সে মোটেও অনেক দিন আগের কথা না। তখন ২০১৮ সাল। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এক অদ্ভুতুড়ে দেশ ছিল। নাম তার বাংলাদেশ। দেশটা আকারে ছোট হলেও ওখানে থাকতো প্রচুর মানুষ। আর আপনারা তো জানেন, যত বেশি মানুষ, তত বেশি গল্প! তেমনই একটা গল্প শুনাতে বসলাম।
সেই দেশের একদম উত্তর দিকের এক জেলার এক গ্রামে গরীব কৃষকের ছেলে কয়লাকুমারের নিবাস। গায়ের রঙ অনেকটা ময়লা হলেও মনটা ছিল তার একদম পরিষ্কার। আর, রাজধানী শহরে থাকতো দেশসেরা সুন্দরী স্বর্ণলতা। তার বাবা ছিল বিরাট বড় ব্যাংক ব্যবসায়ী। নিজের সুন্দরী মেয়েকে লুকিয়ে রাখতো একদম গোপন এক ভল্টে। সেই ভল্টে পরিবারের লোকজন ছাড়া কেউ যাতায়াত করতে পারতো না। কিন্তু তাতে কী? তখন তো ফেসবুকের যুগ।
ফেসবুকে এক গ্রুপের পোস্টে কমেন্ট কমেন্ট খেলায় কয়লাকুমার আর স্বর্ণলতার পরিচয় হলো। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা পাঠিয়েছিল কয়লাকুমারই। বেশ কিছুদিন ঝুলিয়ে রেখে এরপর রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করল স্বর্ণলতা। ধীরে ধীরে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, সেখান থেকে প্রেম। দিন গেলো, মাস গেলো, কয়লাকুমার আর স্বর্ণলতার প্রেম বাড়তে থাকলো। দুজনে মিলে ঠিক করলো একদিন দেখা করবে, টিএসসিতে।
যেই ভাবা, সেই কাজ! কয়লাকুমার গটগট করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। বাংলাদেশে আবার ছেলেমানুষ মানে বিশাল ব্যাপার। যখন তখন ঘর ছেড়ে বের হতে কোন সমস্যা নেই। কোথাও কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না। কিন্তু, স্বর্ণের তো সে সুযোগ নেই। মেয়ে বলে এমনিতেই তাকে ঘরে আটকে রাখার কথা, তার উপর সে দেশের সবচেয়ে সুন্দরী!
তাই বলে কি স্বর্ণলতা তার ভালোবাসার সাথে দেখা করতে পারবে না? মোটেই না। রূপে যেমন সে সেরা, তেমনি বুদ্ধিতেও কম যায় না। ছোটবেলা থেকে বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখে দেখে সে অনেক কিছু শিখে নিয়েছে। এফডিসির নায়িকাদের মতো বিছানার চাদরের নিচে কোলবালিশ রেখে, বারান্দা দিয়ে শাড়ি পেঁচিয়ে কী দারুণভাবেই না নেমে গেল।
ওদিকে কয়লাকুমার বাস থেকে নেমে বুঝতে পারছিল না কী করবে, কোথায় যাবে। গাবতলী থেকে কীভাবে সে যাবে টিএসসি? একে ওকে জিজ্ঞেস করে ৭ নাম্বার বাসে উঠে গেল কয়লাকুমার। শহরের জ্যাম, রোদ, বৃষ্টি এসব ঠেলে যখন কয়লাকুমার শাহবাগ এসে নামল, ততক্ষণে তার সুবিশাল শরীরে কালোঘাম ছুটে গেছে।
ওদিকে স্বর্ণলতা অনেকক্ষণ ধরে টিএসসিতে বসে আছে। হেঁটে হেঁটে টিএসসির কাছে এসেই কয়লাকুমার দেখতে পেল তার স্বপ্নের স্বর্ণলতাকে। ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা অনেক দেখা আছে কয়লাকুমারেরও। সিনেমার নায়কের মত করেই ‘স্বর্ণওওও...’ বলে দূর থেকেই চিৎকার করে ডাক দিল ছেলেটা। স্বর্ণলতা চিৎকার শুনেই খুঁজতে লাগল তার স্বপ্নের রাজকুমারকে।
স্বর্ণলতার চোখ খুঁজে পেল কয়লাকুমারকে। এই প্রথম বার তারা একজন আরেকজনকে চর্মচক্ষে দেখছে, এতদিনের অপেক্ষা, এতদিনের বাসনার পর। কী ভাবছেন? দুজন তাকিয়ে থাকবে দুজনের চোখের দিকে? হঠাৎ দমকা হাওয়ায় স্বর্ণের আঁচল উড়ে যাবে? মুষলধারে বৃষ্টি নামবে, আর আশপাশ থেকে দশ-বারোজন এসে উৎকট ভঙ্গিতে নাচতে থাকবে?
ভাই থামেন! ভুলে যাবেন না এটা ফেসবুকের প্রেম। কয়লাকুমারের ফেসবুক প্রোফাইল দেখে তার যে ছবি স্বর্ণলতার মনে গেথে ছিল, সে কয়লাকুমার আর এই ছেলে তো এক না। ফেসবুকের কয়লাকুমার ড্যাশিং স্মার্ট আর বাস্তবে তো প্রকাণ্ড রকমের মোটা। ১ লক্ষ ৪২ হাজার টন কি মুখের কথা? স্বর্ণলতা তা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ‘কী কয়লা চেয়েছিলাম, আর কী কয়লা পেয়েছি!’ এ সব ভেবে রাগে-দুঃখে তখনই সে হাঁটা ধরল। এখন কী করবে সে? কীভাবে ফিরে যাবে সে বাসায়? এই ব্যর্থ প্রেমের গ্লানি বয়ে বেড়াবার চেয়ে স্বর্ণলতার মনে হলো গুম হয়ে যাওয়াই শ্রেয়। আর কয়লাকুমার? আজ কেবল নিজের ওজন একটু বেশি আর গায়ের রঙ একটু কালো বলে স্বর্ণের সাথে তার মিলন হলো না। কতো ভেবেছিল, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে টিএসসিতে বসে চুমু খাবে স্বর্ণলতার ঠোঁটে। এসব ভেবে ভেবে, দুঃখে-কষ্টে সেও গুম হয়ে গেল।
স্বর্ণ ফিরল না বাবার ভল্টে, কয়লাও যে কোথাও উধাও হয়ে গেল… তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যান থেকে ভেসে আসছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ। উচ্চারিত হচ্ছিল সেই অজর কবিতা- ‘প্রেমে ও ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে অনেকেই...’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন