বিকাশ আমার বন্ধু। বিকাশ বিয়ে করবে। না করে উপায় নেই। ব্যাংকে ভালো চাকরি পেয়েছে। পরিবারের একটি মাত্র ছেলে। নিজেদের বাড়ি আছে। বাবা মারা গেছেন। মায়ের বয়েস হয়েছে। বিকাশের বিয়ে অবশ্যম্ভাবী। আত্মরক্ষার জন্যেও বিয়ের প্রয়োজন। এদেশে অবিবাহিতা মেয়ের অভাব নেই। সকলেই যে প্রেম করবেন তা-ই বা আশা করা যায় কী করে! মেয়ের বাপ-মাকেই ভালো পাত্র ধরার জন্যে উদ্যোগী হতে হয়। বিকাশের হয়েছে মহা বিপদ। বিকাশ যেন তাজা ফুলকপি। বিকাশ যেন গঙ্গা থেকে সদ্য তোলা একটি ইলিশ মাছ। যাঁরা তাকে চেনেন, জানেন সকলেই তাঁকে ওই দৃষ্টিতে দেখেন। ঝোলাতে হবে, মেয়ের হাতের ইলিশ করে।
দু-চার কথার পরেই তাঁদের প্রশ্ন ইলিশের তেলের খোঁজে চলে যায়। কড়ায় ছাড়লে বিকাশ কতটা তেল ছাড়বে! ব্যাংকের চাকরি? বাঃ বাঃ। কোন ব্যাংক? ন্যাশন্যালাইজড? এখন পাচ্ছ। কত? পাকা চাকরি? বেড়ে বেড়ে কোথায় উঠবে? প্রোমোশান আছে? বাঃ বাঃ। তা ছুটিছাটার দিন। এসো না একদিন। একটু ফ্রায়েডরাইস, চিকেন। রবীন্দ্রসংগীত নিশ্চয় ভালোবাসো। উমা আজকাল ভীষণ ভালো গাইছে। পল্লব সেনের প্রিয় ছাত্রী। তুমি ছবি ভালোবাসো না, ছবি? মেয়েটার আঁকার হাত দুর্দান্ত। নিজের মেয়ের প্রশংসা করা উচিত নয়। তবু না বলে পারছি না।
বিবাহযোগ্যা বাঙালি মেয়ের মা-বাবার, বিশেষ করে মায়েদের যে কী উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের দিন কাটাতে হয় তা আমি জানি। কারণ আমার একটি বোন আছে। আমার মায়ের ঘুম চলে গেছে। এই বুঝি মেয়ে প্রেম করে বসল! এই বুঝি কোনও পাড়াতুতো মাস্তান মেয়ের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আমার মায়ের যত রকমের উদ্ভট চিন্তা! আমার বাবার জীবন অতিষ্ঠ। বাবা অফিস। থেকে ফেরামাত্রই প্রথম প্রশ্ন, কী খোঁজ নিয়েছিলে?
সারাদিন অজস্র কাজের চাপে বাবার কিছু মনেই নেই, ফলে মিথ্যে বলে কি অভিনয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না। পালটা প্রশ্ন, কী খোঁজ বলো তো?
ব্যস লেগে গেল ধুমধাড়াক্কা। ওই মেয়ে যখন তোমার মুখে চুনকালি মাখাবে তখন বুঝবে। সেইদিন তুমি বুঝবে। সেইদিন তোমার শিক্ষা হবে। কেউ বলবে না তখন আমার মেয়ে। সবাই তোমার নাম করে বলবে, ওমুকের মেয়ে।
বাবার আর জামাকাপড় ছাড়া হল না, বিশ্রাম হল না, চা খাওয়া হল না। রেগে বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, আজ আমি যাকে পাব তাকেই ধরে আনব।
খামোখা মাইলতিনেক অকারণ হেঁটে ধুকতে ধুকতে ফিরে এলেন রাত দশটায়। এই ভ্রমণের নাম প্রাতভ্রমণ নয়, পাত্রভ্রমণ। এ তো হল গিয়ে রাগের পাত্রভ্রমণ। ঠান্ডা মাথায় পাত্রভ্রমণ অহরহই চলছে। ভালো চাকুরে, অবিবাহিত ছেলেরা ঠিক ধরতে পারে। ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা মাছ ধরতে বেরিয়েছেন। বগলে অদৃশ্য ছিপ। ছিপের সুতোয় ঝুলছে টোপ-গাঁথা বঁড়শি। মেয়ের গুণের টোপ, বংশপরিচয়ের টোপ, ভালোমন্দ দেয়াটেয়ার টোপ। অনেকে আবার একটু বেশি দুঃসাহসী। চোখ দিয়ে দেহ জরিপ করেন, বুকের ছাতি, গলার মাপ। কেউ কেউ আবার কায়দা করে হাতের গুলি মেপে নেন। এই তো চাই, ফাইন ইয়াং ম্যান। এই তো চাই। সাহস, কারেজ, হেলথ। ওপর বাহুটা কথা বলতে বলতে ধরে, তাগার মতো মেপে নিলেন। দেখে নিলেন কতটা তাগড়া। বিয়ের ধাক্কা, সংসারের ধাক্কা সামলাতে পারবে কি না। ক্ষইতে কতটা সময় নেবে বাবাজীবন। পরে হয়তো একটু উপদেশ যোগ করলেন—ব্যায়ামট্যায়াম করো, একটু ভালোমন্দ সময়মতো খাও, শরীরম আদ্যম। শরীরটাই সব।
বাজারের মাছ আর ব্যাগের মাছের যা পার্থক্য। কোনওক্রমে একটা ব্যাগে ঢুকে গেলে, আর দরদস্তুর নেই। কানকো তুলে তুলে দেখা নেই। বিকাশ সেই কারণেই ব্যাগে ঢুকে পড়তে চায়। ছেলে ভালো। তেমন লোভী নয়। শ্বশুর মেরে হন্ডা চাপতে চায় না। সেরকম বন্ধুও আমার আছে। সোমেন। সে তো প্রায় দফতর খুলে বসেছিল, রাজনৈতিক নেতাদের মতো। পার্টি-অফিস। ঠিক সে খোলেনি। খুলেছিলেন তার পিতা। ছেলের পেছনে ভদ্রলোকের যথেষ্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল। অভাব সত্বেও ছেলেকে সাংঘাতিকভাবে মানুষ করেছিলেন। ছেলেও সরেস ছিল। শেষে। আইএএস হয়ে পাড়া-প্রতিবেশীকে তাক লাগিয়ে দিলে। এম.এ-তে ফার্স্টক্লাস পাবার পরই আমাদের সঙ্গে ব্যবধান বাড়তে লাগল। আইএএস হবার পর আমাদের কোনওরকমে একটু চিনতে পারত। ভালো পোস্টিং হয়ে যাবার পর পথেঘাটে দেখা হলে, চোখে চোখে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিত। টর্চলাইট ফেলার মতো। সোমেনের বাবা বলতেন, ছেলে হল হিরে। কত খুঁজে তোলা হল। তারপর অভিজ্ঞ হাতে কাটাই-ছাঁটাই। কম খরচ! তারপর নিলাম। একলাখ বিশ! দেড় লাখ! তিন লাখ! কে হাঁকবে দর? মেয়ের বাবারা।
সোমেন নামক হীরকখণ্ডটি প্রায় তিন লাখে বিকিয়ে গেল। জাহাজ থেকে মাল খালাসের বিজনেস ছিল শ্বশুরমশাইয়ের। বেহালায় বিশাল বাগানবাড়ি। সেই বাগানে আবার ফোয়ারা। মার্বেল। পাথরের উলঙ্গ নারীমূর্তি। সোমেনের বাবার সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল। বড়লোকের কন্যাটি অসুন্দরী ছিল না; তবে যাদের ঘরে ছ-ছটা গরু থাকে তাদের ছেলেমেয়েরা একটু গায়েগতরে হবেই। আর বড়লোকেরা একটু মোটাসোটা না হলে মানায় না। মেদ হল অর্থের বিজ্ঞাপন। ঘেঁকুরে বড়লোক হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কাগজে বিজ্ঞাপন লাগাতে হবে। বড়লোকের নানা শরীর-লক্ষণ থাকা উচিত। কর্তার পঞ্চাশের পর রক্তে চিনি। চায়ের কাপে আয়েশ করে। স্যাকারিনের পুঁচকি ট্যাবলেট ফেলতে ফেলতে বলবেন, একটু বেড়েছে, একশো আশি। অর্থাৎ ওদিকে ব্যাংকে যত বাড়ছে, সেই অনুপাতে এদিকেও বাড়বে। মানি হল হানি। টাকা হল সুগার কিউব। রক্ত তো বটেই। তা না হলে রক্তের চাপ বাড়ে কেন? চল্লিশের পরেই গৃহিণীর বাত। বাতের জন্যেই রাজহংসীর মতো চলন। মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু মোটা। সোমেনের বাবা। কোনওরকমে একতলা একটা বাড়ি করেছিলেন। প্লাস্টার আর রং ছিল না। বেয়াইমশাই। মেয়েকে পাঠাবার আগে একদল কন্ট্রাকটার পাঠালেন। তাঁরা এক মাসে আড়াইতলার একটা ছবি খাড়া করে দিলে। কটক থেকে মালি এসে চারপাশের খোলা জায়গায় ফুল ফুটিয়ে দিলে। দু তিন লরি ফার্নিচার ঢুকে পড়ল হইহই করে। তারপর বাজল সানাই। সে কী সুর কালোয়াতি! পাড়া-প্রতিবেশীর বুকের চাপাকান্না যেন বাতাসে কাঁপছে। প্রতিবেশীরা কাঁদবেই তো। সোমেনের বাবা ছিলেন সামান্য মানুষ। অবস্থা তেমন ভালো না। জীবনের প্রথম দিকটায় খুচখাচ ব্যবসা করতেন। শেষটায় করতেন ঘটকালি। সেই মানুষ কীভাবে একটা একতলা বাড়ি করলেন! আধা গেঁচড়া হলেও মাথার ওপর ছাদ তো! সেইটাই তো প্রতিবেশীর কাছে বিশাল এক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তো, নিজেদের প্রশ্ন, আমরা কেন পারলুম না! যেই মনে হল, আমরা কেন পারলুম না, অমনি ভেতরে শুরু হল শৃগালের কান্না। যাক, সোমেনদের বাড়ি হওয়ার ক্ষত শুকোতে না শুকোতে, সোমেনের এমএ-তে ফার্স্টক্লাস ফাস্ট হওয়া। সে যেন পুরোনো ক্ষতে। নুনের ছিটে। একটা ছেলে চোখের সামনে তরতর করে সৌভাগ্য আর প্রতিপত্তির দিকে এগিয়ে যাবে—এ তো সহজে সহ্য করা যায় না। এর পরের মস্ত আঘাত হল সোমেনের আইএএস হওয়া। যাঃ সর্বনাশ! এ ছেলেকে তো শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনায় সাধারণের স্তরে আটকে রাখা গেল না। এ তো অফিসার হবেই। গাড়ি, কোয়ার্টার, মোটা মাইনে, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা সবই তার হাতের মুঠোয়। চিন্তায় চিন্তায় একপাড়া লোক রোগা হয়ে গেল। আমরা তখন সোমেনকে বয়কট করলুম। যে ছেলে অসামাজিক হয়ে যাবে, তার সঙ্গে খাতির রেখে আর লাভ কী? শেষ আঘাত সোমেনের বিয়ে। আমরা নিমন্ত্রিত হওয়া সত্বেও, না গেলুম বরযাত্রী, না গেলুম বউভাতে। যে ছেলে বিয়েতে শ্বশুরকে দোহন করে পণ নেয়, উপহার নেয়, সে একটা নির্লজ্জ লোভী। তার অনুষ্ঠানে যাওয়াটাও পাপ। বড়লোকের আবার না চাইতেই কিছু তাঁবেদার জুটে যায়। সোমেনের পক্ষে অনেকে বলতে লাগলেন, শ্বশুরের আছে তাই দিয়েছে, সে তত আর চায়নি। চেয়েছে কি চায়নি বুঝল কী করে?
বিকাশ বললে, সোমেনের মতো আমি চামার নই। একটা পয়সাও আমি নেব না। তবে হ্যাঁ, আমার একটা শর্ত আছে মেয়েটি সুন্দর হওয়া চাই। বউ নিয়ে বুক ফুলিয়ে যেন রাস্তায় হাঁটতে পারি। বিকাশের মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, ছেলেকে আমি নিলামে চড়াব না। তবে মেয়ে পক্ষ যদি মেয়েকে ঘর সাজিয়ে দিতে চান, তাহলে আমি রোজগেরে ছেলের অহংকারে অপমান করতে পারব না। লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা। অহংকার একেবারে সহ্য করতে পারেন না।
শনিবার-রবিবার বিকাশের কাজই হল আমাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে বেরোনো। একটা ব্যাপার লক্ষও করছি, ছেলেরা যখন বেকার থাকে তখন সে প্রেমিক। প্রেম করে বেড়ায়। যেই সে ভালো চাকরি পেল, অমনি তার প্রেম ঘুচে গেল। তখন তার আটঘাঠ বেঁধে, ঠিকুজি-কোষ্ঠী মিলিয়ে বউ আনার তাল। বিকাশের একজন প্রেমিকা ছিল, তাকে আর পাত্তাই দেয় না। আমি জিগ্যেস করেছিলুম, ব্যাপারটা কী। প্রথমে বলতেই চায় না, শেষে বললে, আমি একটু ভালো মেয়ে চাই। আর এখন আমার চাইবার অধিকারও এসেছে। প্রেমের আবেগে বোকামি করলে আমাকেই পস্তাতে হবে। সারা জীবনের ব্যাপার। সারা জীবন প্রেমের চশমা পরে একটা মেয়ের দিকে তাকানো সম্ভব নয়। বাস্তব হল অঙ্কের মতো।
তোর প্রেমিকাটি তো ভালোই দেখতে।
ভালো দেখতে হলে কী হবে, ভীষণ ঘামে আর সর্দির ধাত।
আমি হাঁ করে বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। পৃথিবীতে কত রকমের মাল আছে ভগবান!
জিগ্যেস করলুম, একটা মেয়েকে বাইরের দেখায় তুই রূপটা দেখলি, অন্তরঙ্গ খবর পাবি কী করে! ঘামে কি না, সর্দি হয় কি না! তোকে তাহলে অবজেকটিভ টেস্টের মতো প্রশ্নপত্র বিলি করতে হবে রে! তুই কী চাস বল তো!
অনেক মেয়ে আছে খাওয়াদাওয়ার পর ঢেউ করে গ্যাসের রুগির মতো সেঁকুর তোলে।
তারপর?
সেফটিপিন দিয়ে দাঁত খোঁটে। হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মোছে। চিৎকার করে কথা বলে। দুমদুম করে সিঁড়ি ভাঙে। কথা বলার সময় গায়ে ধাক্কা মারে। দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারে না, পা নাচায়। খাওয়ার সময় চ্যাকোর চ্যাকোর শব্দ করে। ঠুকে জিনিস রাখে। চিরুনিতে চুল ওঠে। মাথায় খুসকি হয়। পেটে হুড়হুড় গুড়গুড় শব্দ হয়। জ্বর হলে উ আঁ করে। ধনুকের মতো বেঁকে। শোয়। হাঁউ হাঁউ করে হাই তোলে। নির্জনে নাক খোঁটে। খেতে বসে আঙুল চোষে। দাঁত দিয়ে নখ কাটে।
অসম্ভব! তোর বিয়ে হওয়া অসম্ভব। হলেও ডিভোর্স হয়ে যাবে। এই সব ডিফেকট একটা মেয়ের খুব কাছে না এলে ধরা যায় না।
ধরার চেষ্টা করতে হবে। বউ করব বাজিয়ে। এ তো প্রেম করা নয়, যে মেনে নিতে হবে প্রেমের প্রলেপ দিয়ে। আমি সব শুনে রাখলুম। মনে মনে হাসলুম। এমন মেয়ে মানুষের বাড়িতে মেলা অসম্ভব। কুমোরটুলিতে অর্ডার দিতে হবে। স্বয়ং মা দুর্গাও হয়তো অসুর মারার সময় ঘেমেছিলেন।
রবিবারের এক বিকেলে আমরা রামরাজাতলায় মেয়ে দেখতে গেলুম। বেশ বড় সাবেক আমলের বাড়ি। গ্যারেজ আছে। বিকাশ ঢুকতে ঢুকতে বললে, আমার ষষ্ঠ অনুভূতি বলছে, এই বাড়িই আমার শ্বশুরবাড়ি।
হলেই ভালো। তবে তোমার যা চাহিদা!
বৈঠকখানায় আমরা বসলুম। বসতে না বসতেই মেয়ের বাবা সবিনয়ে এসে হাজির। মোটাসোটা এক ভদ্রলোক। ঢোলা পাঞ্জাবি পরিধানে। ভুঁড়িটা সামনে ফুটবলের মতো উঁচু হয়ে আছে। ভদ্রলোক সোফায় বসামাত্র বিকাশ উঠে দাঁড়াল।
ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হল আপনার?
আমার পছন্দ হল না। বিকাশের সরাসরি উত্তর।
কী করে! আপনি তো আমার বোনকে এখনও দেখেননি।
বিকাশ একটু থতমতো খেয়ে গেল। আমরা দুজনেই ভদ্রলোককে পিতা ভেবেছিলুম। মেয়ের দাদা বললেন, আমার বোনকে আগে দেখুন, তারপর তো পছন্দ-অপছন্দ!
বিকাশ বললে, শুধু শুধু আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। আপনাকে দেখেই আমার ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে আপনার মতোই হবে। আপনারই স্ত্রী-সংস্করণ।
ভদ্রলোক বেশ আহত হয়ে বললেন, ছিঃ চেহারা তুলে কথা বলবেন না। এটা এক ধরনের অসভ্যতা।
আমি বললুম, আমার বন্ধুর কোনও দাবি-দাওয়াও নেই, পছন্দ হলেই পত্রপাঠ কাজ সারবে। তবে ওর একটাই শখ, বউ যেন সুন্দরী হয়।
ভদ্রলোক বললেন, আমাকে দেখে আমার বোন সম্পর্কে কোনও ধারণা করলে ভুল করবেন। সে কিন্তু প্রকৃতই সুন্দরী।
বিকাশ বললে, ও ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারলে না। আমি শুধু সুন্দরী মেয়েই চাই না, আমি চাই সুন্দরের বংশ। আপনি আমার শ্যালক হলে পরিচয় দিতে পারব না। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, গেট আউট। আভি নিকালোহিয়াসে।
আমরা এক দৌড়ে রামরাজাতলার রাস্তায়। ভদ্রলোক এই ভদ্রতাটুকু অন্তত করলেন, যে রাস্তা পর্যন্ত তেড়ে এলেন না। এলে পাবলিক আমাদের পিটিয়ে লাশ করে দিত। বেশকিছু দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে, চা খেতে খেতে বিকাশকে বললুম, তাহলে আরও কিছু নতুন শর্ত যোগ হল?
হলই তো। একটা পয়সাও যখন নেব না, তখন বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বিয়ে করব। অনেকে কী করে জানিস তো, মেয়ের এক একটা ডিফেক্টের জন্যে টাকা দাবি করে। একটু খাটো মাপের, দু-হাজার। নাক থেবড়া, পাঁচ হাজার। চাপা রং তিন হাজার। সামনের দাঁত উঁচু, সাত হাজার। পৃথিবীটা লোভী মানুষে ছেয়ে গেছে। অনেকে দেখবি ওই কারণে ওই রকম মেয়েই খোঁজে। বিয়ে নয়, ব্যবসা।
তুই মেয়েটিকে না দেখে ওইরকম একটা অভদ্র কাণ্ড করলি কেন?
শোন লুঙ্গি পরা শ্বশুর, ভুড়িঅলা শালা, দাঁত বড় শাশুড়ি—এই সব আমার চলবে না। আমি যে বাড়ির জামাই হব সে বাড়িতে যেন চাঁদের হাটবাজার হয়।
বাড়িতে লুঙ্গি পরা চলবে না?
না, লুঙ্গি অতি অশ্লীল জিনিস। আমার শ্বশুরকে ড্রেসিং-গাউন পরতে হবে।
বেশ ভাই, যা ভালো বোঝো তাই করো।
সব সময় একটু দূর ভবিষ্যতের দিকে তাকাবি। ধর বিয়ের পর আমাদের একটা গ্রুপফোটো তোলা হল। আমার পাশে হিড়িম্বা, আমার ওপাশে সূর্পনখা, পেছনে ঘটোৎকচ, তার পাশে হিরণ্যকশিপু। কেমন লাগবে?
বেশ কিছুদিন কেটে যাবার পর শুকচরে আবার একটি মেয়ে দেখতে যাওয়া হল। সেও বেশ সাবেককালের বাড়ি বনেদি বাড়ি। লোকজন নেই বললেই চলে। বাড়ির আকার-আকৃতি দেখলে মনে হয়, শতাব্দীর শুরুতে এই গুহ ছিল শতকণ্ঠে মুখর। উঠোনের পাশে ভেঙে পড়া একটি বাড়ির কাঠামো দেখে মনে হল, এখানে একসময় একটি আস্তাবল ছিল। আমার অনুমান সত্য প্রমাণ করার জন্যে পড়ে আছে কেরাফি গাড়ির দুটি ভাঙা চাকা। বিকাশের কী মনে হচ্ছিল জানি। না, আমার মনে ভিড় করে আসছিল অজস্র মুখস্মৃতি। মনে হচ্ছিল আমি যেন ইতিহাসে ঢুকে পড়েছি। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। সামনেই চণ্ডীমণ্ডপ। ভেঙে এলেও, অস্তিত্ব বজায়। রেখেছে। পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে টাটকা স্বস্তিকা চিহ্ন দেখে বুঝতে পারলুম এখনও পূজাপাঠ হয়। উঠানের একপাশে ফুটে আছে একঝাঁক কৃষ্ণকলি আর নয়নতারা। ভীষণ ঘরোয়া ফুল। দেখলেই মনে হয় দুঃখের মধ্যে সুখ ফুটে আছে। যে সব পরিবার, বড় পরিবার ভেঙে গিয়েও নতুন করে বেঁচে আছে, নতুন ভাবে, তাঁদের সেই অতীত বর্তমানের জমিতে ফুটে থাকে কৃষ্ণকলি হয়ে। বিশাল দরজা, ততোধিক বিশাল উঠান পেরিয়ে আমরা চলেছি। তখনও মানুষজন চোখে পড়েনি। ভেতরের বাড়িতে সবাই আছেন। দূরে কোথাও একটা গরু পরিতৃপ্ত গলায় ডেকে উঠল। এই ডাক আমার চেনা—এ হল গরবিনী গাভীমাতার ডাক। আমি জাতিস্মর নই, তবু মনে হত লাগল এই বাড়ি আমার অনেককালের চেনা।
ভেতর বাড়িতে পা রাখামাত্রই শীর্ণ চেহারার এক ভদ্রলোক ছুটে এলেন। শীর্ণ কিন্তু সুশ্রী। ভদ্রলোকের পরিধানে পাজামা ও পাঞ্জাবি। মুখে ভারি সুন্দর হাসি। এক মাথা ঘন কালো চুল। ভেতরের বাড়িটা যাকে বলে চকমেলানো বাড়ি, হয়তো সেই বাড়িই ছিল এক সময়। দেখেই মনে হল বাড়িটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক আমাদের নীচের তলার ঘরে নিয়ে এলেন। বিশাল বড় ঘর। শ্বেতপাথরের মেঝে। ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই। কাপের্ট ঢাকা একটা চৌকি পাতা। ভদ্রলোক আমাদের বসিয়ে দ্রুতপায়ে ভেতরে চলে গেলেন।
বিকাশকে জিগ্যেস করলুম, কী মনে হচ্ছে? তোমার ষষ্ঠ অনুভূতি কী বলছে?
পড়তি!
আর পড়বে না, এখন একটা জায়গায় এসে আটকেছে। আর তোমার তো দাবিদাওয়া নেই।
দাবি না থাক, এই ভাঙা গোয়ালে কে বাসর পাতবে। সাপে কামড়ালে কে বাঁচাবে ভাই! লক্ষীন্দরের বাসর হয়ে যাবে। আমার ষষ্ঠ অনুভূতি বলছে, এই বাড়িতে কম সেকম এক হাজার জাতসাপ আছে।
বিকাশের কথায় গা জ্বলে গেল। আমাদের সঙ্গে রকে বসে আড্ডা মারত। চা, চপ খেত। হঠাৎ ভালো একটা চাকরি পেয়ে মাথা বিগড়ে গেছে। ধরাকে সরা জ্ঞান। মনে মনে বললুম—যা ব্যাটা মরগে যা। বিকাশের ওপর আমার একটা ঘৃণা আসছে।
ভদ্রলোক নিজেই একটা ট্রে দু-হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তার ওপর সাধারণ দুটো কাচের গেলাস। গেলাসে ডাবের জল। ট্রেটা সামনে রেখে সাবধানে গেলাস দুটো আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বিকাশ ডাঁট মারতে শুরু করেছে। গেলাসটা এমন ভাবে নিল, যেন দয়া করছে। কার্পেটের একপাশে রেখে ভারিক্কি গলায় বললে, এই সব ফর্মালিটি ছেড়ে, কাজের কাজ সারুন! আমার অনেক কাজ আছে।
ভদ্রলোক সবিনয়ে বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়! তবে দূর থেকে আসছেন, গরমকাল, এখনও কিছু পিতার আমলের নারকেল গাছ আছে। খেয়ে দেখুন, খুব মিষ্টি জল!
ও জলটল পরে হবে, দেখাদেখিটা সেরে নিন।
ভদ্রলোক বিষণ্ণ, বিব্রত মুখে ভেতরে চলে গেলেন। আমি বিকাশকে বললুম, তোর সঙ্গে আর আমি যাব না কোথাও। এবার তুই ছোটলোকমি শুরু করেছিস।
ছোটলোকমির কী আছে! আমার এই রোগা রোগা চেহারার পড়তি বড়লোকদের বিশ্রী লাগে। বিনয়ের আদিখ্যেতা। স্পষ্ট উচ্চারণে নীচু গলার কথা।
তা হলে এলি কেন, খামোখা একটা মানুষকে অপমান করার জন্যে?
জানব কী করে?
একটা চেয়ার নিয়ে ভদ্রলোককে আসতে দেখে এগিয়ে গেলুম। ভারী চেয়ার। একা সামলাতে পারছেন না।
সরুন আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বইছেন কেন! আর কেউ নেই?
না, আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। আমার চেহারা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন না।
আমি খুব খাটতে পারি।
চেয়ারটাকে জানালার পাশে আমাদের দিকে মুখ করে রাখা হল। কিছু পরেই তিনি পাত্রীকে নিয়ে এলেন। সাজগোজের কোনও ঘটা নেই! ফিকে নীল শাড়ি। হাতাওয়ালা সাদা ব্লাউজ। চুলে একটা এলো খোঁপা। কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিপ।
মেয়েটি নমস্কার করে চেয়ারে বসল। পুরো ব্যাপারটাই অস্বস্তিকর! বোকা বোকা হৃদয়হীন নির্দয় একটা ব্যাপার। দু-জোড়া চোখ প্রায় অসহায় একটি মেয়েকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে! আমি সেভাবে না দেখলেও বিকাশ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখছে। মাপজোক করছে। সুন্দরী বউ চাই। ডানাকাটা পরি চাই। লেখাপড়ায়, চাকরিতে বাল্যবন্ধু সোমেন মেরে বেরিয়ে গেছে। হেরে আছে একটা জায়গায় বিয়েতে। পেয়েছে খুব, কিন্তু বউ নিখুঁত সুন্দরী নয়! বিকাশ বউ দিয়ে মেরে বেরিয়ে যাবে।
মেয়েটি মুখ নীচু করে বসে আছে। ভদ্রলোকের মুখের আদলের সঙ্গে মেয়েটির মুখ মেলে— ধারালো অভিজাত মুখ। চাঁপা ফুলের মতো গাত্রবর্ণ। লম্বা ছিপছিপে বেতসলতার মতো চেহারা। ভারি সুন্দর। বেশ একটা মহিমা আছে। অন্তত আমার চোখে। মেয়েটি খুব নম্র। ভীরু মনে হল। বসে আছে অসহায় অপরাধীর মতো।
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, ছেলেবেলায় দিদি আর জামাইবাবু মারা যাবার পর আমার এই ভাগনি আমার কাছেই মানুষ। তখন আমাদের সাংঘাতিক দুরবস্থা। তবু আমি আমার কর্তব্য করে গেছি। পড়িয়েছি। গান শিখিয়েছি। সভ্যতা, ভদ্রতা, সংসারের যাবতীয় কাজ শিখিয়েছি। একটাই আমি পারিনি। তা হল ভালো করে খাওয়াতে পারিনি। তার জন্যে দায়ী আমাদের অভাব। আমার রোজগার করার অক্ষমতা। তবে এই গ্যারান্টি আমি দিতে পারি, এমন মেয়ে সহজে পাবেন না। দুঃখের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বড় হয়েছে। ওদিকে বড় ঘরের সংস্কারও কাজ করেছে। মেয়েটিকে আপনারা গ্রহণ করুন। আমার শরীর ক্রমশই ভেঙে আসছে।
বিকাশ ফট করে উঠে পড়ল। একেবারে আচমকা।
ভদ্রলোক অপদস্থ হয়ে বললেন, কী হল! আমি কি কোনও অন্যায় করে ফেললুম!
বিকাশ একেবারে গুলি ছোড়ার মতো করে বললে, যে মাল বিজ্ঞাপনের জোরে বিকোতে হয় সে মাল ভালো হয় না।
মেয়েটি শিউরে উঠল।
ভদ্রলোক বললেন, এ কী বলছেন আপনি!
ঠিকই বলছি। আপনার ভাগনির স্ত্রী-রোগ আছে।
আমার পক্ষে সহ্য করা আর সম্ভব হল না। সমস্ত শক্তি এক করে বিকাশের ফোলা ফোলা গালে ঠাস করে এক চড় মারলুম। আর একটা চড় তুলেছিলুম। ভদ্রলোক ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। উত্তেজনায় কাঁপছেন। বিকাশের নিতম্বে কষে একটা লাথি মারার বাসনা হচ্ছিল।
বিকাশমুখে অহংকারী, শরীরে দুর্বল। হন হন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
আমি ফিরে তাকালুম! ভীরু মেয়েটির ঠোঁট ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। বড় বড় পাতাঘেরা চোখে জল টলটলে! সেই মুহূর্তে ভেতরের বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠল। পুজো হচ্ছে গৃহদেবতার। ঘণ্টা বাজছে টিং টিং করে। আমি পিছোতে পিছোতে চৌকিটার ওপরে গিয়ে বসলুম। আমার ভীষণ একটা তৃপ্তি হয়েছে। একটা অসভ্য একটা ইতরকে আমি আঘাত করতে পেরেছি। অসীম সুখে আমার মন ভরে গেছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে যখন শাঁখ আর ঘণ্টা বাজছে পুজোর ঘরে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সাংঘাতিক একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললুম। ভদ্রলোককে বললুম আপনি দিন দেখুন, আমি বিয়ে করব। আমি বড় চাকরি করি না, তবে মানুষ। বিয়ে এখন বড়লোকের ব্যবসা, তবু আমি এই ঝুঁকি নেব। আমর পিতা এলে পাকা কথা বলে যাবেন। হ্যাঁ তার আগে আপনার ভাগনিকে জিগ্যেস করুন আমাকে পছন্দ কি না?
ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রাখলেন; তখনও হাত কাঁপছে।
মেয়েটি অস্ফুট বললে, আপনাকে আমি চিনি।
কী করে!
আমি বইয়ে পড়েছি এমন চরিত্রের কথা।
আমি বাস্তব নই!
কাল বোঝা যাবে।
মেয়েটি পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ; তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
ভদ্রলোক আবেগের গলায় বললেন, তুমি বাস্তব হবে তো!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন