‘হুমায়ূন! এই হুমায়ূন!’
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখি সুনীলদা (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। সুনীলদা বললেন, ‘এখনো ঘুমাচ্ছো? জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো একবার। বিরাট উৎসব। আমরা যাব না?’
‘অবশ্যই যাব। এক্ষুনি উঠছি।‘
‘দ্রুত করো। লুঙ্গি পাল্টে প্যান্ট পরে নাও।‘ এই বলেই সুনীলদা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রাতে একটা লেখা নিয়ে বসেছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। প্রেমের উপন্যাস। অল্পবয়সী মেয়েদের মাথা খারাপের মন্ত্র। ওই লেখা নিয়েই ঘটর ঘটর করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। বেজেছিল নিশ্চয়ই। টের পাইনি। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। পাতলা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে গেছি। সুনিদ্রা হয়েছে। পরকালে এই ব্যাপারটা খুব ভালো, প্রতি রাতেই ভালো ঘুম হয়।
আচ্ছা, উৎসবের কারণটা বলি। আজ আমাদের মেসে নতুন মেম্বার আসবেন। মেম্বার শব্দটা অবশ্য ভালো না। শুনলেই মনে হয় ইউনিয়ন পরিষদের ধান্দাবাজ কোনো মানুষ। এরচেয়ে ভালো অতিথি বলি। আজ আমাদের মেসে নতুন অতিথি আসবেন। সমরেশ মজুমদার। এই নিয়েই স্বর্গজুড়ে উৎসব। আর উৎসব হবে নাইবা কেন। এলেবেলে কেউ তো নন, স্বয়ং সমরেশ মজুমদার!
দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে জামা-কাপড় পাল্টে ভদ্রস্থ হয়ে নিলাম। সুনীলদার ঘরে উঁকি দিতেই দেখি তিনি আরাম করে সিগারেট টানছেন। আমি বললাম, ‘সুনীলদা, চলুন!’
সুনীলদা বললেন, ‘বসো। ওর আসতে দেরি হবে। স্বর্গে ঢোকার আগেই নাকি কিছু ভক্ত ওকে আটকে ফেলেছে। ওরা নাকি প্রিয় লেখককে দেখে পাগল হয়ে গেছে। রাস্তা সব বন্ধ। বোঝো অবস্থা!‘
আমি আনন্দিত গলায় বললাম, ‘স্বাভাবিক!’
সুনীলদা কিছু বললেন না। কেমন গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন। ব্যাপারটা কী? সমরেশদা আসছেন, এতে কি তিনি খুশি না?
‘কিছু ভাবছেন?’
‘হু!‘
‘কী হয়েছে?’
‘সমরেশটা আসছে, আমাদের ফ্ল্যাটেই তো থাকবে। ওকে ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে হবে না?’
‘ও আচ্ছা, এই কথা! চলুন, উনি আসার আগেই দুপুরের বাজারটা করে ফেলি।‘
সুনীলদা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এখানেই তো ঝামেলা। বাজারে গেলেই তোমাদের হুমায়ুন আজাদের সাথে দেখা হবে। ফোড়ন কেটে বলবে, এই যে বাজারি লেখকদ্বয় বাজারে চলে এসেছে!’
আমি ঘর কাঁপিয়ে হোহো করে হেসে উঠলাম। শেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললাম, এটা তো উনি ঠিকই বলেন। দুনিয়ার সব লেখকই বাজারি। কারণ সবাই জীবনে একবারের জন্য হলেও বাজার করেছে।
সুনীলদা বললেন, ‘রসিকতা অফ। মেজাজ খুব খারাপ।‘
আমি বললাম, ‘চলুন মোড়ের দোকানে চা খাই। সমরেশদা আসুক। তারপর দেখা যাবে।‘
‘চলো।‘
আমরা দুজন রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তাজুড়ে অসংখ্য মানুষ। সবাই প্রিয় লেখকের অপেক্ষায় আছে। লেখকের আসতে দেরি হবে—এই খবর সবাই জেনে গেছে। ছোট ছোট দল করে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প-টল্প করছে। সবচে বেশি ভিড় চায়ের দোকানে। এই ভিড়ের মধ্যেই আমরা কোনোমতে জায়গা করে নিয়ে দুকাপ চায়ের কথা বললাম।
সুনীলদা বললেন, ‘দেখেছো হুমায়ূন, সমরেশকে লোকে কেমন ভালোবাসে?’
আমি বললাম, ‘তাই তো দেখছি। কিন্তু অন্যান্য লেখক-কবিদের তো দেখছি না। শরৎদা, মানিকদা, তারা কোথায়?’
‘সবাই ওই বটতলায় আছে। বিশাল মঞ্চের মতো করছে। সংবর্ধনা দেবে।‘
‘ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। সমরেশদা ওসব শেষ করে আসুক। আমরা তাকে বগলদাবা করে নিয়ে বাজারে নিয়ে যাব। হাহাহা।‘
বলতে না বলতেই হইচই শুরু হয়ে গেল। সবাই হর্ষধ্বনি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে স্বর্গের দরজার দিকে। সমরেশদা চলে এসেছেন বুঝি!
‘হুমায়ূন, চলো।‘
‘আপনি যান। আমি এখানেই থাকি। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আসুন।‘
‘সে কী! কেন?’
আমি চুপ করে রইলাম।
‘বুঝেছি। তুমি আলাদা কিছু করবে। মানুষকে সারপ্রাইজ দেয়ার স্বভাবটা তোমার ইহকাল বা পরকাল—কোনোকালেই আর যাবে না দেখছি! আচ্ছা হুমায়ূন, আমি যাই, ওকে নিয়ে আসি।‘
সুনীলদা ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন। আমি হইচই এড়িয়ে রাস্তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। স্বর্গের সবাই এখন অন্যপ্রান্তে, সদর দরজার কাছে। আমার চারপাশজুড়ে এখন অদ্ভুত রকম নীরবতা।
সমরেশদাকে কীভাবে সারপ্রাইজ দেয়া যায় ভাবছি। একটা হাতির ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। হাতির পিঠে করে লেখককে স্বর্গ ঘুরিয়ে দেখানো। আইডিয়া ভালো। এটাই করতে হবে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কাণ্ডটা ঘটল। স্বর্গজুড়ে শীতল একটা হাওয়া বয়ে গেল। অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে শরীর মন ভরে উঠল। বুঝলাম, সমরেশ দা স্বর্গে পা রেখেছেন।
আমি মনে মনে বললাম, প্রিয় সমরেশদা, স্বর্গে আপনাকে স্বাগতম!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন