পাশার আসরে কবি যখন আক্ষেপ করেন, দিল্লী শহর থেকে সুখ বিদায় নিয়েছে। প্রতিদিনই অনাহারী মানুষের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আগে যারা খেয়ে পরে সুখে ছিলো; এখন তারা জানে না রসুইঘরে আগামীকাল চুলা জ্বলবে কীনা। আর বেড়েছে ঠগীর অত্যাচার। অলিগলিতে লুকিয়ে থাকে; রুমালের ফাঁস লাগিয়ে পথচারীর সর্বস্ব কেড়ে নেয়। আবার ধরা পড়লে বলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে গোলাবারুদ কেনার তহবিল সংগ্রহ করছি। সত্যিই ঠগীর ছলের অভাব নেই।
এ এক আজব দেশ, দেশ এখানে, এর রাণী বিলেতে; আর রাজধানী নিয়ে গেছে কোলকাতায়! এতো জায়গা থাকতে কলকাতা কেন! প্রশ্ন করে আরেকজন।
উত্তর আসে, কলকাতায় বৃটিশের সহমত ভাইয়ের সংখ্যা সর্বোচ্চ হয়তো।
–দিল্লীর চেয়েও বেশী! দিল্লীতে তো দেখছি ভিক্ষুকের ছেলেরা ইংরেজের গোলাম হয়ে ভাগ্য বদলাচ্ছে।
গালিব বলেন, নায়েব, গোমস্তা শ্রেণীর অদৃশ্য সাবানে হাত কচলানো লোকগুলো সব ছোট ছোট নবাব হচ্ছে। আজকাল তো এসব লোকের সঙ্গে দেখা হবে বলে সচিবালয়েই যাই না। আচ্ছা ঠিকাছে তেলাঞ্জলি দিয়ে গলির ছেলে নবাব হয়েছে; বিরাট হয়েছে, কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট নয়। তার আবার কবিতার আসরে যোগ দেবার শখ। কারো কারো আবার কবিতা লেখারও শখ। খায়েশের কোন অন্ত নেই এই বৃটিশের রাজবদরগুলোর।
–ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢোল পিটিয়ে বেড়াচ্ছে, বাহাদুর শাহ জাফর নয়, বৃটিশেরাই পারে উন্নয়নের জোয়ার আনতে পারে। তা মুঘল আমলে তো এমন গরীবীও দেখিনি; ঘরে ঘরে কান্নার আওয়াজও শোনা যায়নি। এতো যে বৃটিশের উন্নয়নের বেহুদা ঢোল; তাহলে প্রজাদের এতো অভাব কেন, ঘরে ঘরে ক্ষুধা কেন! আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তো ভারতের সম্পদ লুন্ঠন করে ইংল্যান্ডে পাঠাচ্ছে। এই কোম্পানির সামান্য কেরানিগুলো এসেছিলো মুখ শুকনো করে; আর এখানে বেশ খেয়েদেয়ে মোটাতাজা হয়েছে।
গালিব হাসেন, এরাও বিলেতের ভিক্ষুকই, রাণীর সহমত ভাই হয়ে ভাগ্য বদলাতে ভারতে এসেছে। সুতরাং ওরাও বেছে বেছে ভারতের ভিক্ষুকগুলোকে সহমত ভাই বানাচ্ছে। কেড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার রাজনীতি, মানুষ মারার বণিকনীতি; এগুলো হচ্ছে ভিক্ষুকের ভাগ্য বদলের পথ। বিবেকসম্পন্ন কোন মানুষ এসব চালিয়াতি আর জালিয়াতির কাজ করে নাকি!
হঠাত এক বাজবদর এসে ঢোকে, পোষা কুকুরের মতো ষড়যন্ত্রের গন্ধ শুঁকে। তার পর সহমত ভাইয়ের পারদর্শিতায় একের পর এক মিথ্যা বলতে থাকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে উন্নয়নের রুপকল্প দিয়েছে, তাতে আগামী দশবছরের মধ্যে এদেশ বিলেত হয়ে যাবে। এখনো ইংরেজদের বানানো দালান আর রাস্তা দেখলে মনে হয়; ভারতবর্ষে নয়; বিলেতে আছি; তবুও বৃটিশের বিরুদ্ধে দিল্লীর সুশীলদের ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই।
গালিব ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে, মাথা ঠান্ডা রেখে রাজবদরটার চোখে চোখ রেখে বলেন, এই আড্ডার একটা রেওয়াজ আছে; এখানে কথা বলা শিখে তারপর কথা বলতে আসতে হয়। ইংরেজদের সারমেয় প্রতিপালনের প্রয়োজন থাকতে পারে; গালিবের নেই।
কে একজন ইংরেজদের রাজবদরকে আদর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরের বাইরে রেখে আসে।
গালিব বিরক্তি প্রকাশ করেন। এই ঝামেলাগুলো পুরো দিল্লীতে উন্নয়নের বিল্লি হয়ে ঘুরছে। ভিক্ষুকের শরীরে নবাবের শেরওয়ানী জড়িয়ে এরা চৌরবাজারে যায়; শিষ্টাচার জানেনা, কাব্য বোঝার মস্তিষ্ক নেই, সংগীত বোঝার ক্ষমতা নেই, নৃত্য উপভোগের মত সুন্দর রুচি নেই; শুধু জৈবিক তাড়না তাদের। মস্তিষ্ক যৌনাঙ্গে আর যৌনাঙ্গ মস্তিষ্কে হলে যা হয়।যক বলেন, বৃটিশের সহমত ভাইয়েরা নিজেদের জন্য আলাদা মাণ্ডি গড়ে তুললেই হয়। কাঁহাতক একটা শহরে শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা সংগীত নৃত্য কাব্যের আসরে বুনো ষাঁড়ের মতো ঢুকে পড়বে ওরা।
হঠাতই বাজারের মাঝখানে হৈ চৈ শোনা যায়। ঘোড়ায় চড়ে ইংরেজ সৈনিকেরা ভারতীয়দের গালাগাল করছে, ইউ ইডিয়েটস, ইউ বাস্টার্ডস, ইউ আর কন্সপায়ারিং এগেইন্সট আস।গালিব হাসেন, ভিক্ষুক তা বৃটিশ হোক আর ভারতীয় রাজবদর হোক “ষড়যন্ত্র”শব্দটা বলবেই।
ইংরেজগুলো কতগুলো ফাঁকা ফায়ার করে, তারপর চেঁচায়, ইউ ইল্লিটেরেট আনকালচার্ড, ইন্ডিয়ান ফার্মার্স।
গালিব বলেন, আহা বিলেতে কী বিশাল পড়াশুনা করেছে যে তাদের দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছে কেড়ে ছিঁড়ে খেতে। মুখের ভাষা ও আচরণে তো সংস্কৃতির জীন মানচিত্র মেলে ধরলো কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা। আর কৃষক তো অন্নদাতা। সে ফসল ফলায় নিজের খাবার নিজে জোগাড় করে খায়। বন্দুক দেখিয়ে লুন্ঠন করে বেড়ায় না।
সেই বৃটিশ রাজবদরটি ইংরেজদের দেখিয়ে দেয়, পাশা খেলার ঘরটি। কিন্তু গালিবের নাম শুনে সেপাই আর সে পথ মাড়ায় না। কারণ লোকটা তার কবিতায় সব সত্যি উচ্চারণ করে; সব মুখোশ হ্যাঁচকা টানে খুলে দেয়। ওর সঙ্গে পারা মুশকিল। আর ওর খ্যাতি এতো ছড়িয়ে পড়েছে যে, চট করে তাকে গুম করে ফেলারও সাহস নেই কোম্পানির নৃশংস খুনে সৈনিকদের।
যক হেসে বলে, জনাব আপনি যখন মনুষ্যকে সারমেয় বলেছিলেন, আমি সন্দিগ্ধ ছিলাম, মানুষকে সারমেয়র সঙ্গে তুলনা সঙ্গত কীনা! কিন্তু ঠিকই বৃটিশ সেনা আর রাজবদর সারমেয় ঘেউ ঘেউ করে আপনার ব্যবহৃত শব্দকে সত্যি প্রতিপন্ন করে গেলো!
নওয়াবজানের মুলাজিম এসে গালিবের পিছে দাঁড়ায়, তাকে একটি চিঠি এগিয়ে দেয়। গালিব চিঠিটা পড়ে হেসে বলেন, নিশ্চয়ই আসবো; এমন নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করলে কী চলে।
পত্রবাহক চলে গেলে, যক জিজ্ঞেস করেন, কার আমন্ত্রণে কবির মনে এতো পুলক!
–আমার কবিতার ভক্ত, আমার কবিতাতে সুর দেয়; তারপর গায়।
যক কৌতুক করেন, শুধুই কী কবিতার নিমন্ত্রণ নাকি তাতে আরো প্রাপ্তি যোগ আছে!
–যে শেকলে বাঁধা আছি জনাব; তাতে উড়তে গেলেও ওড়া যায় না; ডানা ঝটপট করে আবার বসে পড়ি।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন