কাছাকাছি চেনা-পরিচিত লোকজন একেবারেই কেউ নেই, তা নয়। কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, এদিকে কেউ নেই। যাদের সঙ্গে বসে গল্পগুজব, পরনিন্দা, পরচর্চা করতে পারি, হো হো করে হাসতে পারি–সাদা কথায় প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে পারি আমার সেরকম আপনজনেরা এই প্রান্তে কেউ নেই।
বেশি বয়েসে পুরনো এলাকা ছেড়ে চলে এসেছি, এরকম যে হবে সেটা জানতাম। কিন্তু কেমন খালি খালি লাগে। বিশেষ করে শনিবারের সন্ধেবেলায় মনটা হু হু করে ওঠে।
এর জন্যে আমি নিজেকে দোষ দিতে পারি না। অবলুপ্তপ্রায় বান্ধবতান্ত্রিক সমাজের শেষ জীব আমরা দু-চারজন এখনও আছি। অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি বোধ হয়, শেষ হয়ে গেছে। আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে তাদের আহ্বান করতে হয়। অনেকদিন আগে এক কবি লিখেছিলেন,
পুরনো বন্ধুরা সব
স্মৃতির গম্বুজ হয়ে আছে।
আমার বন্ধুরা যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা সবাই যে গম্বুজ হয়ে গেছেন, তা কিন্তু নয়। উৎসবে, ব্যসনে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। কখনও সাবেকি দক্ষিণ কলকাতায়, কখনও অন্যত্র।
দেখা হয়, কথাবার্তা হয় কিন্তু আড্ডা আর আগের মতো জমে না। অসম্পূর্ণ আড্ডার শেষে অতৃপ্ত চিত্তে নতুন বাসায় ফিরে আসি। শহরের অন্য প্রান্তে।
একটা পুরনো ইংরেজি শ্লোক আছে।
প্রকৃতি শূন্যতা বর্জন করে। আসলে কথাটা হল প্রকৃতি কিছু শূন্য হতে দেয় না যথাস্থান পূর্ণ করে। এই লবণ হ্রদে আমারও তাই হয়েছে। পুরনো শূন্যতাকে নতুন শূন্যতা পূরণ করেছে।
অর্থাৎ এখানে আমার নতুন নতুন সব বন্ধু জুটেছে, অসমবয়সি সব বন্ধু। ঠিক হালফিলের যুবক না হলেও এখনও তেমন প্রৌঢ় হয়নি।
এই নতুন বন্ধুদের নিয়ে শনিবারের সন্ধেয় একটা আড্ডা শুরু করেছি। এদের সঙ্গে আমার বয়েসের মিল নেই, চিন্তার বা লেখাপড়ার মিল নেই কিন্তু একটা জায়গায় মিল আছে। এরা রাজনীতির ধার ধারে না, সিনেমার আলোচনা করে না, আবোল-তাবোল কথা, উলটো-পালটা গল্প বলতে ভালবাসে।
আমিও তাই ভালবাসি। আমার পুরনো আড্ডার পুরনো বন্ধুরাও তাই ভালবাসতেন। সমাজ-সংস্কার, শিল্প-সাহিত্য, সিনেমা-খেলা এসব কিছুই নয়, নেহাত নিরর্থক কথাবার্তা, অট্টহাসি–এ না হলে আড্ডা?
দক্ষিণ কলকাতার সনাতন আড্ডার মতো না হলেও আমাদের এই আড্ডায় আজ কিছুদিন হল, ওই সপ্তাহান্তে শনিবার বেশ ভিড় হচ্ছে। শুধু মধ্যবয়েসিরাই নয়, আমার মতো বিগত যৌবন দু-চারজন আসছেন। তবে আবদুস সালাম না এলে আড্ডাটা ভাল জমে না।
আবদুস সালাম বর্ধমানের ছেলে। মোটামুটি ভাল সরকারি চাকরি করে আবগারি দপ্তরের ইন্সপেক্টর। কাছাকাছি একটা সরকারি আবাসনে সপরিবারে থাকে।
সালামের গল্পগুলো একটু গাঁজাখুরি পর্যায়ের। তার বন্ধুরা পরিহাস করে বলে আবগারি দপ্তরের কাজে যে পরিমাণ গাঁজা সালাম সিজ করে তার প্রায় সবটাই ও নিজে খেয়ে নেয়, অতি অল্প অংশই সরকারের ঘরে জমা পড়ে।
এই আবদুস সালামই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, দাদা, ইংরেজিতে তো স্ত্রীকে বেটার হাফ বলে, তাই না?
সে সুচতুরভাবে কোনও একটা রসিকতায় ঘোরাপথে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে আমি সতর্কভাবে উত্তর দিলাম। খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর, হ্যাঁ।
সালাম বলল, তাহলে একজন লোক যদি দুবার বিয়ে করে তো শেষ হয়ে যাবে।
আমি আবার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করলাম, কেন?
সালাম বলল, বুঝতে পারছেন না? হাফে হাফে ফুল, একেবারে ফিনিশ।
এই রকম সব বাজে কথা বলায় ওস্তাদ, তার প্রতিবেশী চিরঞ্জীব, নিউ সেক্রেটারিয়েটে কাজ করে। সে সালামকে দুচোখে দেখতে পারে না। কিন্তু এদিকে দুজনে একসঙ্গে আমার বাসায় আসে। এবং সালামের হাসির কথা গম্ভীর হয়ে শোনে, কিছুতেই হাসে না।
একদিন সালাম এসে বলে, চিরঞ্জীবের বাড়িতে দেশ থেকে ওর এক কাকা এসেছে। প্রত্যেকদিন দুবেলা তার সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে।
চিরঞ্জীব সঙ্গেই ছিল, সে একটু মোটাসোটা হাসিখুশি ধরনের লোক। দেখলাম তাকে বেশ কাহিল দেখাচ্ছে। বললাম, কী ব্যাপার? কীসের ঝগড়া কাকার সঙ্গে? ৪৪
চিরঞ্জীব বলল, আর বলবেন না দাদা। পারিবারিক বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার। কাকা খুব জ্বালাচ্ছে। সাতদিনে দু কেজি ওজন কমে গেছে আমার।
এরকম ক্ষেত্রে যা বলতে হয় তাই বললাম, কাকাকে বরদাস্ত করছ কেন?
চিরঞ্জীব কিছু বলার আগে সালাম বলল, দাদা জানেন তো, সব ব্যাপারেই একটা ভাল দিক আছে, একটা খারাপ দিক আছে।
ভাল দিক, খারাপ দিক, ভাল ব্যাপার, খারাপ ব্যাপার, ভাল খবর, খারাপ খবর এই রকম সব ভাল-খারাপ নিয়ে সালামের কারবার, এটা তার মুদ্রা দোষ।
কিন্তু চিরঞ্জীবের আজকের ব্যাপারটার মধ্যে সালাম সেই ভাল খারাপ টেনে আনায় একটু বিস্মিত হলাম, এর মধ্যে ভাল কী থাকতে পারে।
এই শনিবারীয় সান্ধ্য আচ্ছায় আর যাঁরা আসেন তারা প্রবীণ মান্যগণ্য লোক। সালাম আর চিরঞ্জীব থাকলে বিশেষ কথা বলার সুযোগ পান না। এবং প্রাজ্ঞের মতো চুপ করে থাকেন। এঁদেরই একজন রণদাপ্রসাদ বাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত হাকিম। তিনিই মাঝে মধ্যে দুয়েকটা প্রশ্ন তোলেন, আজ তিনিই আমার মনের জিজ্ঞাসাটি ব্যক্ত করলেন, চিরঞ্জীববাবুর এই ব্যাপারের মধ্যে ভাল দিক। কী থাকতে পারে?
সালাম বলল, হাকিম সাহেব, কাকার অত্যাচারে চিরঞ্জীবের দু কেজি ওজন কমে গেছে। ও কাকাকে তাড়িয়েই দিচ্ছিল। আমি বলেছি, দ্যাখ ওজন কমান সোজা ব্যাপার নয়। আজকাল এসব ব্যাপারে খুব খরচা। কাকার জন্যে দু কেজি ওজন কমেছে, আর কয়েকদিনে আরও তিন কেজি ফ্যাট ঝরিয়ে নে। পাঁচ কেজি ওজন কমে গেলেই কাকাকে ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দিবি।
এই সালাম এবং চিরঞ্জীব আমাদের এই সাপ্তাহিক সান্ধ্য বাসরটি মোটামুটি জমিয়ে রেখেছে। এক শনিবার সালামকে বললাম, সালাম, সামনের শনিবার আমার পুরনো আর বন্ধুদের এখানে ডেকেছি। মাছের কচুরি পনিরের সিঙাড়া আর তেঁতুল-লঙ্কা কুচো চিংড়ির চাট–তোমাদের বউদি বাসায় করবেন। তুমি আর চিরঞ্জীব অবশ্য আসবে। তোমার সেদিন স্পেশাল পারফরম্যান্স চাই।
সালাম বলল, আমি বিশেষ কিছু পারব না, তবে পঁচিশ গ্রাম গাঁজা, চার বোতল চোলাই, দু বোতল বাংলা, দু বোতল রাম নিয়ে আসব।
আমি চমকে গিয়ে বললাম, এসব তোমার কাছে কে চেয়েছে? আমি তোমার কাছে পারফরম্যান্স চাইছি, যাতে আমার পুরনো বন্ধুরা বুঝতে পারেন আমি এই নতুন পাড়ায় ভালই। আছি।
পরের শনিবার যথাদিনে এল। সন্ধের একটু আগে সালাম অফিসের একটা জিপে করে এসে গাঁজা থেকে রাম পর্যন্ত তার ফিরিস্তি মতো সব জিনিস নামিয়ে দিয়ে গেল। আমাকে বলল, আমি একটু একটা নার্সিংহোমে যাচ্ছি। আমার ছোটসাহেবের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি তাঁকে একটু দেখে সরাসরি এখানে ফিরে আসব।
আমি বললাম, দেরি করবে না।
সালাম বলল, না দেরি হবে না। ছোটসাহেবকে দেখে, তার স্টকটা বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসব।
আমি বললাম, স্টক আবার কী?
সালাম বলল, নার্সিংহোমে একা একা পড়ে আছেন। একটু সাহচর্য দিতে হবে তো?
আমি প্রশ্ন করি, সাহচর্য?
সালাম মৃদু হেসে জিপের সামনের সিটে উঠতে উঠতে বলল, অল্প গাঁজা কিছু চোলাই, কিছু বাংলা আর অল্প রাম। এই আর কী?
আমাদের শনিবারের আড্ডা সেদিন নতুন পুরনোয় জমজমাট।
প্রায় শেষাশেষি সালাম এল। চোখ লাল, একটু টলছে। এসে ঢুকতে চিরঞ্জীব আমাকে ফিসফিস করে বলল, গাঁজা আর মদ দুইই খেয়েছে।
সালামের দৌলতে সেদিন আমার আড্ডাতেও গাঁজা আর মদ দুই চলছিল। আমি চিরঞ্জীবের কথায় পাত্তা না দিয়ে সালামকে বললাম, কী খবর?
সালাম বলল, দাদা ভাল খবর খারাপ খবর দুইই আছে।
আমি বুঝলাম শ্রীমান প্রস্তুত হয়ে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, খারাপ খবরটা বা কী? ভাল খবরই বা কী?
সালাম বলল, আমার নয়, আমার সাহেবের।
আমি অনুমতি দিলাম, তাই বলো।
সালাম যা বলল সেটা অকল্পনীয়। সন্দেহ হল, বোধহয় সত্যি কথাই বলেছে। কারণ এতটা বানানো সহজ নয়।
সালামের ছোটসাহেবের খুব জুতোর শখ। গাঁজা, মদের পরই তার জুতোর নেশা। প্রায় বিশ পঁচিশ জোড়া জুতো তার। চেনাশোনা কারও পায়ে নতুন এক জোড়া ভাল জুতো দেখলেই তিনি খোঁজ নেন, কোথা থেকে কিনলেন? কত দাম?
সেই ছোটসাহেব পরশুদিন চিনেবাজারে জুতো কিনতে গিয়েছিলেন। অনেক দর দাম করে সাড়ে আটশো টাকা দিয়ে একজোড়া লাল চামড়ার ফিতেওলা জুতো কিনে, সেই নতুন জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে পুরনো জুতো জোড়া জুতোর বাক্সে ভরে, বগলে করে অফিসে ফিরছিলেন।
চিনেবাজারের অদুরেই অফিস। পায়ে হেঁটেই ছোটসাহেব ফিরছিলেন।
সেদিন সকালবেলা থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তাঘাট পিছল। চিৎপুর আর লালবাজারের মোড়ে তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরোতে গিয়ে ছোটসাহেব পা পিছলে রাস্তার ওপরে চিত হয়ে পড়ে গেলেন। একটা মোটর সাইকেল বাস লরির পাশ কাটিয়ে কলাকৌশল সহকারে ড্রিবল করতে করতে আসছিল, সেটা অবলীলাক্রমে ছোটসাহেবের পায়ের ওপর দিয়ে উঠে গেল।
এরপরে আর ছোটসাহেবের কিছু মনে নেই। জ্ঞান হয়েছে পরের দিন সকালে নার্সিংহোমে, জ্ঞান ফেরার পরই খোঁজ করেছেন, আমি কোথায়? এবং তারপরে আমার নতুন জুতোজোড়ার কী হল? পায়ে এত ব্যথা কেন?
ধীরে ধীরে লোকের কথা শুনে তাঁর সবই অল্প অল্প মনে পড়ল। বুঝতে পারলেন পা দুটো একেবারে থেঁতলে গেছে। তবে নতুন জুতোজোড়া আছে, সেটা পা থেকে খুলে তার কেবিনেই রেখে দেওয়া হয়েছে।
একটু পরে ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার এক্স-রে-টেক্স-রে সব করা হয়ে গেছে। কাল রিপোর্ট পাবেন।
পরের দিন সকালে ডাক্তারবাবু এলেন, এসে বললেন, আপনার খবর আছে। ছোটসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কী খবর, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তারবাবু বললেন, খারাপ খবর আর ভাল খবর দুইই আছে।
ছোটসাহেব বললেন, এ আবার কী হেঁয়ালি। ব্যাপারটা খুলে বলুন ডাক্তারবাবু।
ডাক্তারবাবু বললেন, আগে খারাপ খবরটা শুনবেন, না ভাল খবরটা?
ছোটসাহেব বহুকালের পোড় খাওয়া লোক। বললেন, আগে খারাপ খবরটাই বলুন।
ডাক্তারবাবু নির্বিকারভাবে বললেন, আপনার দুটো পা-ই কেটে ফেলতে হবে।
এই কথা শুনে ছোটসাহেব কপালে করাঘাত করে আর্তনাদ করে উঠলেন, তারপর বললেন, এর পরে আর ভাল খবর কী থাকতে পারে ডাক্তারবাবু?
ডাক্তারবাবু বললেন, পাশের কেবিনের ভদ্রলোক আপনার নতুন জুতো জোড়া কিনতে চেয়েছেন।
তখন আমাদের বাসায় আড্ডা একেবারে তুঙ্গে। গাঁজার ধোঁয়ায়, মদের গন্ধে ঘর জমজমাট।
সালামের গল্প শুনে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। পুরনো বন্ধুরা বললেন, এরকম আড্ডা ছাড়া যায় না। এখন থেকে প্রত্যেক শনিবার আসব।
সালাম বলল, সেটা ভাল খবর কি খারাপ খবর বুঝতে পারছি না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন