নিয়মটা খুবই সহজ, অবশ্য আপনাকে যথেষ্ট পরিমাণে ঋণ করতে হবে।
পাঠক, আপনার কি কখনও টাকা ধার করার প্রয়োজন হয়েছে? আপনি কি কখনও পরের মাসে বেতন পেলেই পরিশোধ করবেন এইরকম সম্মানজনক শর্তে দশটা ডলার ধার করেছেন? আপনি কি কখনও দশ লক্ষ ডলার একসঙ্গে ধার করেছেন?
আপনি যদি তা করে থাকেন তাহলে অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন যে দশ ডলার ধার করার চেয়ে এক লক্ষ ডলার ধার করা অনেক সহজ, আরও সহজ দশ লক্ষ ডলার আর সহজতম হচ্ছে এক কোটি ডলার ধার করা।
কীভাবে তা করা যায় তা-ই দেখানো হচ্ছে পরবর্তী নিয়মাবলীতে।
১ নং কাহিনী
হারডুপ জোনস তার বন্ধু ক্যানি স্মিথের কাছে আগামী মাসের প্রথম দিনেই শোধ করার শর্তে দশ ডলার ধার করতে গিয়েছে।
‘দ্যাখো বন্ধু, আগামী মাসের প্রথম দিনেই পরিশোধ করবো এই শর্তে কি মাত্র দশটা ডলার আমাকে ধার দিতে আপত্তি হবে তোমার?
‘দশ ডলার!’
‘হ্যা, তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো যে মাইনে পেলেই আমি শোধ করে দেব!’
‘দশ ডলার!!’
সত্যিই আমি খুব বিপদে পড়েই এসেছি তোমার কাছে। বাড়িওয়ালী আমার কাছে সাড়ে সাত ডলার পায়। গতকালই সে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে যে টাকাটা তার অবশ্যই চাই। দ্বিতীয়ত গত সপ্তাহে আমি ধোপার দোকানে টাকা দিতে পারি নি, সেও বলেছে তার পাওনাটা শোধ করতেই হবে, আর এই যে স্যুটটা আমার গায়ে রয়েছে এর জন্যও মাসিক কিস্তিটা দেওয়া হয় নি। ওরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে কিস্তির টাকা না দিলে আমার বাক্সটাই উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আর...’
‘বলে যাও, ভগবান রক্ষা করুণ তোমায়। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে গত নভেম্বরে আমি তোমাকে পাঁচ ডলার ধার দিয়েছিলাম আর তুমি কথা দিয়েছিলে পরের মাসের প্রথম দিনটাতেই তুমি ফেরৎ দেবে সেটা কিন্তু নতুন বছর পড়ার আগে তুমি দিতে পারো নি।‘
‘আমার মনে আছে সে কথা। কিন্তু এবার আমি কথা দিচ্ছি তোমায়, মাইনে পেলেই তোমার টাকাটা আগে ফেরত দেবো। এবারের মতো আমাকে বাঁচাও তুমি।‘
‘হ্যা, ঠিকই, কিন্তু তোমার কথা রাখতে পারবে না তুমি।‘
‘নিশ্চয়ই রাখবো। কথা দিচ্ছি আমি, আমার সম্মানের দিব্যি।‘
আধ ঘন্টা ধরে এই রকম তর্ক বিতর্ক হবার পর শেষ পর্যন্ত দশ ডলার ধার পেয়েছিলো সে।
২ নং কাহিনী
সেন্ট্রাল সিটিরম্যাকডাফ হার্ডওয়্যার স্টোর্সের মালিক মি. ম্যাকডাফ স্থানীয় এক ব্যাংক থেকে এক হাজার ডলার ধার চায়।
ম্যাডকাফ ব্রাদার্স হার্ডওয়্যার স্টোর্সের মি. জন ম্যাকডাফ স্থানীয় একটি ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি এক হাজার ডলার ধার চান। টাকাটা পরিশোধ করবেন চাষীরা যখন বসন্ত কালের ফসল ওঠার পর তাদের দেনা শোধ করবে সেই সময়।
ব্যাংকের দুজন কেরানির একজন মি. ম্যাডকাফকে অপেক্ষা করতে বললেন, কারণ ম্যানেজার সাহেব অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
ম্যানেজার সাহেব আসলে চাইছিলেন মি. ম্যাকডাফ একটু অপেক্ষা করে দুর্ভোগ ভোগ করুক। তিনি অফিসেই ছিলেন আর ব্যস্ত ছিলেন ট্রাউট মাছ ধরার যোগার যন্ত্র করতে। অবশ্য তিনি জানতেন মি. ম্যাকডাফ কেন এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মি. ম্যাকডাফের যখন ডাক পড়লো তখন দেখা গেলো তিনি তার পদমর্যাদাসুলভ গাম্ভীর্য নিয়েই বসে আছেন।
‘বসুন, মি. ম্যাকডাফ।‘
যখন তারা একসঙ্গে মাছ ধরতে যান তখন ম্যানেজার সাহেব মি. ম্যাকডাফকে জন বলেই সম্বোধন করেন। কিন্তু এখন ব্যাপারটা একটু আলাদা রকমের। মি.ম্যাডকাফ টাকা ধার করতে এসেছেন, আর শহরের এই মধ্যাঞ্চলে টাকা ধার করাটা একটা অপরাধ বলে গণ্য হয়ে থাকে।
‘আমি সেই ঋণের জন্যে এসেছিলাম’ – ম্যাডকাফ বললেন।
ম্যানেজারের দৃষ্টি নিবদ্ধ হিসাবের খাতার ওপর।
‘এখনও সতের ডলার পাওয়া আছে আপনার কাছে।‘
‘আমি জানি। আমার ঋণের ব্যাপারটা চুকে গেলেই ওটার হিসেবে মিটিয়ে ফেলব আমি।‘
তারপর শুরু হলো প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ম্যাকডাফের দৈনিক বিক্রির পরিমাণ কত? শতকরা কত লাভ রাখা হয়? নষ্ট বা বাতিল হয় কতটা? সে কি নিয়মিত গীর্জায় যায়? তার কি ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর আস্থা আছে? ইত্যাদি।
শেষ পর্যন্ত ম্যানেজার যখন এক হাজার ডলার ঋণ দিতে রাজী হলেন ( এরকম রাজি তিনি সবসময়ই হয়ে থাকেন। ) তখন আলোচনা শুরু হলো শর্তাবলী নিয়ে।
‘আপনার অংশীদারকে দিয়েও সই করাতে হবে।‘
‘বেশ।‘
‘আপনার স্ত্রী সই করলেও ভালো হয়।‘
‘ঠিক আছে।‘
‘আপনার মাও তো সই করতে পারেন...’
একটা গ্রামীণ ব্যাংকের এক মাসের জন্য ঋণপত্রে যত সই হয় লোফার্নো চুক্তিপত্রেও অত সই এর দরকার হয় না।
শেষ পর্যন্ত ম্যাকডাফ তাঁর হার্ডওয়্যারের ব্যবসা বন্ধক রেখে তাঁর বাজারের সুনাম, পারিবারিক সম্মান, তাঁর স্ত্রী ও মায়ের সই-এর বিনিময়ে এক হাজার ডলার ধার করতে সক্ষম হলেন।
৩ নং কাহিনী
নিউইয়র্ক ও লন্ডনের লগ্নী কারবার:
পিং পং এন্ড কোম্পানীর মি পি. পিং পয়েন্ট দ্বিপ্রাহরিক আহারের আগেই দশ লক্ষ ডলার ধার পেয়েছিলেন।
ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সুসজ্জিত ঘরে মি. পিং পয়েন্ট প্রবেশ করলেন।
প্রেসিডেন্ট সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন, ‘আসুন, মি. পয়েন্ট। সুপ্রভাত। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি। আমাদের জেনারেল ম্যানেজার আমার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে আপনি দয়া করে আসছেন আমার কাছে।‘
‘ধন্যবাদ,আপনার অফিসটা সত্যিই খুব ভালো।‘
‘সত্যি! এই ঘরটা বেশ আরামদায়ক, আর আমাদের মিটিং-এর ঘরটা আরও সুন্দর। আপনি কি দেখবেন সে ঘরটা?’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আমার হাতে সময় বড়ই কম। আমি মাত্র কয়েক মিনিট সময় হাতে নিয়ে এসেছি আমাদের সেই দশ লাখ ডলার ঋণের ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে।‘
‘হ্যা, আমাদের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট কথাটা বলেছেন আমায়। আপনি যে দয়া করে আসতে পেরেছেন সেইটা আমাদের সৌভাগ্য। ‘
‘না, না, ও কথা বলবেন না।‘
‘আচ্ছা, মাত্র দশ লাখ ডলারেই আপনাদের কাজটা হবে তো?
‘আপনি যদি সাড়ে দশ লাখ ডলার নেট তো আমরা খুশিই হবো।‘
‘এখন দশ লাখ হলেই চলবে। প্রয়োজন হলে অবশ্যই আসবো আবার।‘
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।‘
‘আচ্ছা কোন রকম সিকিউরিটির প্রয়োজন আছে কি? যে কোনও রকম?
‘না, না, তার কোন প্রয়োজন হবে না।‘
‘আমাকে কি এখন কিছু সই করতে হবে?’
‘না, তারও কোন প্রয়োজন নেই। সেসব কাজ কেরানিরাই করতে পারবে।‘
‘ধন্যবাদ, আমি আর বেশি সময় নষ্ট করতে চাই না আপনার।‘
‘চলুন না,আমার গাড়িতে আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি। রয়েছে গাড়িটা, আরও ভালো হয় যদি আপনি আমাদের ক্লাবে আমার সঙ্গে আজকে দ্বিপ্রাহরিক আহারটা সমাধান করেন।‘
‘ধন্যবাদ, আপনি সত্যিকারের ভদ্রলোক।‘
এইভাবে অনায়াসে দশ লক্ষ ডলার হস্তান্তরিত হলো।
কিন্তু এইটাই শেষ কথা নয়, আন্তর্জাতিক ঋণগ্রহণ করার পদ্ধতিটা আরও কত সহজ দেখবেন এর পরেই।
৪নং কাহিনী
আমেরিকার বাজারে ঈঙ্গ-ফরাসী কোম্পানির ঋণপত্র ইস্যু করতে এসেছেন ইল্যাংডের রাইট অনারেবল স্যামুয়েল রথস্টাইন এবং ফ্রান্সের ভাই কাউন্ট ব্যাটন রুজ দ্য সভ শৌরি।
আমেরিকার সংবাদপত্রে খবরটা এইভাবে প্রচারিত হয়েছিলো।
নিউইয়র্ক,শুক্রবার – গতকাল ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের রাইট অনারেবল মি. স্যামুয়েল রথস্টাইন এবং ফরাসি দূতাবাসের ভাই কাউন্ট দ্য সভ শৌরিকে স্ট্যাক ইটানিয়ায় অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়। জানা গিয়েছে যে তারা দশ কোটি ডলার ঋণের জন্য আমেরিকায় এসেছেন এবং মাত্র কয়েকদিন এখানে অবস্থান করবেন।
নিউইয়র্ক, শনিবার- মিসেস বিল্ডারমন্টের ভবনে রাইট অনারেবল সভ শৌরি এবং রাইট অনারেবল স্যামুয়েল রথস্টাইন বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শোনা যাচ্ছে তারা দশ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছেন।
নিউইয়র্ক, মঙ্গলবার – ব্যারণ দ্য সভ শৌরি এবং রাইট অনারেবল স্যামুয়েল রথস্টাইন পোলো খেলার মাঠে বেস বল খেলা প্রত্যক্ষ করেছেন। তারা এখানে এসেছেন দশ কোটি ডলার ঋণ নেবার জন্যে।
নিউইয়র্ক, বুধবার- মি. এবং মিসেস এ্যাশকুপ ভ্যান ডার মুরের আয়োজিত এক নাচের আসরে বিশিষ্ট ইংরোজ ইংরেজ এবং ফরাসি রাজ প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মি. স্যামুয়েল রথস্টাইন ও ব্যারণ দ্য সভ শৌরি। নিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছে তাদের জন্যে দশ কোটি ডলার ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক, (ওয়াগ স্ট্রিট), বৃহস্পতিবার- আজ সকাল এগারোটায় মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দশকোটি টাকার ঋণপত্র গৃহীত হয়। রাইট অনারেবল মি. রথস্টাইন এবং ব্যারন দ্য সভ শৌরি দুপুর বারোটায় টাকা নিয়ে আমেরিকা থেকে চলে গিয়েছেন। দুজন রাজ-প্রতিনিধিই আমেরিকাবাসীর বদান্যতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
ব্যারন বলেছেন, ‘এটাকে আপনি কি বলেন?- নিশ্চয়তা?’
নাটকের শেষ বক্তব্য বা উপসংহার
ছ’মাস পরে কি ঘটেছিলো?
কে ঋণ শোধ করেছিলো? কে ঋণ শোধ করে নি?
হারডুপ জোনস ৫.৪০ ডলার একমাসের মধ্যেই দিয়ে দিয়েছিলো, ৩ ডলার দিয়েছিলো পরের মাসে আর ১.৬০ ডলার দুসপ্তাহ পরে।
ম্যাকডাফ ব্রাদার্স ঋণ পাবার পর ব্যাংক ম্যানেজারর সঙ্গে পুরোনো বন্ধুর মতো মাছ ধরতে গিয়েছিল।
পিং পয়েন্ট সিন্ডিকেট দশ লক্ষ ডলার ঋণ পাওয়া সত্তেও গণেশ ওল্টাতে বাধ্য হয়েছিল।
আর আন্তর্জাতিক ঋণটা অন্য ঋণের সঙ্গে মিলে অন্যান্য হিসাবের অন্তর্গত হয়ে মেয়াদ সীমা পঞ্চাশ বছর বাড়ানো সত্ত্বেও কোথায় হারিয়ে গেলো তা কেউ বলতে পারে না।
নীতি বাক্যটি হলো, যদি ধার করতেই হয়, তাহলে বেশি পরিমাণ ধার করাই যুক্তিযুক্ত।
[হাউ টু বরো মানি; অনুবাদ: মনীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন