সরকার সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই পরিবেশকে 'চাইপ্পা ধরে রাখা' প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য দ্বীপে আনা হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমানে ইট বালু সিমেন্ট। পরিবেশ যেন কোন অবস্থাতেই সেখান থেকে পালাতে না পারে। প্রয়োজনে পরিবেশকে সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ী করে বেধে রাখা হবে।
দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায় আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এখানকার অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। এই মুহূর্তে সেন্টমার্টিনে চলছে ১০৬টি ভবন নির্মাণের কাজ। বর্তমানে এ দ্বীপে ১০ হাজার মানুষের বাস। তার ওপর পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার পর্যটক দ্বীপে যাচ্ছেন। যত না মানুষ তার চেয়ে বেশি রিসোর্ট। দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে ইট-পাথরের দালান গড়ে উঠেছে। উঁচু ভবন নির্মাণের জন্য প্রবাল খুঁড়ে মাটি বের করা হচ্ছে। অবাধে আহরণ হচ্ছে শামুক-ঝিনুক-পাথর। সৈকতসংলগ্ন এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। হোটেলে চলা জেনারেটরের আওয়াজে দ্বীপে চলছে শব্দদূষণ। যে যেভাবে পারছেন, দ্বীপে ঘুরছেন। পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণহীন। মানুষের অতিরিক্ত চাপে পানি ও পরিবেশ দূষণে হুমকিতে দ্বীপের প্রায় ৬৮ প্রজাতির প্রবাল।
সম্প্রতি আলোকচিত্রী শরীফ সরওয়ার তার ফেসবুক পেজে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৈকতের কিছু ছবি প্রকাশ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে সৈকতজুড়ে পড়ে আছে অসংখ্য ইট, বালি ও সিমেন্ট। টাক্টর দিয়ে সেসব আনা নেওয়ার দৃশ্য দেখে যেন গা শিউরে উঠে।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে টুথপিক দিয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চেয়ারম্যান বলেন, 'পরিবেশের শরীলডা খারাপ। ICU-তে আছে। তয় হুশ ফিরবো। হুদাই ট্যানশন নিয়েন না।'
এত সব ইট বালু সিমেন্ট কেন আনা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, 'স্যালাইন চিনো মিয়া? ডায়রিয়ার স্যালাইন না। সুই ফুটাইয়া যেইডা দেওয়া হয়। ইট বালি হইলো পরিবেশের জন্য ওই স্যালাইন। আর সিমেন্ট হইলো ভাইটামিন।'
একটু বুঝিয়ে বলতে বলা হলে তিনি আঙুল নাড়িয়ে বলেন, 'শুনেন, পরিবেশ হইল একটা দুষ্ট জিনিস। এইটারে সিমেন্ট দিয়া গাইড়া রাখতে হইব। আনার কলিরে দেখছিলেন না, সম্রাট আকবর কেমনে দেয়ালের মধ্যে ইট সিমেন্ট দিয়া গাইড়ালছিল? পরিবেশরে এম্নেই ধইরা রাখতে হইব। আপনেরা জ্ঞানী মানুষ। আপনেগোরে এত বুঝানোর কাম কী!'
দ্বীপে সরেজমিনে থাকাকালীন জনৈক রিসোর্ট ব্যবসায়ী আমাদেরকে টুরিস্ট ভেবে ডাক দিয়ে বলেন, 'হুদাই বালির ভিত্রে না ঘুইরা রিসোর্টে আসেন। এসিরুম। এটাচড গোসলখানা...!'
তাকে কাটিয়ে এসে দ্বীপের আশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে আমরা একটি মৃত কচ্ছপ দেখতে পাই। এসময় জনৈক টুরিস্ট ভদ্রলোক লাল চোখে চিপস খেতে খেতে দুঃখী সুরে বলেন, 'পরিবেশের খারাপ অবস্থা দেখে কচ্ছপ সুইসাইড করছে। সো স্যাড। সুইসাইড ইজ নট দ্য সল্যুশন।'
হানিমুন করতে আসা ওই ভদ্রলোক এরপর দ্বীপে চিপসের প্যাকেট ফেলতে ফেলতে বলেন, 'খুবই নোংরা ডিজঘাস্টিং অবস্থা। হাঁইটা হাইটা চিপস খাবো, সেই অবস্থাডাও নাই। আই হেট সেইন্ট মার্টিন।' তার চোখ তখন ঘোলাটে হয়ে উঠে।
এরপর তিনি একটু উত্তেজিত হয়ে ইংরেজিতে অনর্গল বলতে থাকেন, 'হু উইল সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড? হু উইল সাক? হু দ্য হেল? হু দ্য ফা...!!!'
তার কাছ থেকে আমাদের প্রতিবেদক সোজা চলে যায় কক্সবাজার প্রশাসকের কার্যালয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রশাসক কপালে ভাঁজ ফেলে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে বলেন, 'পরিবেশ রক্ষায় ইট-সিমেন্ট আনা হইছে। কিন্তু মাটি খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না। মাটি হইলো পরিবেশের মূল উপাদান। দ্বীপে প্রবাল রাইখা লাভ নাই। আমি বিশ টেরাক মাটি অলরেডি অর্ডার কইরা ফালাইছি।'
অন্যদিকে বিশেষ টাস্কফোর্সের প্রধান হাই তুলতে তুলতে তুড়ি বাজিয়ে বলেন, 'আমরা এলার্ট আছি। পরিবেশ পালিয়ে যাবে কই?'
তাহলে এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতি কেন তৈরি হল, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে রুল জারি হয়েছে। আমি জানি রুলস এন্ড রেগুলেশন কাকে বলে। দরকার হলে সংকট উত্তরনে আরও ইট আনা হবে।'
এসময় হুট করে তার রুমে পর্যটন কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা ঢুকে পড়েন। তবে পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি নিজেকে প্রবীর মিত্রের মত সৎ দাবি করেন। পর্যটন কর্পোরেশনের কর্মকর্তার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড সূত্রে জানা গেছে, দুদিন আগেই তিনি এক স্ট্যাটাস দিয়ে দু হাজার লাইক পেয়েছেন। স্ট্যাটাসে লেখা ছিল--রিসোর্ট বিনা টুরিস্ট লাভ হয় কি মহিতে?