গালিব কেন তার আমন্ত্রণে এলেন না; এই চিন্তাটা নওয়াবজানকে ঘুমাতে দেয়নি সারারাত। আর ইংরেজ সাহেব ও তার দেশী সহমত ভাইদের সঙ্গে বচসা-উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর থেকে নিজনগরীতে পরবাসী মনে হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে রাজবদরেরাই দিল্লীর মালিকানা পেয়েছে; দয়া করে দিল্লীতে নওয়াবজানকে থাকতে দিয়েছে; এমন একটা দেহভঙ্গী ক্ষমতাসীন নরভোজীদের মাঝে।
নওয়াবজান গালিবকে খুঁজতে তার পাশা খেলার আড্ডাঘরে গেলে, কবি যক বলেন, গতকাল থেকে গালিব বিষাদময় সময় কাটাচ্ছে। ওর ছোট ভাই গুরুতর অসুস্থ। চিকিতসার জন্য অনেক অর্থ প্রয়োজন। আমরা বন্ধু হিসেবে সাহায্য করতে চেয়েছি। কিন্তু গালিবকে তো চেনেন। সে প্রত্যাখ্যান করেছে আমাদের সাহায্যের প্রস্তাব।
বাহাদুর শাহ জাফরের প্রাসাদের বাগ এ গোলাপে বসে, খুশীজলের সঙ্গে গোলাপজল মিশিয়ে বেদনায় বেদনাক্ষয় করছেন যেন। বীরগুল নিজহাতে পরিবেশন করছেন পানপাত্র।নওয়াবজান গালিবকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে পৌঁছে যান। তাদের হিজাবে লুকানো নক্সী গয়নার বাক্স। সারাজীবনে জড়ো করা সব অলংকার আছে তাতে। যদি গালিবের কোন কাজে আসে। কিন্তু গালিব যে কোন সাহায্য নেবেন না; বরং রেগে যেতে পারেন, এ ব্যাপারে কবি যক বার বার হুঁশিয়ার করেছে।
বীরগুল নওয়াবজানকে স্বাগত জানান। দুজনের কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে থাকেন। বীরগুলের ভালো লাগে এই ভেবে যে, কবির গভীর বিষাদের সময়ে সবাই তার পাশে দাঁড়িয়েছে।
গালিব সারারাত খুশীজলের বেদনার বিষ পান করে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেছেন যেন। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। কথা বলার শক্তিও যেন নেই।
নওয়াবজান দৌড়ে গিয়ে বাহাদুর শাহ’র চিকিতসককে ডেকে আনেন। এই হিন্দু হেকিমকে নিয়োগ দেয়ায়; অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফর উত্তর দিয়েছেন, ভারত হিন্দু-মুসলমান সবার, কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা আর যোগ্যতাটাই আসল। এই হিন্দু হেকিম শ্রেষ্ঠ জন্যই তাকে প্রধান হেকিম হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
হেকিম সাহেব এসে, গালিবকে ওষুধ দেন। গালিব চলাফেরা করতে পারছেন না বলে; নওয়াবজান তাকে বীরগুলের ঝুলবারান্দা সংলগ্ন কক্ষে পৌঁছে দেন।
–আজ তবু অসুস্থ হয়েছিলেন বলে, আপনাকে কাছ থেকে দেখতে পেলাম।
গালিব অস্ফুট স্বরে বলেন, হাজারো খুহাইশে এয়সি কে হার খুহাইশে পে দাম নিকলে।
নওয়াবজান মৃদুস্বরে ঘুম পাড়ানি গানের মতো গুনগুন করে গাইতে থাকেন, বহোত নিকলে মেরে আরমান, লেকিন ফির ভির কাম নিকলে।
হেকিম সাহেব বলেন, ও কিছুনা বিবি; গালিব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। এরপর বীরগুলের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলেন, শুনেছি রাজপুত্রী বীরগুল তুর্কী হেকিমি জানেন। আমি নিশ্চিত, গালিবের সুস্থতা দ্রুতি পাবে তার দেয়া ওষুধে। আমি আসি তবে, নমস্কার; আদাব।
নওয়াবজান গালিবের বাড়িতে গিয়ে তার অসুস্থতার খবর দিয়ে তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন, উনি এখন রাজহেকিমের সাহচর্যে আছেন; সুস্থ হলেই বাড়ি ফিরবেন।
নওয়াবজান ওমরাও বেগমকে অনেক সংকোচে গয়নার বাক্স দিতে চাইলে, তিনি কৃতজ্ঞতার চোখে বলেন, আপনি এই যে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন; এটাই খোদাতালার নেয়ামত। কিন্তু সাহায্য নিলে গালিব আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। উনি শিশুদের মতো অবুঝ আর অভিমানী। আমি উনার এই লাল রাগকে খুব ভয় পাই চঁদভি দিদিমণি।
নওয়াব জান অশ্রুসজল চোখে বলেন, ওমরাও বাজি, গালিব যেটাকে শৃংখল মনে করেন; আসলে সেটাই পুষ্পস্তবক। গালিবের পদাবলীর জন্য আমরা তার ভক্তরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আজ সকালেই তাকে খুশীজলের বিষে নীল দেখে মনে হয়েছে; আপনার শাসনদণ্ড প্রয়োজন আছে এই বিশৃংখল মানুষটিকে সুস্থ রাখতে। খোদা আপনার মঙ্গল করুন।
বাড়ি ফিরে নওয়াবজান ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির একটা গ্রেফতারি পরোয়ানা, আর তার বাড়ির মালামাল ক্রোকের আদেশ হাতে পান। তাকে দেশদ্রোহীর তকমা দিয়ে; তার কৌঠিকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ষড়যন্ত্রাগার হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর তার মুলাজিমকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে পিটিয়ে আধমরা করে স্ট্রেচারে করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফেলে রাখা হয়েছে সিঁড়ির গোড়ায়; তার শুশ্রুষা করতে বাধা দিচ্ছে রাজবদরেরা। বাড়ির সামনে মুখোশ পরা রাজবদরেরা চাপাতি হাতে টহল দিচ্ছে।
নতুন চৌধুরী পালকি থেকে নেমে চিতকার করে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কুটিরগুলো আমরা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবো। ওখানে বৃটিশ কুইনের ছবি ঝুলাবো। উন্নয়নের মুখোশের ঈশ্বরী তিনি। সুতরাং মুখোশ পরা সহমত ভাইয়েরা লাঠি-কিরিচ-চাপাতি-বন্দুক-পিস্তলের পূজা দেবে রাণীমাতার ছবি আর ভাস্কর্যে। চারিদিক থেকে ধনি ওঠে, জয় রাণীমাতা বলে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে চলো।
একটা করে বৃটিশ বিরোধী ধরো, সকাল বিকাল নাশতা করো।
এক গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণ এক হাত কাটা মুশকো সহমত ভাই, নওয়াবজানের মুলাজিমের আধমরা দেহটির দিকে এক পাটি জুতা ছুঁড়ে মারে।
জুতোটা কুড়িয়ে নিয়ে, কুলুদাদা নামে আরেক বৃটিশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার গোয়ালা বলে, ইতিহাসে জুতোটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার জুতা হিসেবে বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হবে।
একটা খাতা পেন্সিল হাতে এগিয়ে আসা বৃটিশের পালতো ইতিহাস রচয়িতা, ইতিহাসান বোকসেদ বলে, এই জুতোর রেপ্লিকা থাকতে হবে দিল্লী মিউজিয়ামে; যাতে এই ঐতিহাসিক জুতো দেখে, অনাগত প্রজন্ম জুতা ছোঁড়ার এই মহান অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংস্কৃতির আলো খুঁজে পায়।
খাসিব হুক নামে আরেক হাবসি ক্রীতদাস রাজবদর এগিয়ে এসে বলে, আমি বলেছিলাম না, কালোই জগতের আলো; আপনারা ধলামিয়ারা পারলেন না; কিন্তু হাতকাটা কালা মিয়াই পেরেছে, জুতা ছুঁড়ে দেশপ্রেম আর অসাম্প্রদায়িকতার স্বাক্ষর রাখতে। বৃটিশ রাজবদর মুক্তিযোদ্ধা সনদে, এখন থেকে অবশ্যই কালা মিয়ার অবশিষ্ট হাতটির স্বাক্ষর লাগবে। ইচ্ছা করে এই হাতটাকে সোনা দিয়ে বান্ধিয়ে রাখি। উনাকে জুতা-এ-দিল্লী পদকে ভূষিত করার দাবী রেখে গেলাম।
মহবুব ই আজাদ নামে হাবসি দাস বলে, গালিবকেও গ্রেফতার করা চাই; সে ইংরেজ জাগরণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের লিপ্ত।
সবাইকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বৃটিশ জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলে, বাহাদুর শাহ জাফর একজন জিহাদি, তার অনুসারীরা সবাই সন্ত্রাসবাদি, জঙ্গি। ভারতের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীর ঠাই নাই। ভারত পছন্দ না হলে, বাপের দেশ অটোমান সাম্রাজ্যে চলে যাও। ২৪ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি নওয়াবজান।
মাথায় বৃটিশ পতাকা বেঁধে, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এসে যোগ দেয়; নওয়াবজান উচ্ছেদের বৃটিশ জাগরণ মঞ্চে।
মিছিল করে ইংরেজ জাগরণ কর্মীরা ঢুকে যায় নওয়াবজানের বাসগৃহে। জাগরণের রক্ষী বাহিনী বাড়ির আসবাব বাইরে ছুড়ে ফেলে। বাইরে থেকে ঢিল দিয়ে কাঁচের জানালা ভাঙ্গতে থাকে বৃটিশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি। রাণীমাতার রক্ষীবাহিনীর এক কমান্ডার নওয়াবজানের রুপচর্চার আয়তাকার বিশাল আয়নাটি দোতলা থেকে ছুঁড়ে দেয়। মাটিতে পড়ে ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে যাবার পর এর ওপর দাঁড়িয়ে বুনো নৃত্য করে বৃটিশের অসাম্প্রদায়িকতার চেতনার শেয়ালের রাজেশ পালেরা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন