নওয়াবজানকে উদাস অপেক্ষায় দেখে তার মা এসে পাশে দাঁড়ান। একজন সহচরী নওয়াবজানের পায়ের যত্ন নিচ্ছে; আরেকজন করছে চুলের পরিচর্যা। মা জিজ্ঞেস করেন, চঁদভি সত্যি সত্যিই কি গালিব আসবে! আমার কিন্তু একদম বিশ্বাস হচ্ছে না। নওয়াবজান বলেন, উনি কথা দিয়েছেন; কথার বরখেলাপ কী করবেন উনি!
মা বলেন, গালিবের জন্য আম আনতে দিয়েছি। সাঁঝের পর তো গালিব আম খান। এ আজব অতিথি, তার জন্য খানাখাজানার প্রয়োজন নেই। আমি তবু চাপলি কাবাব, শিরমাল আর ভেড়ার গোশতের কোর্মা করছি। জর্দা, গাজরের হালুয়া আর কুলফিও থাকছে। একটা লোক বাড়ি বয়ে এসে শুধুই আম খাবে তা তো হয় না।
নওয়াবজান হেসে বলেন, আমি বললেই তো আর আপনি শুনবেন না আম্মাজান; আপনার তো মুঘল খানা-খাজানা ছাড়া নিমন্ত্রণ করার স্বাদ মেটে না। কিন্তু আমি জানি, গালিব আম ছাড়া আর কিছু খান না।
বাইরে কিছুটা হৈ চৈ শুনে নওয়াবজানের মন আনচান করে; গালিবই আবার আগেই চলে এলেন না তো! পদ পরিচর্যার পানিপাত্র উলটে দিয়ে দৌড়ে ঝুল বারান্দায় গিয়ে দেখেন, ঘোড়ার ওপর বসে এক ইংরেজ সাহেব আর নীচে দাঁড়িয়ে দুজন নতুন নবাব। যারা যমুনার ওপার থেকে তরুণীদের তুলে এনে ইংরেজের মন্দিরে বলি দেয়। আগে এরা পালকির চৌধারে কাঁধ দিয়ে যাত্রী বইতো বলে, ইংরেজরা তাদের চৌধুরী বলে ডাকে। নওয়াবজানকেই এরা পালকিতে করে বয়ে নিয়ে গেছে লালকেল্লায়। আজ বৃটিশের সহমত ভাই হয়ে একেবারে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে জলসাঘরে বসতে চাইছে। খোদা আর কত আশ্চর্য দেখাবেন এই দিল্লীশহরে!
দুই চৌধারে কাঁচুমাচু করে হাত কচলে বলে, জনাবা, আপনার সংগীতের অনেক সুনাম শুনে এসেছেন কোম্পানির বড় বাবু। আপনি যদি অনুমতি করেন, ওপরে আসি।
নওয়াবজান বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটা তো সরাইখানা নয় যে হুট করে এসে বালিশে হেলান দিয়ে বসতে দেয়া হবে। ইংরেজের জন্য কোলবালিশ সংগ্রহের যে কাজ করছো; ঐ কাজেই থাকো; উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত-নৃত্য এক জনমে হবে না গো চৌধারে। অপেক্ষা করো আরো দুই পুরুষ পরে তোমার উত্তর পুরুষ ঠিকই সম্পূর্ণ মানুষ হবে; মানবিক হবে, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ জন্মাবে ওদের মনে। মানুষের মানুষ হয়ে উঠতে বিবর্তনের মাঝ দিয়ে যেতে হয়। দেখবে আজ তুমি কোলবালিশ শিকারের যে পেশা বেছে নিয়েছো; তোমার নাতি এরজন্য তোমাকে ঘৃণা করবে। আর এই যে বৃটিশ বাবু, তিনি বিলেতের কোন ক্ষেতের মূলি; ওখানে তো শুনেছি, আগে থেকে পয়গাম না পাঠিয়ে কেউ অপরিচিত কারো বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ে না। লালমূলিটা এতো ঘেউ ঘেউ করছে কেন! আমার গান শুধু তারা শোনার অনুমতি পান, যারা সুর-তাল-লয়-নীরবতা বোঝেন, কথা বোঝেন, এর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে ভাবতে পারেন, নিজের গভীরে ডুব দিতে পারেন। তোমরা বরং নূর বাঈয়ের পোষাকের নগ্ন চিত্রকলা দেখতে যাও। তারপর মাতাল হয়ে যমুনার ওপারে কৃষকের বাড়িতে হানা দিয়ে হরিণী শিকার করে নিয়ে এসো; এরপর হিংস্র রাজশেয়াল হয়ে হরিণটাকে খুবলে খাও। কোম্পানির জামানায় তো শুনেছি তোমাদের মতো বৃটিশের পালতো নরভোজীগুলোর সাত খুন মাফ।
এক চৌধারে গলায় একটু শক্তি এনে বলে, চঁদভি দিদিমণি, আপনি কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উন্নয়নের চেতনার বিপক্ষের পরাজিত শক্তি বাহাদুর শাহ জাফরের পক্ষের শক্তির মতো করে কথা বলছেন। এতে আমাদের “বৃটিশ কুইন” অনুভূতিতে আঘাত হয়েছে; আমাদের কাছে খবর আছে, আপনি গালিবের সঙ্গে মিলে বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। আপনি জানেন আপনার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা হতে পারে।
আরেক চৌধারে সাহস পেয়ে বলে, আপনার মুলাজিমকে নিয়ে আমরা যমুনা নদীর ধারে অস্ত্র উদ্ধারে যেতে পারি। ওখানে ওর লাশ পড়ে থাকবে, পাশে চাপাতি ফেলে রাখলে মনে হবে, আত্মরক্ষার্থে ইংরেজ সাহেব গুলি চালিয়েছে।ঘোড়ার ওপরে বসে বৃটিশ সাহেব বলে, হি ইজ আ টেররিস্ট, এরেস্ট হিম!
দ্রুত হিজাব চড়িয়ে নেমে আসে নওয়াবজান, আমার ওপরে রাগ হয়েছে, আমাকে এরেস্ট করুন। ওকে ছেড়ে দিন।বৃটিশ সাহেব বলে, আমি যদি বলি ওর কাছে গোল্ডেন অর্নামেন্টস পাওয়া গেছে; ওর পকেটে একটা কানের দুল বা গলার মালা রেখে দিলে; চৌদ্দ শিকের মধ্যে ভরে রাখা যাবে। শুনে রাখুন, এখন থেকে ভারতবর্ষে এই জঙ্গলের আইনই চলবে। জোর যার মুলুক তার।
নওয়াবজান বলেন, জোর করে সব করানো যায়; কিন্তু গান করানো যায় না। আমি মরে গেলেও এমন অসুরের সামনে সুরের সাধনা করবো না।
রাজবদর নতুন দুই চৌধুরী ভয় দেখায়, আপনাকে আমরা শিল্পীদের জন্য করা কালো তালিকায় ঢুকিয়ে দিলাম। আপনি আমাদের স্বাধীনতার চেতনার বিপক্ষের শক্তি, দেশদ্রোহী!
–চুরি-ডাকাতি-চাঁদাবাজি-বাড়ি-জমি দখল,খুন-ধর্ষণ-উন্নয়নের নামে দেশ বিনাশের; সভ্যতা আর সংস্কৃতি বিনাশের চেতনাই কী তোমাদের স্বাধীনতার চেতনা!
মহল্লার লোক জড়ো হতে দেখে বৃটিশ বাবু সটকে পড়ে। রাজবদর দুটোর তবু রাগ কমে না। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় তো হবেই। পরে মহল্লার দুটো কুকুর এসে নতুন চৌধুরীদের শুঁকতে শুরু করলে ওরা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কুকুর দুটো ওদের আলিঙ্গন করতে চায়; যেন সহমত ভাই হিসেবে যোগ দিতে চায় রাজবদরদের সঙ্গে। মহল্লার লোকেরা নতুন চৌধুরীদের আলিঙ্গন থেকে তাদের সহসারমেয়দের ছাড়িয়ে নিলে ওরা হন হন করে হেঁটে যেতে থাকে; সহসারমেয়রা পিছু ছাড়ে না কিছুতেই। কে জানে এই কুকুর দুটোই হয়তো একদিন ভারতবর্ষের নবাবের পদ পেয়ে যাবে; প্রভুভক্তির পুরস্কার হিসেবে।
নওয়াবজান তীব্র বিবমিষা নিয়ে ঘরে ফেরেন। ভুলে যেতে চেষ্টা করে একটু আগের তিক্ততার কথা।
গালিব তখন বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওমরাও বেগম এসে একটা নতুন শেরওয়ানি দিয়ে বলে, আপনার জন্য সেলাই করেছি। ঐ শেরওয়ানিটা খুলে রাখুন। একেবারে পুরোনো হয়ে গেছে।
গালিব হেসে বলেন, এমনভাবে আমায় সাজাচ্ছো যেন, আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে পাঠাচ্ছো। অবশ্য তোমার আর অসুবিধা কী! তোমার তো পাঁচ ওয়াক্তের প্রেমিক আছে; তার প্রেমে দিওয়ানা মদিনা।
নতুন শেরওয়ানি পরে সুগন্ধী ছড়িয়ে নওয়াবজানের কৌঠির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই গালিব দেখেন, একটা লোক আগ্রা থেকে দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে।গালিবের ছোট ভাই খুব অসুস্থ। তার চিকিতসার জন্য টাকা পাঠাতে হবে। গালিব তার পকেটে যা ছিলো তা দিয়ে বলেন, তুমি এটা নিয়ে রওনা হয়ে যাও। আমি আবার টাকা পাঠাবো।
হাত ফাঁকা হয়ে যাওয়ায়; গালিব দ্রুত পা চালিয়ে সম্রাটের সচিবালয়ে খোঁজ নিতে যান, চাচার অবসর ভাতার। কেরানি গম্ভীর মুখ করে বলে, সম্রাটের এখতিয়ার থেকে ধীরে ধীরে ইংরেজরা সব কেড়ে নিয়েছে। অবসর ভাতার নথি ঠিক করতে; সেই কলকাতা যেতে হবে। ইংরেজদের প্রিয় কোন নবাবকে দিয়ে সুপারিশ করাতে পারলে কাজটা হয়তো হয়ে যাবে।গালিব বিষণ্ণতার সাগরে যেন তলিয়ে যেতে থাকেন। শিথিল পা ফেলে ফেলে পুস্তকালয়ে এসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। পুস্তকালয়ের মালিক জিজ্ঞেস করেন, আজ না আপনার চঁদভির গান শুনতে যাবার কথা!
–আমার ভাগ্যে নেই। ছোট ভাই অসুস্থ; ওর চিকিতসার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমার চাচার পেনশন আটকে দিয়েছে ইংরেজদের সচিবালয়। আমি শের শায়েরি করে যা উপার্জন করি; তাতে আমার বেশ চলে যায়। কিন্তু আগ্রায় পরিবারের নির্ভরশীলদের জন্য বাড়তি টাকা পাঠাতে ঐ অবসরভাতার টাকাটা খুব কাজে আসতো। বড্ড বিপদেই পড়ে গেলাম জনাব।
আজ নওয়াবজানের জলসাঘরে আলো জ্বলেনি। বাদ্যযন্ত্রীরা খেয়ে দেয়ে বিদায় নিয়েছে। একা বসে চঁদভি; এ কোন চাঁদের রাত, অমাবস্যার চেয়েও অন্ধকার।
যুলমত কাদে মে মেরে শাবে ঘাম কা জোশ হ্যায়
এক শাম্মা হ্যায় দালিল এ সাহের সো হাওশ হ্যায়
মেনে কীয়া হ্যায় হুসন এ খোদা রা কো বেহিজাব
এ শকিয়া এজাজত তাসলিম হোশ হ্যায়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন