অভদ্রতার চেয়ে মৃত্যুও যেখানে শ্রেয়

৭৮৮ পঠিত ... ১৬:২১, জানুয়ারি ১৭, ২০২১

চমৎকার এক সন্ধ্যায় ইভান দিমিত্রিচ চেরভিয়াকভ- (যিনি একজন চমৎকার সরকারি কর্মচারিও বটে!) বসে ছিলেন নাট্যশালার দ্বিতীয় সারিতে। 'বেলস অফ ফেস্টিভ্যাল' নামে দারুণ একটা অপেরার অনুষ্ঠান হচ্ছিল, তিনি বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে বেশ মনোযোগের সাথেই দেখছিলেন। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর সারা শরীরে আনন্দ বয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে যেন তিনি স্বর্গের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ...আসলে গল্প-কাহিনিতে 'হঠাৎ' কথাটা প্রায়ই দেখা যায়। এটা লেখকদের দোষ নয়। জীবনে তো অনেক কিছুই 'হঠাৎ' ঘটে, তাই না?

কিন্তু হঠাৎ তাঁর চোখমুখ কুঁচকে উঠল, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল প্রায়, এবং...হ্যাঁচ্চো!!! হেঁচে ফেললেন আর কি! কোনখানেই তো এমন বলা নেই- হাঁচতে মানা, হাঁচব না। চাষি মরদেরা হাঁচে, পুলিশের কনস্টেবল হাঁচে, এমনকি বড় বড় গোয়েন্দা উপদেষ্টারাও হাঁচেন। সবাইই হাঁচে। তাই, চেরভিয়াকভ একটুও না ঘাবড়ে না গিয়ে রুমালে নাক মুছলেন, তারপর গোবেচারার মত নিষ্পাপ দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালেন- তাঁর হাঁচিতে কারো কোন অসুবিধে হল না তো? আর তখনি তাঁর মনে একটা ধন্দ উঁকি দিতে লাগল।

তাঁর ঠিক সামনেই, প্রথম সারিতে এক বেঁটেখাট ভদ্রলোক হাতমোজা দিয়ে নিজের চকচকে টেকো মাথাটা মুছলেন, আর বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। বৃদ্ধটিকে চেরভিয়াকভ চিনে ফেললেন। ইনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্টেট জেনারেল ব্রিজালভ।

-'উনার উপরেই আমি হাঁচিটা দিয়েছি!', মনে মনে বললেন চেরভিয়াকভ, 'অবশ্য উনি সরাসরি আমার বড় সাহেব নন। তবুও কাজটা ঠিক হল না। আমার মাফ চাওয়া উচিত।'

চেরভিয়াকভ একটু গলা খাঁকরে নিয়ে আমুণ্ডু সামনে ঝুঁকে জেনারেলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন:

-'মাফ করবেন স্যার, আপনার ওপরে হাঁচিটা পড়ে গেছে, মোটেই ইচ্ছে করে নয় স্যার...'

-'ঠিক আছে, ঠিক আছে...'

-'খোদার কসম স্যার, মাফ করে দিন। আমি...মানে আমি মোটেও বুঝতে পারিনি...'

-'আহহা, বসুন তো! শুনতে দিন!'

চেরভিয়াকভ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন, অস্বস্তি নিয়ে বোকার মত হেসে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। মঞ্চের দিকে তাকালেন বটে, কিছু অস্বস্তিটা পিছু ছাড়ছে না। বিষয়টা তাঁকে খোঁচাতে লাগল ভীষণ। বিরতির সময় তিনি ব্রিজালভের দিকে এগিয়ে গেলেন, তাঁর কাছে গিয়ে সংকোচ সামলে মিনমিন করে বললেন:

-'আমি আপনার গায়ের ওপরে হেঁচে ফেলেছিলাম স্যার। মাফ করে দিন স্যার...আমি আসলে স্যার ইচ্ছা করে করিনি স্যার...'

-'আহ, হয়েছে! ওই হাঁচি নিয়েই আছেন এখনো? ব্যাপারটা আমি কখন ভুলে গেছি, আর আপনি সেই ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছেন!' জেনারেল বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করলেন।

ভুলে গেছেন? কিন্তু চোখেমুখে তো বিরক্তির ছাপ- ভাবলেন চেরভিয়াকভ। অবিশ্বাসের সাথে তিনি কিছুক্ষণ জেনারেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন- উনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছেন, তাই এই ব্যাপারে কথা বলতেই চান না। জিনিসটা উনাকে বুঝিয়ে বলা দরকার যে আমার কোন দোষ নেই, আমি ঘুণাক্ষরেও চাই নি...নইলে হয়তো উনি ভাববেন আমি উনার ওপরে থুতু ফেলতে চেয়েছিলাম। এখন যদি এটা না-ও ভাবেন, পরে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে নিশ্চিত তাই ভাববেন!

বাড়ি ফিরে চেরভিয়াকভ নিজের অভব্য আচরণের কথা স্ত্রীকে বললেন। তাঁর মনে হল, স্ত্রী বিষয়টাকে খুব হালকাভাবে দেখলেন। অবশ্য প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু তারপর যখন শুনলেন যে ব্রিজালভ অন্যদের বড় সাহেব, তখন শান্ত হয়ে গেলেন।

-'তবুও তুমি মাফ চেয়ে নিও, না হলে ভদ্রলোক মনে করবেন তুমি পাবলিক প্লেসে সম্ভ্রম রেখে চলাফেরা করতে জানো না।'

-'হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো গেছিলাম! আমি মাফ চাইলাম, কিন্তু উনি কেমন যেন, প্রসঙ্গটার ধারে কাছেও গেলেন না। তাঁর যেন কথা বলার সময়ই ছিল না!'

পরদিন চেরভিয়াকভ চুল ছেঁটে নতুন একটা ফ্রককোট পরে ব্রিজালভের কাছে গেলেন, ব্যাপারটা তাকে বোঝানোর জন্য...জেনারেলের অভ্যর্থনাকক্ষে প্রচণ্ড ভিড়। অবশ্য সেই ভিড়ে স্বয়ং জেনারেলও আছেন, আবেদনকারীদের কথা শুনছেন একে একে। কয়েকজনের সাথে কথাবার্তা শেষ করে জেনারেল চোখ তুলে চেরভিয়াকভের দিকে তাকালেন।

-'কাল অপেরাতে, স্যারের বোধহয় মনে আছে', চেরভিয়াকভ বয়ান শুরু করলেন, 'আমি হাঁচি দিয়ে ফেলেছিলাম স্যার, মানে অনিচ্ছাকৃতভাবে এসে গেছিল আর কি... স্যার...মাফ করে...'

-'কি ফালতু সব লোকজন, খোদা!', বিরক্ত জেনারেল সময় নষ্ট না করে পরবর্তী আবেদনকারীর দিকে ঘাড় ঘোরালেন, 'তারপর, আপনার কি চাই?'

কথাই বলতে চান না!- চেরভিয়াকভ ফ্যাকাসে হয়ে মনে মনে বললেন- জেনারেল রেগে উঠেছেন, তার মানে...ইস, না না না, ব্যাপারটা এভাবে ফেলে রাখা যাবে না... আমি উনাকে সব বুঝিয়ে বলব...

সর্বশেষ সাক্ষাৎপ্রার্থীকেও বিদায় করে দিয়ে জেনারেল যখন খাসকামরার দিকে রওনা হলেন, চেরভিয়াকভও তাঁর পায়ে পায়ে চলতে লাগলেন আর মিনমিন করে বললেন:

-'স্যার, আমি বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করছি স্যার, কিন্তু অনুশোচনা থেকে বলছি স্যার, মানে আপনি নিজেও জানেন কিন্তু যে আমি ইচ্ছা করে নয়...'

জেনারেলের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল, তিনি মশামাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন হাত দিয়ে।

-'কি!! আপনি তামাশা পেয়েছেন আমাকে নিয়ে?' ক্লান্ত ত্যক্ত বিরক্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, তারপর দরজার আড়ালে চলে গেলেন।

কিসের তামাশার কথা বললেন উনি?- ভাবলেন চেরভিয়াকভ- এর মাঝে তামাশা কোথায়? হুহ, এসব বোঝেনা, আবার জেনারেল হয়েছে! ঠিক আছে, এই যদি হয়, আমি আর মাফ চাইতে আসছি না। জাহান্নামে যাক! চিঠি লিখব উনাকে, কিন্তু তবু আসব না। খোদার কসম!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে এই ভাবলেন চেরভিয়াকভ। কিন্তু, রাতে টেবিলে বসে কতবার চেষ্টা করলেন, জেনারেলকে চিঠিটা লিখতে পারলেন না তিনি। ঠিকমত কথাগুলো সাজান যাচ্ছে না। অগত্যা পরদিনই তাকে সশরীরে আবার হাজির হতে হল সবকিছু বুঝিয়ে বলার জন্য।

জেনারেল গম্ভীর চোখে তাকালেন তাঁর দিকে।

-'গতকাল স্যার আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হয়েছিল', মিনমিন করে বললেন চেরভিয়াকভ, 'কিন্তু আপনি যা বলছিলেন তা নয়, তামাশা করতে নয়। হাঁচি এসে গেছিল বলে আমি মাফ চাইতে এসেছিলাম, আপনার সাথে তামাশা করার কথা কি আমি ভাবতে পারি? আমরা যদি এসব নিয়ে হাসি তামাশা করি তাহলে কি লোকের মানসম্মান থাকবে?...বলুন?'

-'বেরিয়ে যাও!!!', হুংকার দিয়ে উঠলেন জেনারেল, রাগে তিনি নীল, কাঁপছেন।

-'জি?'- ফিসফিস করে বললেন আতংকে বিমূঢ় চেরভিয়াকভ।

-'এইমুহূর্তে, বেরিয়ে যাও এখান থেকে!!!', মেঝেতে পা ঠুকে আবার বললেন জেনারেল।

চেরভিয়াকভের পেটের মাঝে কিছু একটা ছিঁড়ে গেল। কিছু না দেখে, কিছুই শুনতে না পেয়ে তিনি দরজার দিকে এগোলেন, রাস্তায় বেরিয়ে এলেন এবং হোঁচট খেতে খেতে চলতে লাগলেন...যন্ত্রের মত বাড়ি ফিরে এসে ফ্রককোটটি না খুলেই, কোনোমতে ডিভানের ওপরে শুয়ে পড়লেন এবং...

মরে গেলেন।

(সামহোয়্যার ইন ব্লগে ‘প্রফেসর শঙ্কু’ অনুদিত)

৭৮৮ পঠিত ... ১৬:২১, জানুয়ারি ১৭, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top