আটদিন ধরে নীলুফার কঠিন ডায়েটে আছে। কঠিন বলতে প্রচন্ড কঠিন। নীলুফার স্বাভাবিকের চেয়ে একটু মোটা, তারপরেও বন্ধুরা এমনভাবে 'মোটকি, ভুটকি, মুটি, হাতি' ডাকে যে নীলুফার বিরক্ত হয়ে ডায়েট করতে বাধ্য হচ্ছে।
ডায়েট করার প্রথম দশদিনে নীলুর ওজন কমেছে প্রায় ২ কেজি৷ শতকরা হিসাব করে নীলু বের করেছে আট দিনে যদি ২ কেজি কমে, তাহলে একমাসে ওজন কমবে প্রায় সাড়ে সাত কেজি।
নীলুফার প্রতিদিন সকালে উঠে কুসুম গরম পানিতে লেবু মিশিয়ে খায়, ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করে। শর্করা জাতীয় খাবার একদম খায় না, সকালে আর রাতে শুধু ফল খায়, দুপুরে দুটো রুটি আর সবজি।
রেস্টুরেন্টগুলো ভিতরে দেখতে কেমন হয় নীলুফার তা ভুলে গেছে বললেই চলে। চিনি জাতীয় কোনো খাবারও ছুঁয়ে দেখে এখন। ইউটিউবে দেখেছে, শুধুমাত্র চিনি বর্জন করলেই অনেকখানি স্বাস্থ্য কমে যায়। নীলুফার কখনো বুঝতেই পারেনি ফুচকা, হালিম, চটপটি, আইসক্রিম, চকলেট সবকিছু অকালেই জীবন থেকে হারিয়ে যাবে।
মোটামুটি পনের দিন পরে নীলু ওজন মেপে দেখলো ওজন প্রায় সাত কেজি কমে গেছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সব ফ্রেন্ডদেরকে সেলফি তুলে পাঠালো। আয়নাতেও নিজেকে চিনতে পারছে না নীলু, নিজেকে কারিনা কাপুরের মত লাগছে। এই খুশিতে নীলু ভাবলো সবাইকে ট্রিট দেওয়া উচিত।
৫ জন ফ্রেন্ডকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পর ঠিক হলো নীলুফার যে কোনো একজনের থেকে এক চামচ ফ্রাইড রাইস খাবে। শুধু ফ্রাইড রাইস। ভেজিটেবলস, চিকেন ফ্রাই, সিজলিং, কোল্ড ড্রিংকস কিচ্ছু না। কিন্তু এক চামচ খাওয়ার পর নীলুফারের আরেকটু খেতে ইচ্ছে করলো। এত মজা করে যে কেন রান্না করে এটা ভেবে একটু রাগও হলো বাবুর্চির উপর। কোনোভাবেই লোভ সামলাতে না পেরে পাঁচজন থেকে পাঁচ চামচ খেলো নীলুফার।
এর একটু পরই মনে পড়লো, ছোটবেলায় কোথায় যেন শুনেছে, একবার খেলে পানিতে পড়ে যায়! এই একটু খাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে যে রাজী হবে তার নিতান্তই জীবনের প্রতি মায়া নেই। কিন্তু নীলু তো জীবনকে অনেক ভালোবাসে, এসব ভাবতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পাঁচ জন থেকে আরো পাঁচ বার খেয়ে নিলো।
বাসায় যাওয়ার পথে একটা বাচ্চা নীলুর কাছে পানি চাইলো। সারাদিন কিছু না খেয়ে বাচ্চার চেহারাটা একদম শুকিয়ে আছে। ততক্ষণে নীলুর ব্যাগে থাকা পানিও শেষ। দোকানে পানি কিনতে গিয়ে দুইটা হাফ লিটারের সেভেন আপ কিনলো। সাথে চিপস, চকলেট চানাচুর।
নীলু খেয়াল করে দেখলো, কেনার সময় সে শুধু বাচ্চার জন্যও কিনছে না, ডাবল অর্থাৎ নিজের জন্যও কিনছে। সারা রাস্তা বাসে চকলেট, চিপস, মিরিন্ডা খেতে খেতে বাসার গেটে এসে দেখলো কারেন্ট নেই। লিফট বন্ধ। নীলুর কষ্টে দম বন্ধ হয়ে গেলো। বাসা পাঁচতলায়, এভাবে কি উঠা সম্ভব?
নীলু অনেক কষ্টে গুটিগুটি পায়ে পাঁচ তলা উঠেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুয়ে মনে হলো কিছু খাওয়া উচিত, পরিশ্রমের পর কিছু না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে৷ খাবার খুঁজতে ডাইনিং রুমে যেয়ে দেখলো টেবিলের উপর চিকেন চিজ বার্গার রাখা। মনে হয় নীরার জন্য রাখা। নীরা তো সবসময়ই খায়, ডায়েট করে নীলু, সুতরাং ওরই প্রাপ্য এই বার্গার।
বার্গার অর্ধেক খাওয়ার পর নীলুর মনে হলো পেট ভরছে না, এখন আসলে ভাত খাওয়া উচিত। বার্গারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নীলুফার ভাত, গরুর মাংস ভুনা আর কোক নিয়ে বসলো। জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার পর নীলুফারের মনে হলো সে ডায়েটে ছিলো। এত খাওয়াদাওয়া তো তার করা নিষেধ!
কিছুক্ষণের জন্য নীলুফারের খুব মন খারাপ হয়ে গেলো। খাওয়াদাওয়া করতে খুব ভালো লাগে ওর। এত মোটা চিকন দিয়ে কি হবে যদি জীবনটাই না থাকে? ছোট্ট একটা জীবন, অথচ এর উপরই কত অত্যাচার! কি হবে এত কম খেয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে? ভাবতে ভাবতে নীলুফারের চোখে পানি চলে আসে।
তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। দই, মিষ্টি আর তিলের নাড়ু খেয়ে নীলু বাসা থেকে বের হলো বাইরে এক্সারসাইজ করার জন্য। যাওয়ার পথে দেখলো একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে।
'ক্যাফে ৩৬৫'। পুরো দেয়ালটা সাদাকালো পত্রিকা দিয়ে সাজানো। আগ্রহ করে ভিতরে ঢুকে নীলু বিপদে পড়ে গেলো।
মেন্যু দেখে লোভ সামলে রাখা যাচ্ছে না। চিকেন নাগেট আর ব্যানানা শেক অর্ডার করলো। পেটভরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আবার ক্ষুধা লাগলো নীলুর।
'আম্মা, বাসায় মুরগি আছে?'
'হু'
'দেশি না ফার্ম?'
'দেশিও আছে, ফার্ম ও আছে৷'
'দেশিটা ভুনা করবেন, আর ফার্মেরটা রোস্ট। দেশিটার কলিজাটা আলাদা করে রান্না করবেন। পিঁয়াজটা একটু বেশি করে ভাজবেন আর ঝাল একটু কম৷'
নীলুর মা কিছু না বলে শুধু মেয়ের দিকে তাকালেন৷
একটুপর নীলু আবার বললো, 'কালকে দুপুরে ইলিশপোলাও রান্না করবেন। অনেকদিন ধরে খাই না। পোলাওয়ের সাথে বাদাম দিয়েন। আর খাওয়ার শেষে যেন দই থাকে৷ আব্বাকে বলে দিয়েন দই নিয়ে আসতে। শ্যামলীর দইটা ভালো।'
নীলুর মা রাহেলা বেগম কিছু বললেন না। এই মেয়ের মতিগতি বোঝা কষ্ট।
এদিকে প্রায় একমাস পর আয়নার সামনে নিজেকে দেখে আবার চিনতে পারলো না। সেই কারিনা কাপুর হারিয়ে গেছে। ওজন মাপতে গিয়ে তো কেঁদেই ফেললো নীলু৷ প্রায় পাঁচকেজি বেড়ে গেছে। সবাই আবার 'মোটকি, ভোটকি' ডাকাও শুরু করে দিয়েছে। নীলুফারের খুব খারাপ লাগছে। একধরনের হতাশা আর বিষন্নতায় ছেয়ে আছে চারদিক।
এসব ভাবতে ভাবতে নীলুফার টের পেলো, ভীষণ খিদে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সামনে যা পাবে এক্ষুনি গিলে ফেলবে৷ রেস্টুরেন্টগুলোর ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখলো কোথায় কোথায় অফার চলছে৷ এরপর সোজা একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলো স্পাইস ক্লাবে। নীলুফার জানে, হতাশা কিংবা বিষন্নতায় ভুগলে মানুষ প্রচুর খাওয়া দাওয়া করে।
নীলু চিৎকার করে ওয়েটারকে ডাক দিয়ে বললো, 'এক্সকিউজ মি, একটা লার্জ চিকেন বারবিকিউ পিজ্জা, থাই স্যুপ উইথ অন্থন, একটা আমেরিকান সাবওয়ে বার্গার, স্টিক ফাজিটা পাস্তা, সাব স্যান্ডুইচ, একটা চিকেন শর্মা, স্টিক নাচোস আর কোল্ড ড্রিংকস প্লিজ।'
ওয়েটার কিছুক্ষণ নীলুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে অর্ডার লেখা শুরু করলো।
'প্রস্তুতির জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ম্যাম। আমরা নির্ধারিত সময়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।'
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো নীলুফার। মনে হলো আশেপাশের সবাই তাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে।
খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললো, 'বলুক যার যা ইচ্ছা। আমি খাবোই।'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন