লেখা: জয়নাল আবেদীন
এই টাকা দিয়ে কী করবেন?
দ্বিতীয়বারের মতো এমন প্রশ্ন কোনো প্লেয়ারকে করতে শুনলাম। প্রথম শুনেছিলাম ২০০৯ সালে। কলকাতা নাইট রাইডার্স ৬ লাখ ডলারে কিনেছিল মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। ৬ লাখ ডলার মানে তখন সাড়ে চার কোটি টাকা। বর্তমান সময়ের টাকায় কনভার্ট করলে এটা ৭ কোটির চেয়ে বেশি এবং মূল্যস্ফীতি হিসেবে ভ্যালু ১০ কোটি পার করবে।
মাশরাফি উত্তর কী দিয়েছিলেন ঠিক মনে নেই। আছে আছে, এত বিপুল টাকার বিনিময়ে তিনি পুরো সিজনে মাত্র ২৪টা বল করতে পেরেছিলেন। ২৪ বলে রান দিয়েছিলেন সম্ভবত ৫৮।
অক্টোবর, ২০২৪। ১৬ বছরের একটা সরকারের পতন হয়েছে প্রায় ৩ মাস। বাফুফের আলাদিন মাদাফাকা সালাহউদ্দিনকেও নামতে হয়েছে চেয়ার ছেড়ে। এসেছে নতুন মুখ, যাদের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বৈষম্যহীনতার গন্ধ। তাদের ভাগ্য, অল্পদিনের মধ্যেই তারা দেখল আমাদের মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে আরও একবার। দেড়শ কোটি জনসংখ্যার ভারত, সুঠামদেহী পাকিস্তান, অ্যাথলেটিক্সপ্রিয় শ্রীলঙ্কা এবং হিমালয়ের দেশ নেপাল ভুটানের মেয়েদের কেউই তাদের রুখতে পারেনি।
টুর্নামেন্ট সেরা মেয়েটার নাম ঋতুপর্ণা চাকমা। পাহাড়ি, অবাঙালি। টুর্নামেন্টে রাজ করার জন্য একটা চেক পেল মেয়েটা। চেক নেবার পর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, এই টাকা দিয়ে কী করবেন?
মেয়েটা বলল, টিমমেটদের খাওয়াবে। মায়ের জন্য কিছু জিনিস কিনবে। চেকের মূল্য ৫০ হাজার টাকা। আর বেশি কীই করা যাবে পঞ্চাশ হাজারে?
২০০৯-২০২৪, ১৫ বছরের ব্যবধানে দেশের দুইজন খেলোয়াড়কে ‘টাকা দিয়ে কী করবেন’ প্রশ্ন করা হলো দুবার। দুই দুইবার সাফ জেতানো মেয়েটার টাকার পরিমাণ প্রথম জনের চেয়ে মাত্র ২০০০ ভাগের এক ভাগ!
প্রশ্ন করা নিয়ে আমার আপত্তি নেই, প্রশ্ন নেই মাশরাফির ৬ লাখ ডলারে। নারী পুরুষ, ক্রিকেট-ফুটবল, আইপিএল-সাফ এসবের আবেদন ও ব্র্যান্ড ভ্যালুতে আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। আমার পয়েন্ট সেটা না।
আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবলাম, এই চ্যাম্পিয়ন মেয়েগুলোর টাকা কতটা কম হলে, লাইফস্টাইল কতটা দরিদ্র হলে ৫০ হাজার টাকা পাবার পর প্রশ্ন করা যায় ‘টাকা দিয়ে কী করবেন?’
ঋতুপর্ণা ৫০ হাজার টাকার চেক নিয়ে নাচানাচি করেছেন। সরল কিশোরীর মতো হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘আমি খুশি, অনেক খুশি। টাকা পেলে কে না খুশি হয়?’
অন্তত এই মুহূর্তের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সেরা মেয়ে ফুটবলারটার অবশ্য খুশি হবারই কথা। তারা বেতন পায় অল্প, সেটাও বন্ধ দুই মাস ধরে। সালাহউদ্দিনশাহীর পতনের পর বৈষম্যবিরোধী মানসিকতার নতুন ম্যানেজমেন্ট এসেছে। ফুটবল সংস্কারে নানাভাবে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তারা। মেয়েদের বেতনের কথা হয়ত ভুলে গেছেন নানা কাজের চাপে। ভুলে যাওয়া নিশ্চয়ই এত বড় কিছু না।
বাফুফে আসলেই কিন্তু ব্যস্ত। এই সাফ ফুটবল চলাকালীন সময়ে বাফুফের নির্বাচন চলছিল। ১২৮ জন ভোটারের নির্বাচনে ভোটাভুটি শেষে কমিটি হয়েছে। ফাইভ স্টার হোটেলে সভা ও ভোটাভুটিতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। কাউন্সিলর ও নির্বাহীদের হোটেল রুম ভাড়াতেই চলে গেছে ১১ লাখ।
২০০ কোটি জনসংখ্যার দেশগুলো হারিয়েছে দুই মাস ধরে বেতন না পাওয়া এবং মে মাস ধরে ম্যাচ ফি বঞ্চিত আমাদের এই মেয়েরা। ৫০ হাজার টাকার চেক পেয়ে নাচানাচি করছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্লেয়ার। এদিকে ১২৮ ভোটের ইলেকশনে খরচ হচ্ছে ৫০ লাখ টাকা।
ঋতুপর্ণাদের জন্য ভালোবাসা ও শুভকামনা। আশা করছি তারা নিজেদের খেলাটাকে সামনে আরও ভালো বুঝবে। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে থেকেও আসবে ট্রফি।
ঋতুপর্ণাদের জন্য শুভ কামনা। আশা করি তারা কখনও মন খারাপ করবে না। তারা বুঝবে, ফুটবল এদেশের সবচেয়ে লাভজনক খেলা নয়। এমনকি সেটা নয় ক্রিকেটও।
সবচেয়ে লাভজনক খেলার প্লেয়ারদের দল বদলায়, জার্সি বদলায়, স্লোগান বদলায়। কিন্তু খেলার নিয়ম বদলায় না। এসব মহান প্লেয়ারদের প্রতি ঋতুদের রাগ ক্ষোভ ও ঈর্ষা না লাগুক।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন