতে অফিস শেষ করে বাসায় চলে আসা... এই জীর্ণ শীর্ণ নিরুত্তাপ জীবন এখন আমার টানটান উত্তেজনায় ভরে উঠেছে।

এই যেমন ধরেন, গতকাল ডায়াবেটিস আক্রান্ত এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তার ছেলে। ছেলের বয়স কম। আউটডোরে প্রবেশের সাথে সাথে খেয়াল করলাম, ছেলের কানে একটা ব্লুটুথ এয়ারফোন।

একটা নির্দোষ দৃশ্যপট।

কিন্তু না... আমি তো এখন জানি, ছেলেটার কানে যে সাদা যন্ত্র ঢুকে বসে আছে, সেটা নিছক কোনো অডিও ডিভাইস নয়, এটা আসলে একটা ট্র্যাকিং ডিভাইস। আর যে ছেলেটার কানে এটা ঢুকে বসে আছে সে-ও কোনো সাধারণ মাতৃভক্ত ছেলে নয়, সে আসলে একজন 'মোসাদ' এজেন্ট। মা'কে দেখানোর নামে ছদ্মবেশ ধরে সে এসেছে আমার ব্যপারে তথ্য সংগ্রহ করতে। আমি কথা বলা মাত্র আমার কণ্ঠস্বর রেকর্ড হয়ে যাবে তাঁর কানের ঐ ডিভাইসে। সে কণ্ঠ চলে যাবে ডাইরেক্ট ইজরাইলে। তারপর শুরু হবে খেলা। আমার ভয়েস বিশ্লেষণ হবে, সে ভয়েস থেকে আমার সব তথ্য তাঁরা জেনে যাবে! ভাবা যায়? আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো রীতিমতো।

তাই যথাসম্ভব কম কথা বলে ঐ অভিশপ্ত ডিভাইস থেকে নিজের মাথাটা দূরে রেখে কাজ শেষ করলাম এবং হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

গতমাসে এক বৃদ্ধা রোগী খুশি হয়ে আমাকে দুইটা আপেল দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি মনের সুখে দুইটা আপেলই খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমাকে নিয়ে কী ভয়ংকর ষড়ন্ত্রটাই না করছে ভারতের ‘র’। আর আমিও কিনা বোকার মতো এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকা পড়লাম! একবারও মাথায় আসলো না, একটা আপেল তো এত সুস্বাদু হওয়ার কথা না! নিশ্চয়ই কোনো না কোনো গণ্ডগোল আছে এর মধ্যে।

এই আপেলের ভিতরে ‘র’কী ভয়ংকর পয়জন কী পরিমানে মিশিয়েছে একমাত্র আল্লাহই জানেন। গত ৭/৮ দিন থেকে আমার ঘুমও বেশি হচ্ছে। আমার আর বুঝতে বাকি নেই, এটা সেই পয়জনেরই ইফেক্ট।

আমি নিশ্চিত, 'র' এজেন্ট ঐ মহিলা আবার আসবে। তখন হয়তো সে আপেল না, অন্য কিছু আনবে। কিন্তু এনে লাভ নাই। এখন থেকে আমি খুব সাবধান।

পার্কিং-এ সাইকেল রেখে আমি হাসপাতালে ঢুকি। প্রায় প্রতিদিনই দেখি, সাইকেলের গিয়ার চ্যাঞ্জ করা। সামনের চাকার গিয়ার তিন-এরটা এক-এ আনা। আবার পেছনের চাকার গিয়ার সাত থেকে তিন-এ নেয়া। এতদিন ভাবতাম, হাসপাতালের শিশু বিভাগে যে বাচ্চারা আসে, তারাই হয়তো দুষ্টামী করে গিয়ার বদলে দেয়। কী ভয়ংকর বোকা আমি!

আমাকে মেরে ফেলার জন্য আইএসআই এজেন্টরা এভাবে গিয়ার চ্যাঞ্জ করে রাখছে, এটা বুঝতে আমার এত সময় লাগলো! অবাক হয়ে যাই, ওরা আর কত নিচে নামবে!

যাই হোক, এখন আর আমি সাইকেল পার্কিং-এ রাখি না। হাসপাতালের পেছনের চায়ের দোকানে রেখে দেই। আইএসআই বুনো ওল হলে আমি বাঘা তেতুল।

শুধু তা-ই নয়, আমি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও বাড়িয়ে দিয়েছি। আগে নাইট ডিউটিতে শুধু জানালা বন্ধ রেখে ঘুমাতাম। এখন পর্দাও টানিয়ে দেই। কারণ আমি জানি, আইএসআই-এর নির্দয় এজেন্টরা আমার সাইকেল খুঁজে না পেয়ে ইতোমধ্যেই কয়েকজন স্নাইপার নিয়োগ দিয়ে ফেলেছে। এরা জানালা দিয়ে বন্দুক তাক করেই আমাকে শেষ করে দিবে।

এখন আর আমি কাউকেই বিশ্বাস করিনা। ক্লোজ ফ্রেন্ড, একসাথে বড় হয়েছি, একসাথে পড়ালেখা করেছি এখন একসাথে চাকরী করি। সে বিয়ে করে ফেলেছে এক মার্কিন রমনীকে। আগে বুঝিনি, এখন বুঝি, সে আসলে যোগ দিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থায়। বেশ কিছুদিন হলো, ফোন দিলে ধরে না। লোকমুখে শুনতে পারলাম, সে আছে বিসিএস-এর ফাউন্ডেশন ট্রেনিং-এ। কিন্তু লোকে তো জানেনা, সে আসলে ট্রেনিং নিচ্ছে এরিয়া ৫১ বা অন্য কোনো ভয়ংকর এলাকায়। মার্কিন সেনারা তাঁকে শিক্ষা দিচ্ছে, কীভাবে আলিম আল রাজিকে শেষ করে ফেলা যায়। এবার সিলেট এসে সে হয়তো আর আমাকে আস্ত রাখবে না।

এভাবেই আমার দিনকাল কাটছে রে ভাই।

আগে বাসায় ফিরলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন সোজা আম্মার ঘরে যাই। কিছুক্ষণ আম্মার সাথে গল্প করে মনটা শান্ত করি। কিন্তু আম্মাকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেই না, কী ভয়ংকর গোয়েন্দাদের সাথে যুদ্ধ করে তাঁর ছেলে অক্ষত অবস্থায় বাসায় ফিরে এসেছে। একদমই বুঝতে দেই না। বুঝতে দিলে ওরা হয়তো আমার ফ্যামিলিকেও টার্গেট করে ফেলবে।

আমার জন্য দোয়া করবেন।

৬৭৩ পঠিত ... ১৭:৪৫, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top