করোনাভাইরাস যেভাবে সিলিকন ভ্যালির উদ্ভাবনশীলতার আসল চেহারা প্রকাশ করেছে

৫০৪ পঠিত ... ২০:২০, জুন ০১, ২০২০

করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রস্তুতি ও মোকাবেলায় আমাদের ব্যর্থতা বিষয়ে মার্ক এন্ড্রিসেনের লেখায় হতাশা খুব পরিস্কার। তার চিহ্নিত করা সমস্যাও অকাট্য: পদক্ষেপ নিতে পারার ব্যর্থতা, এবং আমাদের পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিছু 'উদ্ভাবন' আমাদের সর্বব্যাপী অপারগত।' আমাদের কেন ভ্যাকসিন বা মেডিসিন নাই, অথবা এমনকি মাস্ক ও ভেন্টিলেটরও নাই কেন? তিনি লিখেছেন: 'এই জিনিসগুলো আমাদের থাকতে পারতো, কিন্তু আমরা রাখতে চাইনি- বিশেষ করে, আমরা চাইনি এগুলোর জন্যে দরকারি মেকানিজম, ফ্যাক্টরি, এগুলো বানানোর সিস্টেম৷ আমরা যেন না বানাতেই চেয়েছি।' 

হয়তো ভুলে গিয়েছেন, এই কথা যার কলম থেকে বের হয়েছে তিনি ২০১১ সালে 'সফটওয়্যার কেন বিশ্বকে ধংস করে দিচ্ছে?' নামক লেখার জন্যে বিখ্যাত। সিলিকন ভ্যালির একজন আইকন এন্ডারসনের কথায় সত্যতা আছে। জর্জ পার্কার আটলান্টিক ম্যাগাজিনে যেমনটা লিখেছেন- আমেরিকান সমাজ ও রাজনীতির ফাটল ও অবক্ষয় কোথায়, করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক তা প্রকাশ করে দিয়েছে। আমাদের জন্যে ভীষণ জরুরি ওষুধ বা অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী  জিনিসগুলো না বানাতে পারার অক্ষমতা তার বড় উদাহরণ। 

সিলিকন ভ্যালি এবং যেকোনো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এই সংকটে তেমন কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি। হ্যাঁ, তারা আমাদের মধ্যে তুলনামূলক ভাগ্যবানদের কাজ চালিয়ে নিতে জুম বা মানসিকভাবে স্বাভাবিক রাখতে নেটফিক্স  উপহার দিয়েছে; ফিজিক্যাল স্টোর এড়িয়ে চলার জন্যে আমাজন ত্রাতা হিসাবেই আবির্ভুত হয়েছে; আই প্যাডের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ইন্সটাকার্ট সেলফ আইসোলেশনে থাকা অনেক লোককে খাদ্যসামগ্রী পৌছে দিতে সাহায্য করছে। কিন্তু প্যানডেমিক গণস্বাস্থ্যের সংকটের মুখোমুখি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী কোম্পানিগুলোর সীমাবদ্ধতা ও অপারগতাও একই সাথে দেখিয়ে দিয়েছে, (অথচ আমাদেরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ!) এই প্যানডেমিক।  

বিগ টেক কিছু বানায় না৷ বিগ টেক আমাদের ভ্যাকসিন বা ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিট দেবে বলে মনে হয় না। কিভাবে একটা সুতির টুকরা বানাইতে হয় তাও কি আমরা জানি? যারা ভাবেন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাবশালী টেক ইন্ডাস্ট্রিকে প্যানডেমিক মোকাবেলায় দরকারী জিনিস উদ্ভাবন করতে বাধ্য করবে, তারা হতাশ হবেন। 

নতুন কোনো অভিযোগ এটি নয়। এক দশক আগে, যাকে আমরা একসময় ‘মহামন্দা' বলতাম, সেই 'মহামন্দার' কিছুদিন পরে সিলিকন ভ্যালির বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এন্ড্রু গ্রোভ  ব্লুমবার্গ বিজনেসউইকে একটা লেখায় আমেরিকার নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, নিজেদের উদ্ভাবনগুলোকে বড় আকারে ব্যবসাসফল করার উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা কিভাবে সিলিকন ভ্যালি নির্মিত হয়েছে: 'প্রোটোটাইপ থেকে ম্যাস প্রডাকশনে যাওয়ার আগের গ্যারাজে যাত্রা শুরুর মহাকাব্যিক মুহূর্ত'। গ্রোভ লিখেছেন, যারা বলছে  'পুরোনো পন্য উৎপাদন করা পুরোনো কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত', তারা ভুল: কারণ বড় আকারে এই উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের ম্যাস প্রডাকশন মানেই হলো হাজার হাজার কর্মীর চাকরির সুযোগ। 

আইফোন বা মাইক্রোফোনের উৎপাদন বিদেশে চলে যাওয়া নিয়েই যে গ্রোভ চিন্তিত ছিলেন এমন না। তিনি লিখেছেন, 'ব্যবসার আকার খুব দ্রুত বাড়ানোর নেশা শেষপর্যন্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কমিয়ে দেবে।' 

প্যানডেমিক এই সমস্যাকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট করেছে: যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো আর জীবনের মৌলিক প্রযোজনে প্রাসঙ্গিক নতুন নতুন আইডিয়া আর প্রযুক্তি নিয়ে আসতে পারছে না। জাকজমকে ভরা, সফটওয়্যার কেন্দ্রিক স্ট্যাটাস বাড়ানো প্রযুক্তি বা সেবা যে জীবনের কিছু কিছু দিকের টেকনিক্যাল সমস্যা দূর করে এমন জিনিস উদ্ভাবনে আমরা অসাধারণ। অথচ স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষার পুনঃবিবেচনা, খাদ্য উৎপাদন ও বন্টন আরও কার্যকরী করা এবং বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর তেমন কিছুই করতে পারছি না। 

অর্থনীতিবিদেরা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে উৎপাদন বৃদ্ধি বিবেচনা করে থাকেন; তাদের বিবেচনায় এইসব উদ্ভাবনী নতুন জিনিস ও আইডিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতি আর বড় হবে, যা আমাদেরকে সমৃদ্ধ করবে। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সেই পরিসংখ্যান হতাশাব্যঞ্জক। এমনকি যখন সিলিকন ভ্যালি এবং হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি বড় হওয়ার সাথে সাথেও আমাদের গ্রোথ ধীরগতির হয়ে গেছে৷  

শেষ দশকটি ছিলো বিশেষভাবে হতাশজনক- এমনটাই মনে করেন এমআইটি অর্থনীতিবিদ জন ভ্যান বিনেন, যিনি সম্প্রতি এই সমস্যা নিয়ে লিখেছেন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের জন্যে দীর্ঘমেয়াদে উন্নতি করতে হলে উদ্ভাবনশীলতাই একমাত্র উপায়। উৎপাদন বৃদ্ধির ধীরগতির অজস্র তর্কযোগ্য কারণ আছে, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করাই যায়; ভ্যান রিনেন বলেন- কিন্তু সরকারি ফান্ডের গবেষণা ও উন্নয়নের ঘাটতি একটা বড় কারণ, এর পক্ষে প্রচুর প্রমাণ হাজির করা সম্ভব। 

তার বিশ্লেষণ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ যুক্তরাষ্ট্র যখন কোভিড-১৯ প্যানডেমিক কাটিয়ে উঠতে শুরু করছে এবং পুনরায় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে যাচ্ছে, মানুষ নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে ভালো বেতনের চাকরির সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করবে। প্যানডেমিকের আগেই ভ্যান রিনেন বলেছিলেন 'অর্থনীতি ভঙ্গুর অংশ যা ম্যাক্রোস্কেলে বড় ধরণের প্রভাব রাখতে পারে তেমন সেক্টরে, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, গবেষণা ও উন্নয়নের ব্যাপক প্রয়োজন'। ইতোমধ্যে অনেকেই এই দিকটায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে কাজ ও বড় ধরনের বিনিয়োগের জন্য বলতে শুরু করেছেন। 

তাই, হ্যাঁ, শুরু করা যাক। তবে  তা করতে গিয়ে আমরা যেন কোভিড-১৯ প্যানডেমিকে প্রকাশিত হয়ে যাওয়া আমাদের ব্যর্থতা থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটার কথা ভুলে না যাই: স্বাস্থ্যসেবা বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সবচেয়ে দরকারি সেক্টরগুলোতে আমাদের উদ্ভাবনশীলতার কমতে থাকার সক্ষমতার কথা। এই সমস্যাগুলোতে নজর দিতে তাই প্যানডেমিক হতে পারে জেগে ওঠার ডাক। 

[সূত্র: টেকনোলজিরিভিউ-তে ২৫ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত ডেভিড রটম্যানের লেখার ভাষান্তর। ]

৫০৪ পঠিত ... ২০:২০, জুন ০১, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top