একটা এক্সট্রা চিজ ফ্যামেলি সাইজ পিৎজা, দুটো ডাবল পেটি বার্গার এবং এক বাটি রেড চিলি উইথ মেয়োনেজ দিয়ে ভরপুর পাস্তা খেয়ে বদর উদ্দিন ওয়েটারকে ডেকে বললো,‘এক্সকিউজ মি ব্রো, একটা ডায়েট কোক প্লিজ!’
কথাটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার ছিলো। রেস্টুরেন্টের সবাই চমকে উঠে বদরের দিকে তাকালো। সবার চোখ বার্গারের মতই গোল গোল হয়ে আছে। পাশের টেবিলে থাকা একজন তো বার্গারের লেটুস পাতা চাবাতে চাবাতে বলেই বসলেন, ‘একি শুনলাম আমি! আমার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না!’
ভিড়ের মধ্যে ছিলো, দৈনিক ভুখানাঙ্গা পত্রিকার এক রিপোর্টার! তিনি এক চিপায় বসে লেবু চিপে চিপে কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছিলেন। মুখ ভর্তি কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়েই সেই চিপা থেকে বিশেষ দক্ষতায় বদরের একটা ছবি তুলে ফেললেন। ব্যস! তৈরি হয়ে গেলো দৈনিক ভুখানাঙ্গা পত্রিকার জন্য একটা গরম গরম খবর!
সেই খবরের শিরোনাম হলো- স্বাস্থ্যের কদর, বোঝে বদর!
শিরোনামের নিচে লিখলেন- পকেটে ভালো টাকা পয়সা থাকতেও বদর উদ্দিন নামের এই তরুণ শুধুমাত্র একটা ডায়েট কোকের অর্ডার করে আজ অনেক বড় একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এমনটা এই যুগে আর দেখা যায় না। পুরো তরুণ সমাজ যখন চিজ ও মেয়োনেজের ভয়াল কালো থাবায় পিছলে পড়ছে; এই তরুণ সেখানে ডায়েট কোক অর্ডার করে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রমাণ করলেন যে, তিনি কত বড় স্বাস্থ্য সচেতন একজন মানুষ। আমাদের সবার বদরের মত হওয়া উচিত!
এদিকে এমন গরম খবর, তার উপর দেশের বেশির ভাগ মানুষের খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই। ব্যস, খবরটা তাই ভাইরাল হয়ে গেল সোস্যাল মিডিয়ায়। বদর উদ্দিনের নামে চালু হয়ে গেল হ্যাশট্যাগ! ‘বি লাইক বদর!’ মানুষ ‘টয়লেট করে এলাম’ টাইপ স্ট্যাটাসেও হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখতে থাকলো, ‘বি লাইক বদর!’
ওদিকে সোস্যাল সাইটগুলোতে যারা মোটিভেশনাল স্পিচ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তারা হঠাৎ বুঝতে পারলেন তাদের পালে আর হাওয়া নেই! হাওয়ার দিক বদল হয়ে গেছে। সব হাওয়া এখন বদরের পালে! তখনই মোটিভেশনাল স্পিকাররা বদর বন্দনায় ব্যস্ত সময় পার করা শুরু করলেন।
ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু তা হলো না। বদর বন্দনা চলে গেল টেকোদের টক’শোগুলোতে। মাঝরাত থেকে শেষরাত পর্যন্ত টাক মাথার বুদ্ধিজীবীরা টক টক করে প্যাঁচাল পাড়তে পাড়তে মুখে ফেনা তুলে ফেললো। এতে বদরের ছড়ালো নাম, আর ওই টেকো বুদ্ধিজীবীরা পেল হলুদ খাম!
ঘটনা এখানেও থামলো না। আরো এগিয়ে গেল। সোস্যাল সাইটগুলোতে বদর উদ্দিন ফ্যান ক্লাব খোলা হলো। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়লো! সবার মুখে এক কথা, বদর আসলেই দেখায় দিছে! তবে সব ভালোর কিছু মন্দ দিকও থাকে। বদরের এই ইস্যুর মন্দ দিকেও অনেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারা প্রমাণ করতে চায় সবই আসলে বদরের ধান্দাবাজি! ফেমাস ও নিউজ হওয়ার জন্য সে ইচ্ছা করে এসব করেছে! তারা হ্যাশট্যাগ দিলো, ‘ফ্রডবদর!’
তবে এসব আলোচনা বা সমালোচনা নিয়ে বদর উদ্দিনের কোন মাথা ব্যথা নেই। সে এখন দেশের অন্যতম একজন সেলিব্রেটি। সেলিব্রেটিদের এই টাইপের মাথা ব্যথা থাকতে নেই। সেলিব্রেটিদের মাথা থাকবে কিভাবে নিজেকে আরো ভাইরাল করা যায় সেটা নিয়ে। বদর উদ্দিন এখন তাই নিয়েই ব্যস্ত। প্রায়ই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার সাঙ্কাৎকার ছাপা হচ্ছে! টিভি চ্যানেলে এসে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী মত বিনিময় করছেন! এক ভাইরালেই বদর উদ্দিনের জীবন বদলে গেল।
অনেক দূরে বসে বদর উদ্দিনের এই জনপ্রিয়তা দেখে ভিতরে ভিতরে হিংসায় জ্বলতে লাগলো তারই ছোটবেলার বন্ধু কামরান! নিজেকে কিভাবে ভাইরাল খবর বানানো যায়, তাই নিয়ে দিনরাত ভাবতে লাগলো। হঠাৎ তার মাথায় একটা আইডিয়া আসে! সে ফোন করলো তার হবু বউকে।
‘হ্যালা জান্টু প্রান্টু!’
‘আলগা আলাপ না পাইরা কও কী কইবা?’
‘রেগে আছো নাকি?’
‘রাগবো না! তোমার দাঁত উঁচা বন্ধু বদরও ভাইরাল হয়ে গেল! আর তুমি জীবনে কিছুই করতে পারলা না! এলাকার কুকুরগুলোও তোমাকে চিনে না! দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে!’
‘এবার আমিও ভাইরাল হবো! শুধু আমি না। আমার সাথে তুমিও ভাইরাল হবে!’
‘কী? ভাইরাল হব তুমি আমি? কিভাবে?’
‘একটা মারাত্মক আইডিয়া পাইছি!’
‘আবার আলগা আলাপ শুরু করলা? কী কইবা ডাইরেক্ট কও! তোমার আইডিয়াটা কী?’
‘ইয়ে মানে বলছিলাম কি, আমাদের বিয়েটা সাদামাটা ভাবে করলে হয় না?’
‘সাদামাটা মানে?’
‘সাদামাটা মানে একদম সাদামাটা। কোন জাঁকজমক ব্যাপার স্যাপার বিয়েতে থাকবে না!’
‘মানে কী! তুমি কি আমাকে ২০ ভরি গয়না দিতে চাচ্ছো না?’
‘আরে না না, গয়না তো ২০ ভরিই দিব!’
‘তাহলে কী বৌ ভাতে আমার বাপের বাড়ির দুই হাজার লোকরে কাচ্চি খাওয়াচ্ছো না?’
‘আরে না না, তোমার আমার বাড়ির গেস্ট সহ প্রায় চার হাজার লোকের কাচ্চির আয়োজন থাকবে! শুধু তাই নয়, সাথে খাসির মাংসের রেজালা, দেশি মুরগীর রোস্ট, গরুর কালা ভুনা, ফিন্নি, কোক, বোরহানি সবই থাকবে! এমন কী খাবার শেষে শাহী পানের এন্তেজামও থাকবে!’
‘তাহলে কি বিশ লাখ টাকা দেনমোহর করছো না?’
‘আরে না না, দেনমোহর বিশ লাখ টাকাই থাকবে!’
‘তাহলে সাদামাটা কী করবা? আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা।’
‘আমি ভাবতেছি আমার দাদুর কালো কালো তিলা পড়া পাঞ্জাবিটা পড়ে বিয়ে করতে আসবো! নিচে থাকবে দাদুরই ফুটা হয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা!’
‘ইমা ছিঃ কি ঘেন্না! তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?’
‘আরে ঘেন্নার কি আছে? আর মাথাই বা খারাপ হবে কেন? একবার ভাবো তো, এই ভাবে বিয়ে করলে সবাই একদম চমকে যাবে। আমাদের সাদামাটা বিয়ের খবর সোস্যাল সাইটগুলোতে ভাইরাল হয়ে যাবে! শুধু দেশে নয়। দেশের বাইরেও আমাদের নিয়ে আলোচনা হবে! তুমি আমি এক বিয়ে করেই সেলিব্রেটি হয়ে যাব!’
‘আরে জোশ! আইডিয়া তো খারাপ না!’
‘আরো আছে! আমরা পুরনো পোশাক পড়ে বিয়ে করবো। দেশবাসী জানতে চাইবে, কারণ কী? আমরা তখন মন খারাপ করে বলবো, যে দেশে গরীব দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে সে দেশের বিয়েতে এত বিলাসিতা মানায় না!’
‘তারপর?’
‘তারপর আর দেখতে হবে না! আমাদের কিছু করতেও হবে না। যা করার মানুষই করবে! আমাদের বিয়ে হবে ভাইরাল! আর আমরা হয়ে যাব সেলিব্রেটি! মানুষ ফেসবুকে আমাদের বিয়ের ফটো শেয়ার করবে!’
‘মানুষ কেন এসব করবে?’
‘করবে কারণ মানুষের হাতে খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই!’
‘জোশ তো! আমিও তাহলে আমাদের বুয়ার শাড়িটা পড়ে বিয়ের পিড়িতে বসবো!’
‘ওয়াও! দারুণ লাগবে তোমাকে! আমি এখনই কল্প দৃষ্টিতে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি!’
‘সো সুইট! আমি রাজি জানু! আমরা এমন সাদামাটা ভাবেই বিয়ে করবো!’
‘আমার লক্ষ্মী জান্টু প্রান্টু!’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন