ভ্যালু অফ টাইম বা সময়ের মর্যাদা প্রবন্ধটি বার বার পড়ে পরীক্ষার হলে উগলে দিয়ে আবার সবাই চলে যায় টাইমলেস ল্যান্ড লাইফ স্টাইলে। যেমন আমাদের চট্টগ্রামের মহুর ফ্যশান হাউজের স্পনসরড শো'তে 'নোম চমস্কি'র ইন্টারভিউ করার উদ্যোগ নেয়া সঞ্চালক।
নোম চমস্কি আসতে রাজি হয়েছেন ইমেইলে পেতেই; সেই স্ক্রিনশট ফেসবুকে দিতেই; শুভেচ্ছার প্লাবন আসে। পাড়ার যে ঝর্ণা এতোদিন পাত্তা দেয়নি, সে এসেও শুভেচ্ছা জানিয়েছে। মহুর ফ্যাশান হাউজের চমস্কি টকশোর সঞ্চালক ভাইটি; বিজয় অর্জিত হবার আগেই বিজয় মিছিলে ব্যস্ত থাকায়; টকশো'তে চমস্কিকে যুক্ত করতে ৫৫ মিনিট দেরি হয়ে যায়। চমস্কি আবার সেই ভ্যালু অফ টাইম রচনাটি আউড়াতে থাকলে; সঞ্চালক ভাইটি তবু পাঁচটি মিনিট কথা বলতে চায়।
কিন্তু চমস্কি তো আর টাইমলেস ল্যান্ডের লোক নন; তার একটা ডেইলি রুটিন আছে; পড়তে হয়, লিখতে হয়, কথা বলতে হয়, সক্রিয় থাকতে হয়। উনার তো হোয়াইট হাউজের পিঠা-পুলির আসরের বিদূষকের জীবন নয় যে; কেবল টকশো করে বেড়াবেন!
আর চমস্কিকে তো পড়াতে হয়। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে এতো সময় নেই যে করোনার কাছে সমর্পণ করবেন দুটো বছর। পৃথিবীর আর কোথাও এ ঘটনা ঘটেনি। কেবল ঘটেছে টাইমলেস ল্যান্ডে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকা। বিশ্ববিদ্যালয় যেন ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে আছে; ফুলের মধু খেয়ে। আছে কেবল সময় আর সময়। সময় নষ্ট করতে হতে হয় বরং শুয়ে-বসে ফেসবুকের তেলাঞ্জলিতে।
এই তেলাঞ্জলির বিনিময়ে একসেস টু টেকাটুকা (এটুটু) প্রকল্পে ঢোকার অবাধ সুযোগ। ফলে সময়ের চেয়ে তেলের মূল্য বেশি; এই দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে মহুর ফ্যাশান হাউজের হোস্ট নোম চমস্কিকে ৫৫ মিনিট তেল দিয়ে ও নিজে সতীর্থ ফেসবুকারের তেল খেয়ে; অবশেষে তার মনে পড়ে, আসল কাজই তো করা হয় নাই। নোম চমস্কিকে বসিয়ে রেখে ৫৫ মিনিট তার ঢোল বাজানোর ফলাফল; চমস্কি বিরক্ত হয়ে ঠিক পাঁচ মিনিট পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। অথচ দেশের সমস্ত জনসভায় প্রায় পাঁচ ঘন্টা তেলাঞ্জলি দিয়ে তারপর আসে প্রধান অতিথির বক্তৃতার পর্ব। তেল ছাড়া কোন 'নেতার' গাড়ি চলে না; চলে না; চলে না রে।
রেলগাড়ি চালাতে চালাতে যদি চালকের ইচ্ছা করে একটু ঝালমুড়ি খাবো; ট্রেন দাঁড় করিয়ে দিব্যি ঝালমুড়ি কেনা যায়। অপেক্ষায় থাকাটাই হচ্ছে সেরা বিনোদন রেলযাত্রীর। তাই ট্রেনের ড্রাইভার থেকে রেলমন্ত্রণালয়-এর সমালোচনা, "মন্ত্রীর নিজেরই গাড়ি চলেনা; নতুন ইঞ্জিন এসে টেনে নিয়ে যায় তাকে;" ইত্যাদি প্রসঙ্গ পরিভ্রমণ করে রেলের হরিলুটের চাঁদ ঠাকুরের নাম উঠতেই ট্রেন হুইসেল দিয়ে যাত্রা শুরু করে; ট্রেনচালক তখন ঝালমুড়ি খেয়ে তরতাজা; যাত্রীরাও অপেক্ষার অবসানে পরিতৃপ্ত। এরকম ছোট ছোট চাওয়ার খপ্পরে পড়ে 'সময়ের মর্যাদা'র বোধ লোপ পায় সময়ের ধারণা রহিত জনপদে।
বিবাহের দাওয়াতে বরপক্ষের আগমন অনেকটা 'মন্ত্রী মহোদয়ের আগমনে'র মতো বিলম্বিত। আজকাল পার্লারে সাজতে গিয়ে কনেও দেরী করে বসেন 'সংরক্ষিত আসনের সাংসদ'দের মতোই! করোনাভাইরাস এসে অবশ্য এমন টাইট দিয়েছে যে, আজকাল তিন চার ঘন্টার মধ্যে বিবাহ কৃত্যাদি শেষ করতে হয়। টাইমলেস ল্যান্ড বলে অনেকেই বিবাহঘড়ির কড়াকড়িতে বড্ড বিরক্ত।
শুধু সময় মেনে অফিসে যেতে হয় করোনায় জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কাজে। গিয়ে পৌঁছালেই সেটা টাইমলেস অফিস। কেউ সেবা নিতে এলেই 'বুঝতেই তো পারছেন; করোনা টাইম' বলে সেবাগ্রহীতাকে লাটিমের মতো ঘুরাতে থাকে সরকারি কর্মচারিরা। তাদের সময়ঘড়ি চালু করতে স্পিড মানি দিতে হয়। টাইমলেস ল্যান্ডে যথাসময়ে সেবা পেতে টাইম-চার্জ দিতে হয়। কারণ জনগণ এদের বেতন দেন কেবল তাদের চেহারা দেখার জন্য; ২৫ বছরে তাদের মুখমণ্ডলে চেকনাই বাড়ার রূপান্তরচিত্র দেখার জন্য। আর সেবা পেতে দিতে হবে অর্ঘ্য; সময়ের মূল্য।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলে সব ছাত্র ছাত্রীকেই ভাব সম্প্রসারণ ও সারাংশ শেখানো হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী গিয়ে কেবল ভাবসম্প্রসারণ চর্চা করে যাপিত জীবনে। এই সামষ্টিক ভাবসম্প্রসারণের চাপে ঘড়ির কাঁটা খুলে গিয়ে টাইমলেস ল্যান্ডের ধারণা প্রবর্তিত হয়।
ফলে নানা রকম দিবস পালন-স্তুতি-পূজা-পুষ্পার্ঘ্য-দোয়া-মেহেফিল ও সেমিনার সিম্পোজিয়ামে ভাবসম্প্রসারণের আতশবাজি চলতে থাকে। সারাংশ কী জিনিস তা ভুলেই যাওয়ার দশা যখন; তখন নোম চমস্কি এসে পাঁচ মিনিটের সারাংশে বললেন ঐ চিরন্তন; ভ্যালু অফ টাইমের কথা। "আপনি আপনাকে দেয়া এপয়েনমেন্ট অনুযায়ী ৫৫ মিনিট দেরি করে ফেলেছেন।"
কিন্তু কে শোনে কার কথা; চমস্কির ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে বাঙ্গালির টাইমসেন্স বিপর্যয়ের সচিত্র প্রতিবেদন দেখার পর; পাঁচমিনিটের সারাংশের কী বিরাট ভাবসম্প্রসারণ লিখলাম; আপনারা তো তা দেখতেই পাচ্ছেন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন