২০৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। চলছে অমর একুশে বইমেলা। এই বইমেলায় দেশের সবারই বই বের হয়েছে। গাড়োয়ান থেকে দাড়োয়ান, অফিসের বস থেকে পিওন, বাড়ির গৃহকর্তা থেকে চাকর, বাসের ড্রাইভার থেকে হেলপার, বাড়িওয়ালা থেকে ভাড়াটে, সিনেমার নায়ক থেকে ভিলেন, ক্রিকেটার থেকে পিকেটার, ফুটবলার থেকে হকার, রক্ষক থেকে ভক্ষক, আমলা থেকে কামলা, নাহ! কেউই বাদ যায়নি। সবাই এবার বই বের করেছে। পুরো বইমেলা গিজগিজ করছে। কেবল মানুষ আর মানুষ। কিন্তু কোনো বেচা বিক্রি নেই। থাকবেই বা কী করে? বই কেনার মতো তো কোনো পাঠকই আর দেশে নেই। এখানে সবাই লেখক!
লেখকরা নিজ নিজ স্টলের সামনে কলম হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্য কোনো লেখক ভুল করে বা বেখেয়ালে কারও বই হাতে নিলেই বইটা কেড়ে নিয়ে সেখানে অটোগ্রাফ দিয়ে দাম চেয়ে বসছেন। তাই ভুল করেও কেউ কারও বই আর ধরছেন না।
লেখক বদর আলী বাসা থেকে বিশাল এক পাতিলে করে গরম গরম বিরিয়ানি রান্না করে এনেছেন। কেউ তার একটা বই কিনলেই ফুল প্লেট বিরিয়ানি ফ্রি ভক্ষণ করার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেই গরম বিরিয়ানিও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কেউ বই কেনেনি।
কবি কামরান খায়ের আজও অ্যাডাল্ট ডায়াপার পরে বইমেলায় এসেছেন। তারপর নিজের বইয়ের স্টল দখল করে সেই সকাল থেকে বসে আছেন। তার মনে ভয়, স্টল রেখে জরুরি কাজ সারতে গেলে জায়গাটা যদি দখল হয়ে যায়! তখন কী হবে? তাই তিনি সেই রিস্কে যাননি। কিন্তু এখন অন্য একটা রিস্ক তিনি ঠিকই টের পাচ্ছেন। ডায়াপারটা বেশ ভারি হয়ে গেছে। যে কোনো সময় খসে নিচের দিকে পড়ে যেতে পারে। কবি কামরান খায়ের তবুও খিঁচ মেরে বসে আছেন। ইজ্জত গেলে যাক। তবুও স্টলের টুলটা ছাড়া যাবে না।
লেখক কদম মুন্সী তার প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা তিন রাত চার দিনের স্পেশাল ট্যুর প্যাকেজ দিয়েছেন। ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা প্রতিদিন উড়োজাহাজ উড়ে গেলেও কদম মুন্সীর একটা বইও উড়েনি। ইয়ে মানে বিক্রি হয়নি।
এমনি আরও নানা রকম লোভনীয় অফারের ছড়াছড়ি বইমেলায়। কিন্তু কোনো পাঠক নেই। তাই বলা যায়, একরকম ঝিম মেরেই আছে এবারের ২০৫০ সালের এই বইমেলা।
হঠাৎ করে মেলার মধ্যে একটা ব্যস্ততা লক্ষ করা গেল। কবি-লেখকসহ প্রকাশকরা সবাই মেলার প্রবেশ পথের দিকে ছুটতে লাগলেন। এমনকি কবি কামরান খায়েরও তার ভারি ডায়াপার নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ছুটতে শুরু করল। টিভি ক্যামেরা নিয়ে রিপোর্টাররাও ছুট লাগাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বইমেলায় খবর রটে গেল, একজন ভিভিআইপি আসছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল। তারা ভিড় সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঝিম ধরে থাকা বইমেলাটা হঠাৎ করেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো।
বইমেলায় খবর ছড়িয়ে পড়ল, দেশের এক পাঠক নান্টু মিয়া আজ মেলায় আসছেন। তিনিই আজকের এই বইমেলার ভিভিআইপি। কারণ বিগত কয়েক বছরের বইমেলা থেকে আজ পর্যন্ত তিনিই দেশের একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তি পাঠক। বাকিরা তো সব লেখক হয়ে গেছেন! লেখক হয়েই আছেন।
কবি ও লেখকরা যার যার বই নিয়ে মেলার প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে। লেখক বদর আলী তার বই ও বিরিয়ানির বিশাল পাতিল নিয়ে প্রবেশ পথের একটা কোনা দখল করে বসলেন। বিরিয়ানি আবার গরম করা হয়েছে। বদর আলীর ইচ্ছা দেশের এক পাঠক নান্টু মিয়া মেলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে নিজের লেখা বই ও এক প্লেট বিরিয়ানি ধরিয়ে দিবেন। সুযোগ মিস করা যাবে না। গতবার লটকন লুতকুর নামে এক লেখক নান্টু মিয়ার কাছে একটা বই বিক্রি করতে পেরেছিল। সেবার সে এক বই বেচেই মেলার বেস্ট সেলার লেখক হয়ে যায়। বদর আলীও এবার বেস্ট সেলার হতে চাইছে। শুধু বদর আলীই নয়। মেলার সব লেখকেরই উদ্দেশ্য কোনো রকমে নান্টু মিয়ার হাতে নিজের লেখা একটা বই ধরিয়ে দেয়া। তা হলে তারাও বেস্ট সেলার লেখক হয়ে যেতে পারবে। কেউ তাদের আটকাতে পারবে না।
বইমেলার প্রবেশ পথে লাল গালিচা বিছানো হয়েছে। ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। ব্যারিকেডের ভেতরে সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে, কখন আসবেন দেশের একমাত্র পাঠক নান্টু মিয়া। ভিড় সামলাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। সব টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়া প্রস্তুত হয়ে আছে।
অতঃপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! মেলার মূল প্রবেশ পথের সামনে রিকশা থেকে নামলেন দেশের একমাত্র পাঠক, জীবন্ত কিংবদন্তি, নান্টু মিয়া। নান্টু মিয়াকে একনজর দেখেই সবাই চিৎকার করে উঠল। উত্তেজিত হয়ে গেল লেখক জনতা। নান্টু মিয়া প্রবেশ পথের কাছে আসতেই দুদিক থেকে অর্ধশত আইন শৃঙ্খরা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে মেলার ভেতরে নিয়ে আসলো। মেলায় আজ সাজ সাজ রব। মেলায় আজ প্রাণ ফিরে এসেছে।
সবাই তার নিজ নিজ বই নান্টু মিয়ার নজরে আনার জন্য উঁচু করে ধরে আছে। নান্টু মিয়া হাসি মুখে সবার দিকে তাকিয়ে আছেন। সবার উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে একজন আবেগী লেখক ছুটে এলো নান্টু মিয়ার দিকে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নান্টু মিয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'ভাই, আমরা "ঝাপসা আয়না" বইটা কিনেন! আপনি না কিনলে আমি এখনই সুইসাইড খামু! ই-ই-ই...!’
মুহূর্তেই তৎপর হল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেই আবেগী লেখককে ধরে সুইসাইড খাওয়ার আগেই সাইডে নিয়ে গেল।
মাইকে ঘোষণা আসলো, ‘সুপ্রিয় লেখকরা, কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে। আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। এখুনি মাইকে বক্তব্য রাখবেন, দেশ বরেণ্য পাঠক, জনাব নান্টু মিয়া। যদি আপনারা শান্ত হয়ে না বসেন, তা হলে দেশের একমাত্র পাঠক নান্টু মিয়া কিন্তু চলে যাবেন। কোনো বই কিনবেন না!’
ঘোষণায় কাজ হলো। মেলার সবাই চুপ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে মাইকের সামনে আসলেন নান্টু মিয়া। উল্লাসে আবার ফেটে পড়ল পুরো বইমেলা। সেই উল্লাসের মধ্যে নান্টু মিয়া চিকন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আপনাদের এই ভালোবাসার কারণেই প্রতি বছর আমি বইমেলায় আসি। তবে এবার আপনাদের ভালোবাসা ছাড়াও আমার এখানে আসার বিশেষ একটা কারণ আছে। কারণটা জানলে আমি জানি, আপনারা খুবই খুশি হবেন। এবার বইমেলায় তালগোল প্রকাশনী থেকে আমারও একটা বই আসছে!’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন