ধারাবাহিক উপন্যাস
প্যাসেজ টু হেভেন (পর্ব-৮)
বেহেশতে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে; লীথি নদীর ঘাটে একটি অলৌকিক লঞ্চ এসে ভিড়েছে; বেশ কিছু মানুষ নিয়ে। তারা জানাচ্ছে তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। দেবুদা তড়িঘড়ি করে পৌঁছে যায় থ্যানাটস ঘাটে। সেখানে তাজউদ্দীন রয়েছেন; উনি সবাইকে সমবেদনা জানাচ্ছেন; কদিন প্রিয় মানুষের জন্য কষ্ট হবে তারপর সয়ে যাবে। এটাই জীবন। মানুষের অমোঘ নিয়তি।
কল্পনা চাকমা এগিয়ে আসে; চিৎকার করে বলে; কী হবে পৃথিবী নামের দোজখে ধুকে ধুকে বেঁচে থেকে। এই তো অনন্ত আনন্দের জীবন।
নূর হোসেন হাসি মুখে বলে, আমার মৃত্যুতে কারও কী কিছু এসে গিয়েছে; তোমরা বরং মুক্তির আনন্দ করো; এখানে আমাদের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু আছেন। চলো তার ৩২ নম্বরের বাড়িতে যাই।
দেবুদা একটি মৌন মিছিলের সঙ্গে ৩২ নম্বরে যায়। বঙ্গবন্ধু লঞ্চে আসা মানুষগুলোর চোখের পানি মুছিয়ে দেন। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর সবাই বোঝাচ্ছেন; মৃত্যু অনিবার্য।
শোকাহত নবাগতরা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না।
বেহেশতের পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই পিনাকে ৮৫ জন্ যাত্রী ওঠার কথা; উঠেছে তিনশোরও বেশি। আর নৌমন্ত্রীর শাজাহানের মেয়ের লঞ্চেরই ফিটনেস নেই; এটার যে কী অবস্থা বুঝতেই পারছেন।
মিশুক মুনীর বলেন, শাজাহান সাহেবের তিন ভাগ্নীও বেহেশতে এসেছে। উনি এবার আত্মীয়ের অশ্রুর অর্থ কিছুটা বুঝবেন হয়তো।
ভাগ্নীরা প্রতিবাদ করে, অসম্ভব। মামার পাথর হৃদয়। মায়া বলে পৃথিবীতে কিছু যে আছে তা উনি জানেন না।
দেবুদার মনে হয়, রাজনীতি হয়তো নিষ্ঠুরতার নির্বাণ। জিন্নাহ-নেহেরু-জিয়া এদের সবার জীবন কর্ম হয়তো নিষ্ঠুরতার নির্বাণ। মানুষের মৃত্যু কোনো বিষয় নয়; ক্ষমতা নিতে হবে। শাজাহান সেই আমিকেন্দ্রিক পলিটিক্যাল মনস্টার ঘরানার রিমিক্স ভার্সান।
তারেক মাসুদ অলৌকিক লঞ্চে ভেসে আসা শিশুগুলোকে আদর করেন।
বঙ্গবন্ধু কালো ফ্রেমের চশমাটা সরিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছেন। উনি শুধু বলেন, সন্তানেরা এত চিন্তা করছ কেন। রাষ্ট্রের অবহেলায় নিহত প্রতিটি ভাগ্যহতের পিতার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দিও।
পিনাকে ভেসে আসা নবাগত বেহেশতবাসীর চোখে আনন্দের অশ্রু।
বিদ্যাসাগর আসেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ডোমেস্টিক হেলপ খন্দকার মুশতাক একটা চেয়ার এনে দেয়। দেবুদা মুশতাককে বলে, আপনাকে দেখলেই রাগ হয়; আমি যখন এই বাসায় আসব; একটু দূরে দূরে থাইকেন।
রাগে গজগজ করতে করতে শেরে বাংলা আসেন। শুনলাম শাজাহাইন্না লঞ্চ খুঁজতে বাটিচালান দিছে; ওর মাথা ভর্তি পলিটিকস; সে শ্রমিক-না মালিক না তারেক!
দেবুদা বলে, শাজাহানের তুলনা কেবল শাজাহান। জলপথের নেতানিয়াহু এখন দেখেন গিয়ে খাসির রেজালা দিয়া পোলাও খাচ্ছে।
তাজউদ্দীন স্মরণ করিয়ে দেন, এখানে তার ভাগ্নীরা আছে; এসব বললে ওরা কষ্ট পাবে।
ভাগ্নীরা প্রতিবাদ করে, আমরা অভ্যস্ত। স্কুল-কলেজে এই মামার পরিচয় লুকিয়ে রাখতাম আমরা।
বেহেশতের গান্ধী এক্সপ্রেস বাসে করে নবাগত পিনাক যাত্রীদের ডরমিটরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দীন পুরো ব্যাপারটা দেখছেন।
বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করেন, লঞ্চের মালিকগুলো চোরের খনির লোকজন; আর তাদের এই লিডারটি চাটার দলের শিরোমণি।
এরমধ্যে মুশতাক এসে কাঁচুমাচু করে ছুটি চায়, আমাকে একটু জিয়াউর রহমান খাল কাটতে যেতে বলেছে; যাব কি!
দেবুদা বলে, আপনার এখনও জিয়ার সঙ্গে দেখা না হলে মন আনচান করে।
শেরে বাংলা হাসেন, দুষ্টু লোকদের মধ্যে গভীর প্রেম থাকে। প্রেম যে কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না।
বঙ্গবন্ধু দেবুদাকে জিজ্ঞেস করে, মানুষের এত টাকার লোভ কেন হয় আমি তো বুঝি না!
দেবুদা উত্তর দেয়, এইটা একটা রোগ । একটা নেশার মতো।
বিদ্যাসাগর গম্ভীর মুখে বলেন, শিক্ষাটা ভেতরে না ঢুকলে যেটা হয়; মূল্যবোধ বলে, চক্ষুলজ্জা বলে আর কিছু থাকে না। একটা লোক দেখানো বড়লোকি কেতা সব জায়গায়; ভারতে শুনলাম এক ব্যবসায়ী সোনার শার্ট পরে ঘুরছে।
দেবুদা বলে, এত বাপ্পিলাহিড়ী সিনড্রোম।
শেরে বাংলা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, মুজিব এত ভেব না; এই মানুষগুলো বড় বাঁচা বেঁচে গেল। আজকাল অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবার দাবারেও ফরমালিন মিশিয়ে দিচ্ছে; এসব ভেজাল খাবার খেয়ে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে এই বেহেশতের আনন্দযজ্ঞে বসবাস অনেক ভালো।
বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেন, দেবুদা আমাকে নিয়ে দেশজুড়ে অগাস্টের কান্দন কী শুরু হয়েছে!
দেবুদা বলে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে টিস্যু ফুরিয়ে যাচ্ছে আপনার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা শুরুর আগেই।
বিদ্যাসাগর হাসেন; এই মৌসুমী কান্না আমাদের মজ্জাগত।
বঙ্গবন্ধু বলেন, দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত সমাজ দুর্নীতি আড়াল করতে এসব সং যাত্রা করে। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক কিন্তু সৎ; তাদের এসব আলগা নাটক করা লাগে না।
বিদ্যাসাগর আশা জাগা চোখে বলেন, দেখে নিও তরুণেরা এসব মিথ্যের বেসাতিকে প্রত্যাখ্যান করবে। তারা বাতিঘর খুঁজে নিতে জানে।
দেবুদার কাছে হঠাৎ পারুর ফোন, হ্যালো তুমি কই! আমার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। ফ্রিজ খালি; তোমার তো সংসারের দিকে কোনো মন নাই; আর ইউ আ ব্যাচেলর! সেইরকমই তো ভাবসাব!
দেবুদার ইচ্ছা করে আছাড় দিয়ে ফোনটা ভেঙে ফেলে।
ভাববুঝে বিদ্যাসাগর বলেন, পারুটা বইপুস্তক একেবারেই পড়ে না। তাকে আমি বাড়ি বয়ে গিয়ে বই দিয়ে এসেছি; লাভ হয়নি।
বেগম মুজিব নিজেই চা নিয়ে আসেন, দেবুদাকে বলেন, আমরা বুদ্ধি হবার পর থেকে জেনে আসছি পার্বতীর শোকে দেবুদার জীবন শেষ হয়ে গেল, বেহেশতে সেই পার্বতীই আপনার স্ত্রী; কিন্তু এখনও আপনার জীবনে শেষ হয়ে গেল অবস্থা কেন!
বিদ্যাসাগর বেশ শব্দ করে হেসে ওঠেন।
শেরে বাংলা বলেন, দেবুদা আসলে বেচারা রাশির জাতক।
বঙ্গবন্ধু বলেন, দেবুদার জন্য দুঃখই হয়; যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই; যাহা পাই তাহা চাই না অবস্থা।
দেবুদা এরি মাঝে এক বাক্স টিস্যু উজাড় করেছে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেবুদার আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। পার্বতী একটুখানি হেঁটে গিয়ে আইসক্রিম কিনে আনতে পারে না যেন, কথায় কথায় বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দেয়; দেবুদা খানিকটা আর্তচিতকারের মতো গেয়ে ওঠে; যারে ঘর দিলা সংসার দিলারে, তারে বৈরাগী মন কেন দিলারে।
দেবুদা চন্দ্রমুখীকে ফোন করে, সে ফোন ধরেই বলে,
হ্যালো দেবুদা আমি একটু পিনাক যাত্রীদের রিলোকেশানের কাজ ভলান্টিয়ার করছি; পরে কথা বলি।
যাহ বাবা চন্দ্রমুখীটাও ফ্রোরেন্স নাইটেঙ্গেল হয়ে গেল। দেবুদা পার্কের বেঞ্চিতে বসে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে ঘন নীল আকাশের দিকে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ইভনিং ওয়াক করছিলেন, চিনতে পেরে এগিয়ে আসেন।
আরে দেবুদা যে; একা একা বসে কী ভাবছেন!
কেউ কথা রাখেনি সুনীলদা!
সুনীলদা একটা বেনসন ধরিয়ে পাশে বসেন।
দেবুদা মন খারাপ করবেন না; আমি তো দিব্যি নীরাকে ভুলে ভালোই আছি।
হলো না সুনীলদা পার্বতীর সঙ্গে একবাসায় থাকাটা গুয়ানতানামোর মতো কষ্টের।
প্রেম আসলে আবেগের কারাগার।
দেবুদা হাত দিয়ে চোখ মুছে; সুনীলদা একটা রুমাল এগিয়ে দেয়।
থাক সুনীলদা সুগন্ধী রুমালের ঘ্রাণ পেলে পারু ওথেলোর মতো ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠতে পারে।
বুঝতে পেরেছি; জীবনটা একটা এয়ার টাইট কম্পার্ট্-মেন্ট হয়ে উঠেছে। এত ভাববেন না। তা এই সাম্যবাদী আর কাম্যবাদী বলয়ের বাইরে আপনার থার্ড ফোর্স তৈরীর কতদূর!
সামনেই সেমিনার। আপনি একটু আসবেন দাদা!
দেখুন মশাই বামেদের বাঁদরামিও দেখেছি; এখন তৃণমূলের ছাগলামিও দেখছি; পলিটিকস দিয়ে কিচ্ছু হবে না!
আপনার মতো মানুষেরাও যদি আই হেট পলিটিকস বলেন, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কার হবে কী করে!
আসব আসব; আপনি একটু আগে ভাগে জানাবেন, নিশ্চয়ই আসব আপনার সেমিনারে।
সুনীল দা জগিং-এ ফিরে যান।
দেবুদা থার্ড ফোর্স শব্দটার সূত্র ধরে থার্ড অপশন হিসেবে রাশান বান্ধবী আনাকে ফোন করে!
আনা ফোন রিসিভ করেই ঝাড়ি দেয়;
তুমি আবার আমাকে ফোন করেছ দেবুদা
সকাল থেকে মনটা খারাপ; শুনেছ তো বাংলাদেশে একটা লঞ্চ ডুবে তা ভাগ্যহত গরীব মানুষদের নিয়ে বেহেশতে এসেছে!
হ্যা; আমি ওদের রিলোকেশান সেন্টার হয়ে ফিরছি। কী করবে বলো! মানুষের জীবনের আর দাম নেই; পৃথিবীটা অমানুষদের জুরাসিক পার্ক।
তুমি কোথায় আনা!
এই তো একটা পার্কের বেঞ্চিতে যেখানে দেবুদা বসে আছে; ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন