সিগারেটের তামাক সরু তার দিয়ে পটু হাতে বের করে চেটোয় রাখল নীতা, তারপর কাগজের পুরিয়া খুলে বস্তুটি মেশাল সেই তামাকে। পুনরায় ফাঁকা সিগারেটটা নব্য মশলা দিয়ে টাইট হয়ে যেতেই একটা অপার্থিব আনন্দ ফুটল নীতার মুখে। অদ্ভুত উচ্চারণে ইংরেজি বলল সে, কে প্রথম ভালোবাসবে?
তিনটি হাত উঠল। জিনা বলল, হাই, আমি ভালোবাসার জন্যে মরে যাচ্ছি!
সীতা মাথা নাড়ল, ও মাই সুইটি স্টিক, লিটল স্টিক!
নীতা চোখ পাকাল, সিলি! একজন হাত তোলেনি। অতএব সেই শুরু করবে। সিগারেটটা এগিয়ে দিল সে রিয়ার দিকে।
নীতাদের এই ঘরভরতি বই, এত বই, বিভিন্ন বিষয়ের যে রিয়ার মনে হয় এখানে তাকে সারাজীবন বন্দি করে রাখলে ক্ষতি হত না। এই ঘরে কোনো চেয়ার নেই। দামি কার্পেটের ওপর আধশোয়া হয়ে ও ফিউচার শক পড়ছিল। মুখ না তুলে হাত নাড়ল, নো, আই কান্ট স্ট্যান্ড।
ইটস মাইনড। ফ্রেশ ফ্রম মণিপুর। নীতা উঠে দাঁড়াল সিগারেটটা নিয়ে, কী বই ওটা? ফিউচার শক? দ্যাটস রাবিশ। টেক দিস শক অ্যান্ড ইউ উইল ফিল সামথিং!
রিয়া বান্ধবীদের দিকে তাকাল। ওই সিগারেটের ভেতর আজনীতা কি পুরেছে তা সে জানে না। হয়তো কোনো ড্রাগ, পাউডার বা স্রেফ গাঁজা। কড়া ধাতের গাঁজা। আর তার টান নেওয়ার জন্যে প্রত্যেকে উদগ্রীব। এই সব মেয়েরা, রিয়ার বন্ধুরা ছেলেদের পাত্তা দেয় না। প্রেমট্রেম এদের ধাতে সয় না। ওদের জিজ্ঞাসা করলেই বলবে, যে-কোনো একটা লোককে তুলে নাও এবং তার নাম দাও, যে কোনো নাম দাও, দেখবে সেই লোকটাকে ওই নামে চমৎকার মানাবে। ছাত্রী হিসেবে এরা প্রত্যেকেই ভালো ছিল, পড়াশুনা কারোরই খারাপ নয়।
উই লিভ অন ড্রাই।
এই কথাটা এখন খুব চালু নিজেদের মধ্যে। ডোন্ট গো ফর ওয়াটার, উইলিভ অন ড্রাই। নীতাদের এই ঘর, এই আড্ডা রিয়ার খারাপ লাগে না। শুকনো মাদক তাকে তেমন টানে না। মাঝেমধ্যে সঙ্গ রাখার জন্যে সে দু একটা টান দেয় মাত্র। সেই মুহূর্তে মাথার ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। শরীরে ঝিম লাগে। অলস অবসন্ন সময় ফুড়ুৎ করে ফুরিয়ে যায়।
কিন্তু বেশিরভাগ দিনই সে বই নিয়ে আধশোয়া হয়। নীতার এই ঘরের বাড়ি কেউ ঢোকে না, ঢুকবে না। বাড়ির কেউ বলতে নীতার মা। বাবা থাকেন জলে। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। জাহাজের কাজে। মা সোস্যাল ওয়ার্কার। প্রায় প্রত্যেকের, এই ঘরে যে সব মেয়ে আছে, প্রায় প্রত্যেকের মা ডিগনিফাইড সোশ্যাল ওয়ার্কার। এক একটি চিজ সব। রিয়ার নিজস্ব মা পর্যন্ত। কোয়ালিটিতে দুপুরের বিয়ার পার্টিতে না গেলে সামাজিক কর্তব্য করা হয় না।
নীতার প্রসারিত হাতের দিকে তাকিয়ে রিয়ার হঠাৎ মনে পড়ল ওর কোনো আত্মীয় নেই। বাবা মা এবং সে। সত্যি কথা বলতে কি, ওর বান্ধবীদেরও একই দশা। কারও কারও হয়তো একটি ভাই বা বোন থাকতে পারে, কিন্তু সেইসব পিসি মাসি কাকা কাকিমাদের দিন ওভার। তাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে ওসব মানুষ জন্মইস্তক আসেননি। বাবা রাখেননি তার পূর্ব-পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ, মা ছেদ করেছেন তার বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক।
সিগারেটটা হাতে নিয়েই হেসে ফেলল রিয়া। সীতা জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? এটা কি তোমাকে হাসির কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে?
নো। ছোট পরিবার সুখী পরিবার।
সো। হোয়াট?
আমাদের পরিবারগুলো এত ছোট যে বাড়ি গেলে কেউ কারও দেখা পাই না। আগুন জ্বালাও।
একটা নীলচে আগুন আর তারপরই গলা দিয়ে নেমে যাওয়া ধোঁয়ার সোয়াদ চোখে আবেশ আনল। রিয়া টের পেল না সিগারেটটা ততক্ষণে হাতবদল হয়ে গেছে। উটক একটা গন্ধ তখন ঘরে পাক খাচ্ছে।
ফিউচার শক বইটা সরিয়ে রেখে দু পা ছড়িয়ে বসল রিয়া। আজ শুক্রবার। কারও বাড়িতেই খোঁজখবর করার কেউ নেই রাত দুটোর আগে। উইকঅ্যান্ড কাটাতে বাবা-মায়ের দল কলকাতার লম্বা লম্বা ফ্ল্যাটবাড়ির যে কোনো একটায় ড্রিংকস নিয়ে বসে গেছে। কিংবা ভি.সি. আর-এ লেটেস্ট হট কিছু একটি তাদের সময় জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এই চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে থমকে থাকা বাবা এবং মায়েরা সারা সপ্তাহ খেটে আজ বড্ড ক্লান্ত। তাই নীতারা চুটিয়ে আনন্দ নিচ্ছে গলায়।
হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে টলে গেল রিয়া। তারপর নিজেকে সর্তক করে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। এই সময় টয়লেট ছাড়া কেউ কোথাও যায় না। মাঝরাতে নীতার গাড়ি প্রত্যেককে ড্রপ করে দেবে দেশলাই বাক্সমার্কা ফ্ল্যাটগুলোর গেটে। ওই বুড়ো ড্রাইভারকে সবাই জনি বলে ডাকে আদর করে। রিয়ার তো ওই কালো বৃদ্ধটিকে দেখলেই আংকল টমের কথা মনে পড়ে। হি ইজ সো নাইস! নেশাগ্রস্ত কয়েকটা মেয়েকে কি মমতায় ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিয়ে যায়। নীতার বাবা-মা, বোধহয় সে খবর রাখে না।
পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িটা ছেড়ে রিয়া বেরিয়ে এল। ওর পরনে জিনস আর সাদা শার্ট। পায়ে হাওয়াই চটি। বাইরের ঠান্ডা বাতাসটার স্পর্শ পাওয়ামাত্র মাথা ধরে গেল আচমকা। কেমন বমি-বমি পাচ্ছে। এখন রাত অনেক। কত? হু কেয়ারস? নীতাদের বাড়ি থেকে ওদের ফ্ল্যাটটা বেশি দূরে নয়। এই সব বড়লোকি পাড়ার রাস্তায় চমৎকার আলো জ্বলে। বাস ট্রাম চলে না। মাথা ধরা সত্বেও হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল ওর। ওদের বাড়িতে নিষিদ্ধ একটি গান হঠাৎ চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করল, দোলাও-দোলাও আমার হৃদয়!
বাংলা পড়তে জানে না রিয়া, কারণ তাকে কখনও সেটা পড়ানো হয়নি। বাড়িতে কোনো বাংলা গল্পের বই নেই। থাকলেও সেটা হিব্রু কিংবা টিবেটিয়ান বলে মনে হত রিয়ার কাছে। নেই তাই রক্ষে। বাংলা রেকর্ড নেই। মা বলে, বাংলা গান মানেই তো প্যানপেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত। শুনলেই নপুংসকদের কথা মনে হয়।
বাবা বলেন, রবীন্দ্রনাথের বাইরেও গান আছে হনি ছিলও।
মা খিলখিল করে হেসেছিলেন, সকল দেশের সেরা আমার জন্মভূমি? ওই মিথ্যে কথা সুর করে গাইলেই গান বলতে হবে? বি স্মার্ট রিয়া, জীবনটাকে টগবগে করো, বাঙালি, সেন্টিমেন্ট ধোপার দেওয়া মাড়ের মতো। সুতির কাপড় শক্ত করে কিন্তু দুর্গন্ধ ছড়ায়। ওসব এ বাড়িতে বলবে না।
দোলাও-দোলাও আমার আপন, লিফটম্যানকে দেখে চুপ করে গেল রিয়া।
এই লোকটা বাঙালি। যদি গানটা জানা থাকে তাহলে হয়তো ভুল ওয়ার্ডিং কিংবা টিউন ধরে ফেলবে। সোঁ-সোঁ করে ওদের ফ্লোরে চলে এসে শান্তি।
তিনবার বোতাম টিপল রিয়া। ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই। তারপর হিপপকেট থেকে কিছু টাকা আর চাবি বের করল। এই ফ্ল্যাটের তিন বাসিন্দার জন্যে তিনটে চাবি বরাদ্দ। যে যখন ইচ্ছে ঢোকো এবং বের হও।
ড্রইংরুমেই পরিচিত দৃশ্য। বাবা চিত হয়ে পড়ে আছেন সোফায়। মাথার পাশে পিটার স্কটের বোতলটা খালি। গ্লাসে এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। টাই দূরের কথা, জুতো পর্যন্ত খোলেননি বাবা। মুখ হাঁ। আউট, মাই পাপা ইজ আউট! রিয়া এগিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়াল। সামান্য ঝুঁকল। কালো রং সামান্য ফেড হয়ে যাওয়ায় লালচে রূপোলি চুল ঝিলিক মারছে। এই মুহূর্তে বাবাকে খুব বুড়ো মনে হচ্ছিল। বুড়ো এবং অসহায়। কফিনে শুইয়ে দিলে বোধহয় চমৎকার শান্তি পেত। ভোর অবধি এইভাবেই পড়ে থাকবেন বিখ্যাত কোম্পানির ডিরেক্টর। সকালে ক্লিন শেভড হয়ে। ঝকমকে হাসবেন, বলবেন, হাই।
রিয়া মায়ের ঘরের সামনে দাঁড়াল। নীলচে আলো জ্বলছে। কোনো শব্দ নেই। সে নিচু গলায় ডাকল, মাম্মি! দুটো মুহূর্ত, কোন সাড়া এল না। ভারী পরদা সরিয়ে পা বাড়াতে শূন্য ঘর চোখে এল। ঘড়িতে তখন দুটো কোকিল পালা করে ডেকে জানাল বারোটা বাজছে। মায়ের বিছানার পাশেই ম্যাগনেটিক রিসিভার। নয়ের্ক থেকে আনানো। কডবিহীন রিসিভার নিয়ে এই ঘরের যে-কোনো প্রান্তে গিয়ে কথা বলা যায়। রিয়া টেলিফোনের বোতামটা টিপতেই মায়ের কণ্ঠস্বর কানে এল, হাই, গোয়িং আউট ফর দ্য নাইট। ডোন্ট ওয়েট ফর মি।
বোতামটা ছেড়ে দিতেই ঘর শান্ত। মেসেজ রেখে গেছেন সোশ্যাল ওয়ার্কার। উইকঅ্যান্ড কাটাতে গেছেন তিনি। সারারাত আমি চরে বেড়াব, আমার জন্যে কেউ বসে থেকো না। অন্তত বাবা বসে থাকেননি। ছাব্বিশ আউন্স পেটে পুরে সটান পড়ে আছেন।
এই বাড়িতে ঝি-চাকর নেই। ঠিক নেই বললে ভুল হবে। একটা নেপালি ছোঁড়া আসে ভোরে। ব্রেকফাস্ট করে দিয়ে চলে যায়। আর সব সেলফ হেল্প। মা বলেন, পৃথিবীর যে কোনো সভ্যদেশে এটাই নিয়ম। তোমার খাবার তুমিই করে নেবে। ফ্রিজে সব রাখা আছে। সপ্তাহে দু দিন মায়ের ড্রাইভার সেগুলো কিনে এনে দেয়। যেহেতু ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় তাই নেপালিটির আগমন, নইলে, সেটাও বন্ধ হলে মা খুশি হতেন। বাবার সমস্ত আধুনিকতা এখানেই হোঁচট খায়। কিন্তু এই বাড়িতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মায়ের। লাঞ্চ ডিনার বাড়িতে খাচ্ছে এমন দিন হাতে গোনা যায়।
নিজের ঘরে ফিরে এল রিয়া। এখন তার শুয়ে পড়া উচিত অথচ ঘুমের কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং মাথা ধরে আছে। এই ছোট পরিবারে কেউ নেই যার সঙ্গে কথা বলা যায়। খুব আফসোস হচ্ছিল ওর। ফট করে না উঠে এসে নীতাদের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কাটালে নেশাটা জমত। আচ্ছা, এখন স্নান করলে কেমন হয়?
টয়লেটের সঙ্গেই শাওয়ার। জানলাটা খুলতেই ঝকঝকে আকাশ চোখে পড়ল। নীতাদের ওখান থেকে আসবার সময় খেয়াল হয়নি আজ জ্যোৎস্নার রাত। একটু বেড়ালে কেমন হয়? একটু ঘুরে বেড়ালে এই রাতদুপুরে? চমচমে জ্যোৎস্না কীরকম কিলবিল করতে লাগল রিয়ার সামনে। সে পোশাক না ছেড়ে বেরিয়ে এল। পিতৃদেব তখনও একই অবস্থায় পড়ে আছেন। বাবা কতদিন তাঁর বাবাকে দ্যাখেননি কে জানে? রিয়া শুনেছে ওই বুড়ো মানুষটা মালদার একটা গ্রামে বাস করেন। বাবার মা মারা যাওয়ার খবর এলে যেসব নিয়ম পালন করতে হয় তা এ বাড়িতে করা হয়নি। তখন রিয়া আরও ছোট ছিল, কেন হয়নি তা সে জানে না। তবে সেই মুহূর্তে মায়ের। আড়ালে বাবাকে খুব দু:খী বলে মনে হয়েছিল, তা ঠিক। এই সময় যেমন বাবাকে খুব সরল বলে মনে হচ্ছে, ঘুমন্ত মানুষ কোনো প্রিটেনশন করতে পারে না এই জন্যেই কি?
দরজা খুলে বেরিয়ে এল রিয়া। লিফট নয়, সিঁড়ি ভেঙে সে নামছিল। নামবার সময় অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছিল। আমার শরীর ঠিক আমার নয়। পৃথিবীর গভীর থেকে নিঃশব্দে হেঁটে যাওয়ার মতো এই নামা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। এই সফিস্টিকেটেড ম্যাচবক্স বসতিটার মানুষজন বাইরে নেই। শুধু আমিই নেমে যাচ্ছি।
গেটের বাইরে এসে তার মন ধাতে এল। কোথায় যাওয়া যায়? এসব জায়গায় ডাকাতি বা ছিনতাই হয় বলে শোনা যায় না। আমি একটু আমার মতো পৃথিবীতে হাঁটতে চাই, খামোকা, কেন তাতে বাধা দেবে কেউ? নিজের কাছে গড়ে নেওয়া এই সরল বিশ্বাসে আশ্বস্ত রিয়া পা। ফেলতে লাগল। ভালোবাসার গন্ধের মতো কিংবা ঘুমন্ত শিশুর হাসির মতো একটা জ্যোৎস্না বেরিয়ে আসছিল চাঁদের শরীর থেকে। আর তাতে ক্রমশ জবজবে হয়ে যাচ্ছিল রিয়া। এমন একটা সুখের সন্ধান সে কখনও পায়নি। এরকম রাত কখনও বলে না ডোন্ট ওয়েট ফর মি। বরং সেই দোলাও-দোলাও শব্দ দুটো বারংবার ফিরে-ফিরে আসে।
রিয়ার খেয়াল হলো লেকটার কথা। মাত্র মিনিট পাঁচেক দূরে সেই লেকটা, যেখানে এককালে সে বেড়াতে যেত। তখন একটা আয়া ছিল তার জন্যে। ফুটফুটে অনেক বাচ্চা আমাদের গা ঘেঁষে বসে জল দেখত। অনেককাল সেখানে যাওয়া হয়নি, আজ গেলে কেমন হয়?
জ্যোৎস্নারাত্রে জলের মতো সুন্দরী আর কেউ হয় না। আকাশের মুখ জলের বুকে সাঁতারে। ভালোবাসার ঘ্রাণ নেয় চাঁদের সঙ্গ পেয়ে। একটা স্ট্যাচুর ধাপে বসে রিয়া এই দৃশ্য দেখছিল।
কখন চাঁদ মরে গেছে, কখন রাত ফুরোল, কখন জলের রং কালো হল রিয়া জানেনি। কারণ তার শরীর শীতল বাতাস পেয়েছিল, মাথা হেলেছিল স্ট্যাচুর স্তম্ভে। হালকা ঘুম ছড়িয়ে প্রকৃতি তার রাতের শেষ খেলা খেলে নিল। এবং তখনই কানে এল কিছু শব্দ। উদাত্ত গম্ভীর কণ্ঠে কেউ কিছু শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে। যার সুর এবং ধ্বনি অদ্ভুত একটা মায়ালোক তৈরি করে ফেলছে চারপাশে। রিয়া দেখল ভোর হচ্ছে। আকাশের অনেকটাই এখন লাল ছোপ মেখেছে। শব্দতরঙ্গ তাকে কৌতূহলী করছিল। ধীরে-ধীরে সে পা বাড়াল।
গাছের আড়াল সরতেই তার দৃষ্টিতে এক দীর্ঘকায় মানুষ ধরা দিলেন। তার দুটো হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে আবদ্ধ। পরনে ধুতি এবং সাদা ফতুয়া। তন্ময় হয়ে সূর্যের প্রতীক্ষায় মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। সেই মন্ত্রের অর্থ রিয়ার জানা নেই। শব্দগুলো তার অবোধ্য। তবে সংস্কৃত বাক্যগুলোকে উচ্চারণে অনুমান করতে পারল সে। ঠিক সেই সময় আকাশকে চমকে দিয়ে জলের ওপর উঁকি মারল দিনের প্রথম সূর্য। লাল সোনালি আভায় পৃথিবী ছেয়ে যেতে বৃদ্ধ মন্ত্রপাঠ শেষ করলেন। তারপর প্রণাম জানিয়ে ফিরে দাঁড়াতেই রিয়ার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। রিয়া হাসবার চেষ্টা করল, হাই!
বৃদ্ধ বললেন, হ্যালো!
রিয়া প্রশ্ন করল, তুমি এতক্ষণ কী করছিলে?
বৃদ্ধ জবাব দিলেন। তার উচ্চারণে দক্ষিণ ভারতের টান, প্রার্থনা করছিলাম। যাতে সূর্য ওঠে, অন্ধকার দূর হয়। তুমি বুঝতে পারোনি?
মাথা নাড়ল রিয়া, না।
সেকী? তুমি তো ভারতীয়, তুমি সূর্যস্তোত্র শোননি?
ভারতীয়! রিয়া মাথা নাড়ল, আমি জানি না। তুমি কী বলছিলে এতক্ষণ?
দক্ষিণ ভারতীয় বৃদ্ধটি বললেন, আমি প্রার্থনা করছিলাম যাতে সূর্যদেব ওঠেন, জগতের মঙ্গল হয়, কারণ অন্ধকার মানেই অপবিত্র।
রিয়া জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু এই প্রার্থনায় তোমার কি উপকার হবে? তোমার তো বয়স হয়েছে, তাই না?
বৃদ্ধ বললেন, বয়স? হ্যাঁ, তা হয়েছে। কিন্তু তোমরা যারা পৃথিবীতে আছ, অনেকদিন থাকবে, এই প্রার্থনা তাদের উপকারে আসবে। আমরা সবসময় কি নিজের জন্যে সবকিছু করি?
ঠিক সেই সময় একটি কিশোর দূর থেকে চিৎকার করে উঠল। ছুটে আসছিল সে পাগলের মতো। এসে জড়িয়ে ধরল বৃদ্ধকে। তারপর দ্রুত নিজের ভাষায় কিছু বলে গেল। বৃদ্ধ সস্নেহে। তাকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যেতে রিয়া আবার প্রশ্ন করল, এ তোমার কে হয়?
নাতি। আমাকে ডাকতে এসেছে।
কেন?
আমার ছেলে আর বউমা চায়ের টেবিলে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, তাই।বৃদ্ধ হাসলেন। তারপর চলে যেতে-যেতে বললেন, বাই!
শূন্য জলের ধারে ভোরের রোদ কখনও-কখনও জ্যোৎস্নার চেয়েও সুন্দরী করে তোলে প্রকৃতিকে। সেই আলোয় আলোকিত রিয়া জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল। সে দেখল তার ঠোঁট নড়ছে। আর সমস্ত শরীর মন্থন করে অমৃতের স্বাদ মাখা একটা শব্দ সেই ঠোঁটের ফাঁক গলে পৃথিবীর শরীরে মিশে গেল, বা-ই! তারপরেই বুক ভরে বাতাস নিল সে। নিয়ে বলল, বাই দাদু!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন