আমাদের বুকের কষ্টের চেয়ে ফেসবুকে কষ্ট বেশি

১৭১৯ পঠিত ... ১৭:১৩, জুলাই ৩১, ২০১৮

ছোটমাছের ঝাল চচ্চড়ির সাথে ডাল দিয়া ভাত খাবার সময় যদি সাথে এক টুকরা লেবু থাকে, বাঙালির ভেতরের রাক্ষস জেগে উঠে। ভাত খাওয়ার আর লিমিট থাকে না।

লোকমান ওরফে Mi6 এরও ভাত খাওয়া হয়ে গেছে বেশি। Mi6 ফেসবুকের ঝানু স্ট্যাটাসবাজ হিসেবে পরিচিত। তার ফ্রেন্ডলিস্ট ফুল। ফলোয়ার এখন ৮৭ হাজারের মত। প্রতিটা স্ট্যাটাসে তার লাইক পড়ে মিনিমাম ১৫ থেকে ২০ হাজার। শেয়ার হয় কম করেও ৭-৮ হাজার। ভার্চুয়াল সেলিব্রেটি Mi6 এর বস্তু জগতের নাম মোহাম্মদ ইসমাইল ফকির লোকমান। দেশের বাড়ি ফেনী বসুরহাট আর বর্তমান অবস্থান ভুতের গলির মেস।

চিপা দিয়ে ঠেলে ঠুলে ফলিত পদার্থবিদ্যায় একটা অনার্স শেষ করে বিসিএসের চেষ্টায় কোচিং করে-টরে ৩-৪ বছর পার করে দিয়ে এখন নিজেই সেই কোচিং সেন্টারের মাস্টার, সাথে তিনটা ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট এর টিউশনি। আয়-রুজি মাশাল্লাহ খারাপ না। মাথায় বুদ্ধি আছে, বুদ্ধি কাজে লাগানোর চিপা বুদ্ধি আরও বেশি আছে। ফেসবুকের ময়দানে নিজেকে তেলাপোকা হিসাবে না দেখায়ে কিভাবে বাজপাখি হয়ে যাইতে হয় সেই আইডিয়া লোকমানের ভালই আছে। কায়দা করে নিজের নামের মোহাম্মদ থেকে M ইসমাইল থেকে i আর ফকিরের F ইংলিশ 6th লেটার তাই 6 মিলায়ে আইডির নাম রাখসিলো Mi6। তার সব স্ট্যাটাস লেখার ঢং আছে। সে খুব সেয়ানা মানুষ। ব্যাক্তিগত কথাবার্তা, কাজকর্ম ইত্যাদি নিয়ে কিছু পোষ্ট দেয় না। 'সিক্রেট এপিফেনি' সিরিজ নামে চলমান ইশু নিয়ে ধারালো কথাবার্তা লেখে, মানুষের বাহবা কুড়ায়। সারাক্ষন পসিবল স্টিকি ইশু কী হইতে পারে এটা খুঁজে বেড়ানো তার কাজ, দুই দুইখান মোবাইলে ইন্টারনেট চলে। সেলিব্রেটি স্ট্যাটাসবাজ বলে কথা। 

আজকে ভাত বেশি খেয়ে ঘুম দেয়ার কারনে খুব গরম অবস্থায় কম্পিটেটরদের আগে একটা মারদাংগা স্ট্যাটাস দেয়ার চান্স মিস হয়ে গেল। ঘুমটা জমেছিল ভালো। পাতলা গেঞ্জি পরে, ফ্যান ছেড়ে ভাতঘুমের সুর কেটে গেছে মোবাইলের বার বার ভাইব্রেশানে। পৌনে তিন ঘন্টা ঘুম দিয়ে ফোনের ভ্যারররররর ভ্যাররররর ভাইব্রেশানে খুব বিরক্তি নিয়ে মোবাইল আনলক করে লোকমান ওরফে Mi6 দেখে ফেসবুকে ২৬টা নোটিফিকেশান। কী ব্যাপার? লাস্ট চুমু খাওয়া-খাওয়ি নিয়া দেয়া স্ট্যাটাস তো দুই দিন আগে দেয়া।

"প্রতিটি চুমুই স্বর্গীয়, উকি মেরে দেখার কি আছে এত বুঝিনা!"

এই স্ট্যাটাস তো লাইক শেয়ার কমেন্ট পড়ে বেশ হিট হয়ে এতক্ষনে মিয়ায়ে আসার কথা। এই ভর দুপুরে হঠাত নোটিফিকেশান কিসের? কেউ কি চুমুর পরে আরও আগায়ে গেল নাকি এই মধ্যে।

শালার ইশুর এখন কোন মাপঝোক নাই। সিজন ভালো। একের পর এক ইশু আসতেসে। একটু যে আরাম করে ঘুমাবে তার উপায় নাই। কিঞ্চিত বিরক্তি আর কিঞ্চিত কৌতুহল নিয়ে লোকমান ফোন হাতে বাথরুমে যায়।

কয়দিন আগেও এমন হইছিল, ছাত্র পড়াচ্ছে লোকমান, ডাবমাথা ছাত্র। কিভাবে যে সে স্ট্যান্ডার্ড সিক্সে উঠসে, লোকমান এর মাথায় ধরে না। সোশ্যাল সায়েন্সে কোশ্চেন হল, নেম এ ফ্রিডম ফাইটার, হাউ ইউ নো হিম/হার?

গাধার বাচ্চা, বুদ্ধি খাটাবি না? বদলের ঘরের বলদ উত্তর লেইখা রাখছে, আওয়ার ড্রাইভার সেলিম মিয়া ওয়াজ এ ফ্রিডম ফাইটার। আই নো হিম সিন্স আই বর্ন, আয়্যাম ভেরি প্রাউড অব হিম...!

আরে গাধা নিজের দাদা বা নানার নাম লেখতে পারিস না? ড্রাইভার যুদ্ধে গেছে কিনা, কে জানতে চাইছে তোর কাছে? সৃজনশীল প্রশ্নের মানে বুঝে না। এইগুলারে পড়ায়া আরাম আছে?

যাই হোক এই গাধাটাকে পড়ানোর সময় নোটিফিকেশান আসলো, কোনো এক ফলোয়ার অন্য এক সেলিব্রেটি স্ট্যাটাসবাজ এর কারেন্ট ইশু নিয়া করা পোস্টের কমেন্টে তাকে ট্যাগাইছে। ইশু হইল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মজুদ করা কয়লার লাখখানেক টন কয়লা হাওয়া। শালার পড়ানোর চক্করে, এমন টশটশে ইশু নিয়া লেখতে দেরি হয়ে গেল। শালা এই লাইনেও এখন কম্পিটিশান বেড়ে গেসে। দুই মিনিট চোখ সরালেও ইশু ঝেড়ে দেয় পাবলিক। মাঝে মাঝে মন চায় তাদের স্ট্যাটাসের তলে গিয়া কমেন্টে গু-মুত ঢাইলা আসতে। কিন্তু নিজের ইমেজের কথা মাথায় রেখে করা হয় না। Mi6 ফেলনা ফেসবুকার না। নিতান্তই কেউ নিজের স্ট্যাটাসে মতামতের জন্য না ট্যাগাইলে সে লেখে না।

যাক সেই কথা। কেউ একজন তারে কয়লা লোপাটের স্ট্যাটাসের নীচে ট্যাগাইয়া লেখছে, Mi6 ভাই, নীরব কেন ? আপনি কি চুপ করে থাকবেন?

খুবই চিন্তার কথা, চুপ থাকা যাবে না। যার ফলোয়ার-ফ্রেন্ড মিলায়ে ৯০ হাজারের বাহিনীরে চাঙ্গা রাখতে হয় তার তো চুপ থাকা মানায় না। কিন্তু শালার আসল কাহিনী কী? কাহিনী না জাইনা ডানে বামে লেইখা ফেল্লেই তো হবে না। লেখার ভেতর বুজুর্গ একটা গন্ধ থাকতে হবে। পাবলিকের প্রিডিসাইডেড মাইন্ডকে কোশ্চেন করতে হবে, তাইলেই না স্ট্যাটাস হিট হবে। হিট পড়তে দেয়া যাবে না। হিট এর পর হিট দিয়া যাইতে হবে। Mi6 এর ভার্চুয়াল ইমেজকে মিলিয়ন নাম্বারে নিয়া যাইতে হবে না?

ছাত্র পড়াতে পড়াতে আঙ্গুলের আগা ব্যাথা করে, ১২/১৩ টা অনলাইন নিউজ ঘাইটাও লোকমান ধোঁয়াশার ভেতর থাইকা যায়। ঘটনা মনে হইতেসে সিম্পল, সরকারি রাঘব বোয়াল মিলে কয়লা ঘাপ করে দিসে, পরিমানটা চোখে পড়ার মতো। এই নিয়া বেশি চিল্লায়া আসলে তেজ আসবে না। স্পেসিফিক কোনো নাম নাই, কয়লা খাইয়া দিসে কে! নীচের ঠোট কামড়ায়ে ১০-১৫ মিনিট ভেবে লোকমান Mi6 আইডি থেকে পোস্ট দিলো--

সিক্রেট এপিফেনি:
কেউ খেয়ে দেয় কয়লা
কেউ দিয়ে যায় বাঁশ
বাকিটা ইতিহাস ...
সেলুকাস

এইসব ইশুতে একটু ক্রিয়েটিভ হইতে হয়, যেহেতু কোনো স্পেসিফিক অ্যাটাকিং পয়েন্ট নাই, তাই তীক্ষ্ণ আক্রমনও নাই। হালকা ভাসা ভাসা হওয়াই ভালো। তাও এই স্ট্যাটাসে সাড়ে ৯ হাজার লাইক আর ৩ হাজারের মতন শেয়ার। খারাপ না, নতুন ফলোয়ার অ্যাড হইছে ৩০০ এর বেশি। 

কয়লার পর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনা নিয়ে খবর বের হল ভল্টে রাখা সোনা নাকি ২২ ক্যারেট থেকে ১৮ ক্যারেট হয়ে গেছে আপনা আপনি। লোকমানের মুখে লালা চলে আসলো খবর পড়ে, সেই দুপুরেই লোকমান বুয়াকে বলছিল, আজকে ইলিশ মাছ রান্না করেন তো খালা!

পোস্ট দিয়েছিল: অশুভ হাতের ছোয়ায়, কলংক সোনায়...

কী তৃপ্তি আসার মত, ছোট্ট সুন্দর লাইনটা মাথায় আসছিল।

মাঝে মাঝে লোকমান এই জাতীয় স্ট্যাটাসের নীচে কমেন্টে থাকা বলদের মধ্যে এক দুইটার কমেন্টের উত্তর দেয় ।

বিশেষ করে যারা কমেন্ট করে: খুব ভাল বলসেন ভাইয়া, শেয়ার করলাম। তাদের কমেন্টের রিপ্লাইয়ে লোকমান একধরনের নৈর্ব্যক্তিক হতাশা সুচক কথা লেখে, খুব ভাব নিয়ে। যেমন: শেয়ার করেন, কিন্তু এত শেয়ারেও কি বন্ধ হবে এসব অনাচার? জাতি হিসাবে আমরা কি এই ভাগ্যই বরণ করে নিব, দিনের পর দিন?

 ঝানু ফেসবুকাররা নোটিফিকেশান নীচের থেকে চেক করে উপরে উঠে। বাথরুমে ৭ মিনিটে লোকমানও তাই করছিল।

নতুন খবর। বেপরোয়া বাস চাপা দিয়ে কলেজের স্টুডেন্ট মেরে ফেলছে। কেউ বলছে তিনজন, কেউ বলছে দুইজন। চেক করতে করতে একটু উপরের দিকে রিসেন্ট নোটিফিকেশানে গিয়ে লোকমান তব্দা খেয়ে গেল। ছাত্রছাত্রীগুলো যেই কলেজের, লোকমানের ছোটভাইও সেই কলেজে পড়ে। দ্রুত হাতে লোকমান ছোট ভাইয়ের নাম্বারে ফোন করে, দুইবার রিং হবার পর খসখসে গলার কে যেন ফোন ধরে,

- হ্যালো কে, সোলায়মান কই? আপনি কে?

- এই ফোনের মালিক কে? আপনি তার কি হন?

- ফোন আমার ভাই সোলায়মানের, আমি তার বড় ভাই লোকমান।

- আচ্ছা, আমি কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালের ওয়ার্ড মাস্টার। আপ্নার ভাই আজকের বাস এক্সিডেন্ট ভিক্টিম। মাথায় ইনজুরি আছে। এবি নেগেটিভ ব্লাড ম্যানেজ করে হসপিটালে আসেন কুইক।

পাগলের মত কাঁপা কাঁপা হাতে লোকমান স্ট্যাটাস লিখে: আমার ভাইয়ের জন্য রক্ত লাগবে, এবি নেগেটিভ। যোগাযোগ করুন ০১...... 

পাঠাও মটরসাইকেলে পিছনে বসে থাকা লোকমানের কান্না কখনো জোরে, কখনো চাপা। চালক মাঝে মাঝেই বলে, ভাই আপনি শান্ত হন। লোকমান শান্ত হতে পারে না।

কিন্তু Mi6 এর পেজে দেয়া রক্ত চেয়ে করা পোস্ট টা শান্ত হয়ে পড়ে থাকে ফেসবুকে। ৭৬টা লাইক আর ৪২টা শেয়ার। ৫টা কমেন্ট আছে তাতে। তার একটা হচ্ছে: আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন। আমিন।

 

সম্ভবত এই গল্পটা জানা ছিল বলেই সাংবাদিকদের সামনে হেসে ফেলে চাঁড়ালটা। সে জানে, আমাদের বুকের কষ্টের চেয়ে ফেসবুকে কষ্ট বেশি।

১৭১৯ পঠিত ... ১৭:১৩, জুলাই ৩১, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top