সাধারণত খুব সক্কালে ঘুম ভাঙে রতনের। তখন একটা মিহি ছায়া জড়ানো থাকে ঘরটায়। হাত বাড়িয়ে সীমাকে জাগাতে একটু সময় লাগে।
আজ মধ্যরাতে বৃষ্টিপাতের দরুনই সম্ভবত ঘুম একটু বেশি সময় ছিল। চোখ খুলে অভ্যাসে হাত বাড়াতে রতন বুঝল পাশে কেউ নেই। সীমা কখন উঠে গেছে। রতন তড়াক করে উঠে বসার চেষ্টা করে দেখল সে শুয়েই আছে, শরীরটা সামান্য কেঁপে উঠেছে মাত্র। সঙ্গে-সঙ্গে সচেতন হল এবং শুয়ে-শুয়েই সীমার নাম ধরে বারকতক ডাকল।
সীমা সাড়া দিচ্ছে না। রতন বিছানায় গড়াল। গড়াতে তার কোনও অসুবিধে হয় না। সীমা যেখানে শুয়েছিল, সেখানে চিমসে হওয়া পাশবালিশ ছাড়া আর কিছু নেই। রতন অজান্তেই উচ্চারণ করল, শা-লা!
ঠিক তখনই যে সীমা ঢুকবে তা ভাবতে পারেনি রতন। কথাটা কানে যেতেই যে গলাটা বাজলো তাতেই মাথা ধরে গেল রতনের, কী বললে? ছি-ছি-ছি! বাপ হয়ে এইসব আওড়াচ্ছো। ছেলেমেয়েরা তো শিখবেই। কি ছোটলোকের পাল্লায় পড়েছি গো!
রতন কিছুক্ষণ বউ-এর দিকে তাকিয়ে থাকল। ছিমছাম দেখতে এখনও, মুখে জল দিলে বেশ দেখায়। সীমা আবার বলল, তুমি কাকে শালা বললে?
রতন বিড়বিড় করল, ঠিক কাউকে নয়–
মিথ্যে কথা। তুমি মিথ্যেবাদী। কাল রাত্রেও তাস পিটিয়ে এসেছ আর বেমালুম বলে গেলে
অফিসে ছিলে!
কে বলেছে? রতনের গলাটা দুর্বল শোনাল। কাল রাত দশটায় বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো কথাটা বিশ্বাস করেছিল সীমা, এর মধ্যেই ফাঁস হয়ে গেল কী করে?
তুমি, তুমি! ঘুমের মধ্যে নেট্রাম-নোট্রাম বলে চেঁচাচ্ছিলে!
রতনের ইচ্ছে করল নিজেকে ঠাস করে চড় মারে। ঘুমের মধ্যে কথা বলা ওর একটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজের কিছু করার উপায় থাকে না অথচ কত গোপনীয় কথা বেমালুন উগরে দেয় সে সময়। আর এই মেয়েছেলেটা বোধহয় তক্কেতক্কে থাকে সেই সব শোনার জন্যে। আজই। ডক্টর সেনের কাছে যাওয়ার কথা তার। ভদ্রলোক যদি এটা বন্ধ করতে পারেন তো বাঁচা যায়।
রতন করুণ গলায় বলল, দাও।
সীমার চোখে এখনও বিষ দৃষ্টি। সেই সময় মোক্ষদা বাইরে থেকে বলল, বউদি, বাজার নেই।
যাচ্ছে। সীমার গলাটা পালটাল। তারপর দ্রুতহাতে জিনিসটা রতনের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, চটপট বাজার করে নিয়ে এসো। তারপর চা খাবে।
সীমা আর দাঁড়ায়নি। রতন দেখল জিনিসটা প্লাস্টিকের। কিছুতেই আসলটা হাতছাড়া করবে না সীমা। প্লাস্টিক বলেই সারাদিন সতর্ক হয়ে থাকতে হয়, বেশি চাপটাপ পড়লে যদি ভেঙে যায়। তাহলে হয়ে গেল। কিন্তু ওই জাঁহাবাজ মেয়েছেলে যে মহা ধড়িবাজ!
ঠিকঠাক হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রতন বাইরে দাঁড়াতেই শুনল, বেলা আটটা অবধি ঘুমুলে, না খেয়ে অফিসে যেতে হবে। বাজারটা করে তবে চা গিলো।
সাতসকালে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হল না রতনের। মুখে জল দিয়ে বাজারে ছুটল সে। সত্যি আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। অন্যদিন এই সময় দুধের দোকানে লোক থাকে না, আজ লম্বা লাইন। বাজার বসার আগেই সে বাজারে গিয়ে হাজির হয়। তখন মনে হয় সে যদি দোকানদারগুলোকে রাত্তিরে বলে আসতে পারত, ভাইসব, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো, ভোরে আমায় জিনিসপত্র দিতে হবে, তাহলে চমৎকার হত। সীমার জন্যে পাতিলেবু এবং আমড়া অবশ্যই চাই। আমড়া না পেলে চালতে। দেরি হয় এই জন্যেই। এসবের চাটনি ভরদুপুরে সীমা খায় রসিয়ে-রসিয়ে, আর সেই কারণেই রতনের ওসব একটুও খেতে ইচ্ছে করে না। সীমা অবশ্য বলে, ব্যাটাছেলে টক। খাবে কী!
বাজারের থলে নিয়ে ফিরছিল রতন, এমন সময় চায়ের দোকান থেকে কে যেন ডাকল। ঘাড় ঘোরাবার যার সময় নেই, দুবার ডাক শুনলে সে কী করে। অপরেশ! বেঞ্চিতে পা তুলে বসে চা খাচ্ছে। রতন চেঁচাল, কী বলছ?
এদিকে এসো দাদা, জরুরি খবর আছে।
রতন কাছে এল, তাড়াতাড়ি বলো, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
আঃ দেরি! চা খাবে? না। বলতে বিশ্রী লাগল যদিও। তুমি মাইরি বউদিকে বড্ড ভয় করো।
কোন শালা করে না! চটপট বলো যা বলবে।
তোমার কোথায় অপারেশন হয়েছিল?
কেন?
আমারও আলসার হয়েছে।
রতন শক্ত হল। অপরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু জরিপ করল। তারপর বলল, হাসপাতালে যাও, হাসপাতালে যাও।
বলে আর দাঁড়াল না। অপরেশটা রসিকতা করছে কিনা কে জানে! রতনের সব হারানোর মূল তো ওই আলসার। আহা, কী আরামেই না তখন দিনগুলো কাটত! সীমা টিকটিক করত কিন্তু পাত্তা দিত না রতন। তারপর যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ তখনই ওই মেয়েছেলেটা তাকে কজা করে ফেলল। সেবার নাম করে-করে ওকে শিশু বানিয়ে দিল। নার্সিংহোমে মতলবটি হাসিল করে এখন দুপুরে চাটনি খাচ্ছে।
অফিসে বসেই সামনের প্যাডে চারটে জিনিসের নাম লিখে রাখল রতন, যদি ভুলে যায়! জামাকাপড় পরে বের হওয়ার সময় অর্ডারটা ছুঁড়ে দিয়েছিল সীমা। সারাটা পথ জপতেজপতে আসা হয়েছে। ছেলের বাবার ঘন দুধের টিন, কর্নফ্লেক্স, আর-আর-একটা ক্রুশ চিহ্ন এঁকে। রাখল রতন। এটাও অপারেশনের পর তাকে দিয়ে আনাচ্ছে সীমা। প্রথমদিন যখন। দোকানদারকে স্লিপটা দিয়ে ঢাউস প্যাকেটটা হাতে নিয়েছিল তখন নিজেকে চোর বলে মনে। হয়েছিল। যতই প্যাকেটের লেবেল খবরের কাগজে ঢেকে নিয়ে যাক লোকে বুঝতেই পারছে কী বস্তু নিয়ে হাঁটছে সে।
সাড়ে দশটায় অফিস ফাঁকা। তার তখন দু-একজন ছাড়া কেউ টেবিলে নেই। আজকাল। লেটফেটের তোয়াক্কা করে না কেউ। এই কারণেই মনে-মনে এক ধরনের গ্লানি অনুভব করে। রতন। মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় ওপরওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে, এটা কী নিয়ম? কিন্তু সীমা বলেছে, তোমার কী দরকার? নিজের চরকায় তেল দাও।
এই অফিসে উপরিটা খুব চালু। পাবলিক, মানে হালদার পাবলিক নিয়ে কারবার বলেই সব সময় পাত্তি হাওয়ায় ওড়ে। রতন যে সেকশনের চার্জে, সেখানে কন্ট্রাক্টরদের আনাগোনা। না চাইতেই পকেট ভরে যায়। অবশ্য সেগুলো নির্বিকার মুখে খার্লি করে সীমা। মুখে বলে, তোমার অপারেশনের সময় হাত ফরসা হয়ে গিয়েছিল গো। তা নিজে একা খেয়ো না, অন্যদেরও দিও। তাহলে কোনও অসুবিধে হবে না। ছেলেবেলায় বাপ মা শেখায়নি দিয়ে খেতে? কী মানুষ বাবা! তারপরেই গলা নামায়, ভাগ না দিলে পেছনে লাগবে সবাই, মনে রেখো।
মিষ্টি গন্ধটা নাকে যেতেই বুকের ভেতর বাতাসটা ভারি হয়ে গেল। রতন মুখ তুলে দেখল কেতকী মুখার্জি সামনে দাঁড়িয়ে। আহা, কি ফিগার। সরকারি অফিসে সুচেহারার মহিলাদের দেখা যায় না। কেতকী যে কী করে এলেন তিনিই জানেন। ওদের ঠিক নিচের তলায় মহিলার আসন। রতনের সঙ্গে কখনও বাক্যালাপ হয়নি। সুন্দরী রমণীরা উন্নাসিকা বলেই আকর্ষণীয়া। রতন দূর থেকে দেখত আর গপ্পো শুনত। আজ টেবিলের সামনে এঁকে দেখে কেমন নার্ভাস হয়ে গেল সে।
আপনিই তো রতনবাবু?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন-বসুন, কী সৌভাগ্য। রতন সোজা হয়ে বসতেই মচ করে শব্দ হল। সঙ্গে-সঙ্গে সতর্ক হল সে। বেশি নড়াচড়া করলেই দ হয়ে যেতে হবে।
সৌভাগ্য কেন?
জিভ ভারি হয়ে গেল রতনের। কেতকী যে সীমার চারগুণ বেশি সুন্দরী, দশগুণ মদির এবং একশো গুণ উত্তপ্ত–তা কী করে বোঝানো যায়, রতন হাসাল। হাসি অনেক সময় উত্তরের বিকল্প হয়।
কেতকী বললেন, আমাকে এস্টাব্লিশমেন্টের স্বপন পাল বলল একমাত্র আপনি হেল্প করতে পারেন। তাই চলে এলাম। আমার অবশ্য বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে!
রতনের পিঠ টনটন করছিল। সীমা মাইরি জীবনে অমন বড় গলার ব্লাউজ পরল না। কী সুন্দর কচি তালশাঁসের মতো দেখাচ্ছে! ব্যথাটাকে অস্বীকার করে রতন বলল, না, না, আপনি হুকুম করুন।
আপনি কী ভালো। কেতকী যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, ব্যাপার হল, আমার একটা স্টাফড চিতাবাঘ চাই।
ঠিক শুনেছে কিনা বুঝতে পারছিল না রতন, কী?
স্টাফড চিতাবাঘ। আপনার এক কন্ট্রাক্টরের দোকান আছে চৌরঙ্গিতে। আপনি বললে সস্তায় পাওয়া যাবে। হাসলেন কেতকী, জ্যান্ত পাব না তাই মরায় শখ মেটাই।
এতক্ষণ বুঝে গেছে রতন। জন্তুজানোয়ার মরলে তার নাড়িভুড়িমাংস ফেলে দিয়ে খোলসটাকে এমনভাবে ফুলিয়ে রাখা হয় যে দেখলে মনে হবে আসলটি, এইমাত্র হেঁটে যাবে। কেতকী তাই চাইছেন। দোকানটা যে পানওয়ানির তা জানতে সময় লাগল না। এই মুহূর্তে পানওয়ানির একটা কাজ আটকে আছে রতনের কাছে। অতএব–। সে একগাল হাসল, এ তো তুচ্ছ ব্যাপার, কখন চাই?
সত্যি! আজই ভালো হয়–চারটে নাগাদ বের হবেন?
চারটে শুনে একটু মুষড়ে গেল রতন। ছুটির আগে বের হওয়া অভ্যাস নেই। সে বলল, পাঁচটার পর গেলে হয় না?
হয়, কিন্তু এত ভিড় বাড়ে। ঠিক আছে। কেতকী বলেছিল যে একসঙ্গে না বেরুলেই ভালো। অফিসের লোকেরা বড্ড কেচ্ছা করে। শুনে বুকের ভেতরটা নড়বড়ে হয়ে গেল। গ্লোব সিনেমার সামনে তাই দাঁড়িয়েছিল রতন। আগে জানলে একটু ভালো জামা-কাপড় পরা যেত। আজ কিছু আমদানি হয়নি বলে অফিস থেকে পঞ্চাশটা টাকা ধার করে এনেছে সে। প্রায় সাড়ে পাঁচটায় কেতকী এলেন। আহা, মেয়েরা সারাদিন অফিস করেও এত সুন্দরী থাকে কী করে? কেতকী। বললেন, অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি, না?
না, না, এই তো এলাম।
সত্যি আপনি খুব ভালো। এতদিন যে কেন পরিচয় হয়নি!
রতন খুব সাহস করে বলল, আমার দুর্ভাগ্য বলে!
আমারও হতে পারে। কেতকী আড়চোখে তাকালেন।
রতন খুব বড় একটা নিশ্বাস ফেলল। সীমা কোনওকালে এই গলায় কথা বলেনি। এই যে কেতকীর পাশাপাশি সে হাঁটছে, ভিড় বাঁচাতে দু-তিনবার কেতকীর কাঁধ ওর বাজুতে ছুঁয়েছে তাতে যে এমন নেশা-নেশা লাগে তাই বা কে জানত!
পানওয়ানি খুব খাতির করল। না করে অবশ্য উপায় ছিল না। প্রায় বিশহাজার টাকার একটা বেনিফিট ওর কাছে পাবে ব্যাটা। টেন পার্সেন্ট যে জলে চলে গেল এটা টের পেতেই একটু চিনচিন করে উঠল পিঠটা। কেতকীকে যে সুবিধা দিচ্ছে পানওয়ানি, তার পরে আর মাল পাওয়া যাবে না। সহকর্মীদের কথা ভাবছে না রতন, সীমাকে কী কৈফিয়ত দেবে সে! রাত্রে বিছানায় বডি ফেলে সেসব গল্প করে সীমার কাছে। সম্ভাব্য এই উপরিটার কথাও যে বলা হয়ে গেছে। অবশ্য বলা যায়, হল না, লোকটা চামার তাই সৎ হতে হল। বিশ্বাস করবে না সীমা। রতন যে একটা ঠগ, জোচ্চোর, অসৎ মিথ্যেবাদী–এটাই ওর দৃঢ় বিশ্বাস।
কেতকী ডাকলেন, আপনার পছন্দ হয়েছে রতনবাবু?
একটা ফুটদুয়েক উঁচু চিতাবাঘের বাচ্চা। চট করে দেখলে একদম জ্যান্ত বলে মনে হয়। চোখে বোধহয় মার্বেল ঢোকানোরতনের গা শিরশির করল। সে ঘাড় নাড়ল। চারধারে বিভিন্ন মৃতপশুকে জ্যান্তের ভানে দাঁড় করানো আছে। অমন যে হিংসুটে বাজপাখিটা সেও মৃত। বিভিন্ন মুডে পশুগুলোকে রাখা হয়েছে। হঠাৎ রতনের মনে হল একজন মেমসাহেব ওকে দেখছে। তাকেও কী স্টাফড মনে করছে বুড়ি। সে চোখের পাতা ফেলল, হাত নাড়ল এবং তারপর। কেতকীকে প্রশংসার গলায় বলল, আপনার পছন্দ আছে।
কেতকী গলিত হলেন। কিন্তু পানওয়ানিকে খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে রতনের, মানুষের শরীর স্টাফড করা যায় না কেন?
ট্যাক্সিতে উঠে কেতকী বললেন, আপনি কোনদিকে?
উলটোডাঙা।
ওমা, তাই নাকি! আমি সল্টলেকে। কী ভালো, উঠে আসুন নামিয়ে দিয়ে যাব। সত্যি, আপনি না থাকলে এত সস্তায় এ জিনিস পেতাম না।
মাঝখানে চিতাবাঘটা হিংস্র চোখে দাঁড়িয়ে, দুই জানলায় ওরা দুজন। মনে-মনে মাথা নাড়ল রতন। কেতকী তাকে বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামালেই সর্বনাশের বাকি থাকবে না। আমাকে নিয়ে বের হতে গেলে তোমার অম্বল হয় অথচ পরের মেয়েছেলে নিয়ে ফুরতি করতে খুব মজা লাগে!
গাড়িটাকে ভি.আই.পি. রোডে যেতে দেখে স্বস্তি পেল রতন। যাক, ওখান থেকে আর উলটোডাঙায় উজিয়ে যাওয়া যাবে না। কেতকী বললেন, জানেন, আমি না খুব ছিমছাম থাকতে ভালোবাসি। আমার কর্তা বলেন এটা নাকি আমার বাতিক।
বেশ অবাক হল রতন। কেতকী যে বিবাহিতা তা টের পায়নি সে। না কোনও চিহ্ন, না অফিসের সূত্রে! অবশ্য শেষটি সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল নয়, কারণ তাদের বসার জায়গা আলাদা ফ্লোরে।
সে জানে না কেন, তবু দুঃখিত গলায় বলল, বাতিক কেন হবে?
বলুন! জাহাজের ইঞ্জিনিয়ারের আর যাই থাক–। কথা শেষ করলেন না কেতকী।
উনি জাহাজের?
হ্যাঁ। ছ’মাস তো জলেই ভাসেন।
সঙ্গে-সঙ্গে শরীরটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল। রতনের কেবলই মনে হচ্ছিল, কেতকীর সঙ্গে কথা বলে, হেঁটে, গাড়িতে বসে তার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠছে।
কেতকী বললেন, আপনার যদি অসুবিধে না হয়, চলুন না আমার বাড়ি দেখে আসবেন। এত করলেন আমার জন্যে, আজকাল তো স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না।
থাক।
কেন?
খুব সাহস করে রতন বলল, হয়তো আমার কোনও স্বার্থ বেরিয়ে পড়বে।
হাসিতে ভেঙে পড়লেন কেতকী, বাব্বা, আপনার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা যায় না! না, কোনও কথা শুনতে চাই না, একটু কফি খেতেই হবে। ইচ্ছে করছিল কিন্তু জাহাজের ইঞ্জিনিয়ারকে দেখতে চাইছিল না রতন। বলল, আপনারও তো অসুবিধে থাকতে পারে!
ওমা, তাহলে বলব কেন? বাড়িতে আমার শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই।
তিনি?
ও, তাই বলুন। তিনি এখন প্রশান্ত মহাসাগরে সাঁতার কাটছেন। আমার মতো ছোট বিলে আসার সময় নেই।
বিল না দিঘি?
আবার হেসে বিগলিত হলেন কেতকী।
সত্যি বড় সুন্দর বাড়ি কেতকীর। খুব যত্ন করে চা দিলেন তিনি। চিতাবাঘটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বললেন, এটাকে দেখলেই আপনার কথা মনে পড়বে।
রতনের আর একটু দু:সাহসী হতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পিঠে বড় ব্যথা হয় ওসব বাসনা হলে। বিদায় নেওয়ার সময় কেতকী বললেন, এই, ইচ্ছে হলেই চলে আসবেন, ? মাথা নাড়ল রতন। নিজেকে খুব সুখী মনে হচ্ছিল ওর। শেষমুহূর্তে কেতকী বললেন, একটা কথা, অফিসের কাউকে এসব বলবেন না। মধ্যবিত্ত বাঙালিরা ভীষণ কুচুটে হয়!
প্রায় উড়তে-উড়তে বাড়ি ফিরছিল রতন। ব্যাপারটা যখন গোপন রাখতে চাইছেন কেতকী তখন অনেক সম্ভাবনা আছে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নিজের অজান্তে পা ভারী হয়ে গেল তার। হ্যাঁ, বড় রাত হয়ে গেছে। সীমার মুখখানা নিশ্চয়ই গনগনে। কিন্তু এটা তো হতেই পারে, পুরুষমানুষের দশটা কাজে জড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। মনে-মনে তৈরি হল সে। আজ কোনও তোয়াক্কা করবে না।
দরজা খুলেই সীমার চোখ ছোট হল, কোথায় ছিলে?
কাজ ছিল।
বলে যাওনি তো? হঠাৎ হল।
কী কাজ?
সব কৈফিয়ত দিতে হবে তোমাকে?
নিশ্চয়ই। খবরদার মুখে-মুখে কথা বলোনা। ট্যাক্সিতে কার সঙ্গে যাচ্ছিলে চিতাবাঘ নিয়ে?
ফ্যাকাশে হয়ে গেল রতন। এতক্ষণের প্রস্তুতির দেওয়াল ভেঙে পড়ছে। সে সটান বাথরুমে ঢুকে গেল। বাইরে সীমা গজরাচ্ছে, লম্পট, চরিত্রহীনের সঙ্গে ঘর করা যায় না। ভাগ্যিস পাশের ফ্ল্যাটের রায়বাবু ধর্মতলায় গিয়েছিলেন, নইলে জানতেই পারতাম না এত। চোখে-চোখে রাখছি তবু স্বভাব পালটালোনা। পুরুষমানুষকে চিতায় তুললেও বিশ্বাস নেই।
সহ্য করতে পারল না রতন। ছিটকে বেরিয়ে এল সে বাইরে। তারপর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার বলছি, একদম টিকটিক করবে না। বাপমায়ের শিক্ষা পাওনি তাই এত নিচু মন।
কী! বাপ-মা তুলে কথা বললে? অন্য মেয়েছেলের সঙ্গে ফুর্তি করবে আর বললেই দোষ! আমাকে শেষ কবে ট্যাক্সি চড়িয়েছ? আজ তোমার তেজ বের করব, দাঁড়াও!
কী করবে তুমি? সীমার রণরঙ্গিণী মুখ দেখে ঘাবড়ে গেল রতন। সীমা হঠাৎ এক ঝটকায় মত। পালটে চলে গেল সামনে থেকে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন রতনের। অনেকদিন বাদে বিদ্রোহ করা গেল। কিন্তু একটু বাদেই ক্রমশ শীতল হয়ে যাচ্ছিল সে। গেল কোথায় সীমা? যা রাগী মেয়ে, আত্মহত্যা-টত্যা করে বসবে না তো! সে পাশের ঘরে উঁকি মারল। খোকা একলা ঘুমুচ্ছে। ফ্ল্যাটে সীমা নেই। ধক করে উঠল বুকের খাঁচা। পিঠটা এমন টনটন করছে যে দাঁড়াতে পারছে না সে। বাইরের দরজা হাট করে খোলা। উঁকিঝুঁকি মেরেও সীমার দর্শন পাওয়া গেল না। কোথায় গেল ও? রেগেমেগে অন্য কোনও ফ্ল্যাটে গিয়ে বসে নেই তো? না, এত রাত্রে নিশ্চয়ই যাবে না। সীমা যদি আত্মহত্যা করে?
হঠাৎ কেমন অসহায় বোধ করল রতন। এবং অবসন্ন। নিজেকে শেকড়- ছেঁড়াবৃক্ষের মতো মনে। হচ্ছিল তার। এবার আর দাঁড়াতে পারছিল না সে। দরজা ভেজিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল নিজের অজান্তেই।
ঘুমিয়ে পড়েছিল হয়তো, কারণ কখন সীমা ঘরে ঢুকেছে টের পায়নি। কটকটে আলো জ্বলছে ঘরে। হাত-পা নাড়তে গিয়ে চিৎকার করে উঠল রতন। ওপর-নীচ দুদিকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, বিন্দুমাত্র নড়তে পারছে না।
চোখের সামনে সীমা কোমরে হাত রেখে বিজয়নীর হাসি হাসল, খুব তেল হয়েছে, না? অপারেশনের সময় আসলটা খুলে প্লাস্টিকেরটা ঢুকিয়েছি তাতেই এত তেজ! এবার ঠান্ডা করছি।
রতন ডুকরে উঠল, না, না, প্লিজ, তোমার পায়ে পড়ছি মাইরি।
পুরুষমাত্রই বাঁদর, আর কখনও বিশ্বাস করি? ভাবলাম প্লাস্টিক ভেঙে যাবে এই ভয়ে বেশি বাঁকাবে না! তাতেও রক্ষা নেই!
এই মুহূর্তে সীমাকে দক্ষ সার্জেনের মতো লাগছিল। সামনের আলমারির পাল্লা খোলা। ওর চাবি কখনও হাতছাড়া করে না সীমা। কয়েক পা এগিয়ে এসে রতনের পিঠের ওপর হাত রাখল।
হাতটা দ্রুত নীচে নেমে গিয়ে মেরুদণ্ডের শেষপ্রান্তে স্থির হল। সেখানে একটা ছোট্ট গর্তের মুখ চাকতিতে ঢাকা। সেটা সরিয়ে টান দিতেই রতনের মনে হল সমস্ত শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে। পরিত্রাহি চিৎকার করল সে।
হিসহিসে গলায় সীমা বলল, এঃ এর মধ্যেই প্লাস্টিকেও মাংস গজিয়ে ফেলেছ! কি ধুরন্দর বেটাছেলে! একদিনেই এত?
বেশ কয়েকবার টানাটানির পর ওটা সরসর করে খুলে এল। সাদা প্লাস্টিকের লম্বা বস্তুটিকে আলোয় ধরে জরিপ করল সীমা। যে রাতে সে বিরক্ত হতে চায় না সেই রাতে এটাকে খুলে রাখে, যেমন গতকাল রেখেছিল। আজ একদিনেই মাংস লাগছিল, সামান্য চিড় ধরলেও ভাঙেনি। মোটেই ভালো কথা নয়।
আলমারির ভেতর সযত্নে রাখা আসল মেরুদণ্ডটির পাশে প্লাস্টিকেরটাকে শুইয়ে দিল সীমা। এটিও চলবে না। তারপর মসৃণ আর একটি মেরুদন্ড বের করে রতনের শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, একদম বেয়াদপি করবে না, এটা মোমের বেঁকালেই ভাঙবে। কী জানি বাবা, বেটাছেলে বলে কথা, মোমেও মাংস গজাবে হয়তো! কেউটের জাত!
চোখ খুলে সামনের আয়নায় রতন দেখল একটি স্টাফড মানুষ শুয়ে আছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন