হোটেলটা নতুন। এদিক দিয়ে যাওয়া-আসার পথে বাইরে থেকে কয়েকবার দেখেছে মনোজ, এর আগে ভেতরে কখনও ঢোকেনি। প্রয়োজন হয়নি।
ট্যাক্সি থেকে নামবার পর মনোজ কার্ডটা আর-একবার দেখে নিল। পার্টিটা হচ্ছে পার্ল রুমে। কাচের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকে মনোজ দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। মস্তবড় একটা হল, তার। এদিক-সেদিকে সোফায় বসে নানা ধরনের মানুষ, কিছু সাহেব-মেমও রয়েছে। হোটেলটা নতুন, তাই চতুর্দিক একেবারে ঝকঝকে তকতকে।
পার্ল রুমটা কোন দিকে? কোথাও তা লেখা নেই। রিসেপশান কাউন্টারে জিগ্যেস করতেই সেখানকার মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, আপনি ডানদিক দিয়ে সোজা চলে যান, স্যার, একেবারে সামনেই দেখতে পাবেন।
অফিস সংক্রান্ত ব্যাপারেই মনোজকে মাঝে-মাঝে এরকম পার্টিতে আসতে হয়। ককটেল অ্যান্ড ডিনার। একই ধরনের কথাবার্তা, পেঁতো হাসি, মদ্যপান করতে হয় সাবধানে, রাতে নেশা না হয়। খাওয়ারগুলো পাঁচমিশেলি, খানিকটা পাঞ্জাবি, খানিকটা মোগলাই আর খানিকটা ওয়েস্টার্ন, এরকম খাবার মনোজ খুব উপভোগ করে না।
পুনার একটা ফার্মের সঙ্গে কোলাবরেশানে বেশ বড় ধরনের নতুন একটা প্রজেক্ট পেয়েছে মনোজের অফিস, কথাবার্তা প্রায় পাকা, সেইজন্যই আজ সন্ধের পার্টি। সাড়ে সাতটায় আরম্ভ, মনোজ প্রায় একঘণ্টা দেরি করে ফেলেছে, তার ইচ্ছে আগে কেটে পড়া।
লম্বা করিডোর দিয়ে অনেকখানি হেঁটে আসার পর মনোজ দেখতে পেল, সামনেই লেখা রয়েছে পার্ল রুম। দেরি হয়ে গেছে বলে নিশ্চয়ই তাদের এম. ডি. তালুকদার সাহেব একটু ভুরু কুঁচকোবেন। উনি অনেক ব্যাপারে পাক্কা সাহেব, যে-কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্টে এক মিনিটও সময়ের এদিক-ওদিক করেন না।
মনোজ তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভিড়ের মধ্যে পেছনের দিকে চলে যাওয়া যায়, তাহলে তালুকদার সাহেবকে বোঝানো যেতে পারে যে সে কিছুটা আগেই এসেছে।
ঘরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশজন নারী-পুরুষ। এইসব পার্টিতে এলেই একটা ভোমরার চাকের মতন গুঞ্জন শোনা যায়, এখানে কেউ জোরে কথা বলে না, জোরে হাসে না।
মনোজ অনেকটা পেছন দিকে চলে এসে অন্যদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে সে দেখার চেষ্টা করল তালুকদার সাহেব কোন দিকে।
তালুকদার সাহেবকে কোথাও দেখা গেল না।
তালুকদার প্রায় ছফুট লম্বা। চওড়াও কম নয়, সবসময় স্যুট পরে থাকেন, যে-কোনও ভিড়ের মধ্যে তাকে দেখা যাবেই। তাহলে কি তালুকদার আসেননি? এরকম কক্ষনো হয় না। আজ। দুপুরেও তাঁর সঙ্গে মনোজের কথা হয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে। একটি বেয়ারা এসে তার সামনে ট্রে নিয়ে দাঁড়াতেই মনোজ একটা হুইস্কির গেলাস তুলে নিল।
তাহলে শৈলেশ পান্ডেকে জিগ্যেস করতে হবে তালুকদারের কথা। পান্ডে কোথায়? চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে পান্ডেকেও খুঁজে পেল না মনোজ।
তালুকদার আসেনি, পান্ডে আসেনি, কী ব্যাপার? সুহাস বলেছিল, সে মনোজের সঙ্গেই ফিরবে। সুহাস কোথায়?
হঠাৎ মননজের শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। তাদের অফিস থেকে আটজনের আসার কথা, তার মধ্যে সাতজনই সস্ত্রীক। সেই সাতজোড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনকেও দেখতে পাচ্ছে না মনোজ। কেউ আসেনি! পার্টি শুরু হয়ে গেছে একঘণ্টা, অথচ এর মধ্যে তাদের অফিসের একজনও আসেনি, এ হতেই পারে না।
তাহলে মনোজ নিশ্চয়ই ভুল জায়গায় এসেছে। দেওয়ালের দিকে ফিরে মনোজ গোপনে পকেট থেকে কার্ডটা বার করে দেখল। না, পার্ল রুম স্পষ্ট লেখা আছে। তারিখ ভুল করারও প্রশ্ন ওঠে না। অফিসে আজই কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই পার্টি বিষয়ে। পুনার ফার্মটির কয়েকজনের সঙ্গে তিন-চারদিন ধরে অনেকবার দেখা হয়েছে, ভালোই মুখ চেনা হয়ে গেছে, তাদেরও কেউ নেই। কয়েকজন সরকারি অফিসারের থাকার কথা, তাদেরও দেখা যাচ্ছে না।
তাহলে কি শেষ মুহূর্তে ক্যানসেল্ড হয়ে গেছে কোনও কারণে? অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে উত্তরপাড়ায় অসুস্থবড়মামাকে দেখতে যেতে হয়েছিল মনোজকে। সেখান থেকে সে সোজা এসেছে এর মধ্যে অন্য কিছু ঘটে গেল?
সে যাই হোক, মনোজ যে ভুল পার্টিতে এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না, কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না। তবু মনোজের সারা শরীরময় অস্বস্তি। কেউ কি ভাবছে, সে একটা বাজে লোক, বিনা আমন্ত্রণে এখানে ঢুকে পড়েছে বিনা পয়সায় মদ আর খাবার খাবে বলে? সে কারুর সঙ্গে গল্প করছে না দেখে বেয়ারারাও কি সন্দেহ করছে কিছু?
মনোজ একটা ভালো কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু এখানে কেউ তাকে চেনে না। কেউ যদি তাকে এসে এখন চ্যালেঞ্জ করে, সে কিছু প্রমাণও করতে পারবে না। এক্ষুনি এখান থেকে। বেরিয়ে যাওয়া উচিত। একটা লোক ঢুকল, এক গেলাস মদ খেলো, তারপর কারুর সঙ্গে কিছু কথা না বলে বেরিয়ে গেল, এটাই বা কেমন দেখায়? এখন দরজার সামনেই তিন-চারজন দাঁড়িয়ে আছে, তারা যদি কিছু জিগ্যেস করে?
এক জায়গায় তিন-চারজন মহিলা বসে আছে, তাদের একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মহিলাটি চোখ ফিরিয়ে নিল না। বরং তার দৃষ্টিতে যেন ফুটে উঠল কৌতূহল।
মনোজ আর-একবার তাকাতেই মহিলাটি হাসল। তারপর সোজা এগিয়ে এল মনোজের দিকে। মনোজের কেমন যেন ভয় করতে লাগল। অথচ একজন সুন্দরী মহিলাকে দেখে তার কি ভয় পাওয়ার কথা?
মহিলাটি কাছে এসে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, কী খবর? অনেকদিন দেখিনি, কলকাতায় ছিলে না বুঝি?
মহিলাটিকে একেবারেই চিনতে পারল না মনোজ। কিন্তু কোনও মহিলার মুখের ওপর সে-কথা বলা যায় না। এমনও হতে পারে, অনেকদিন আগে কোথাও আলাপ হয়েছিল।
এইসব ক্ষেত্রে দু-তিন মিনিট তা-না-না-না করে আলাপ চালিয়ে গেলে হঠাৎ কোনও পরিচয়ের সূত্র বেরিয়ে পড়ে। তবু তো একজন কথা বলল মনোজের সঙ্গে।
মহিলাটির বয়েস তিরিশের এপাশে-ওপাশে। সাজ পোশাকের বেশ বাড়াবাড়ি আছে, গলায় লম্বা একটা সোনার হার, আজকাল সাধারণত কেউ এরকম হার পরতে সাহস পায় না। মুখখানা।
সুন্দর, কিন্তু চোখ দুটি বড় বেশি তীক্ষ্ণ।
মনোজ হাত জোড় করে বলল, নমস্কার, ভালো আছেন!
মহিলাটি মনোজের গলানকল করে বলল, হ্যাঁ গো, মশাই, ভালো আছি। প্রায় দু-বছর আমাদের কোনও খোঁজই নাওনি!
মহিলাটি তাকে তুমি-তুমি বলছে। তার মানে অনেকখানি ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক। মনোজের কি এতটা ভুল হতে পারে? এই মহিলাকে সে জীবনে কখনও দেখেছে বলেই মনে পড়ছে না।
মহিলাটি এবার নীচু গলায় জিগ্যেস করল, আমার ওপর এখনও রাগ আছে বুঝি?
এ প্রশ্নের উত্তর মনোজ কিছু বলার সুযোগ পেল না। মহিলাটি মুখ তুলে একটু দুরের একজনকে ডেকে বলল, এই দ্যাখো, এতকাল পরে বিজন কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, আমাদের সঙ্গে কোনও কথাও বলেনি।
রোগা-পাতলা, ভালোমানুষ চেহারার একজন লোক অন্য একজনের সঙ্গে গল্পে মত্ত ছিল, এদিকে তাকিয়ে যেন ভূত দেখার মতন কয়েক মুহূর্ত থমকে রইল। তারপর এগিয়ে এসে মনোজের পিঠে এক চাপড় মেরে বলল, কী রে, বিজন, তুই এতদিন কোথায় ছিলি! এর মধ্যে গোঁফটা কামিয়ে ফেলেছিস দেখছি!
এবারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, ওরা মনোজকে অন্য লোক বলে ভুল করেছে।
মনোজ শুধু ভুল পার্টিতে আসেনি, সে এখন অন্য মানুষ!
এখুনি ওদের ভুল না ভাঙিয়ে দিলেও চলে। দেখাই যাক না।
সেই লোকটি বলল, তুই বছর দু-এক আগে হায়দ্রাবাদ থেকে একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলি, তারপর আর কোনও খবর দিসনি!
মনোজ জীবনে কখনও হায়দ্রাবাদে যায়নি। সে তাকিয়ে রইল হাসি-হাসি মুখে।
মহিলাটি জিগ্যেস করল, তোমার মা এখন কেমন আছেন?
মনোজ বলল, ভালো। এখন ভালো আছেন।
এটা মিথ্যে কথা নয়।
লোকটি বলল, এ কী গেলাস খালি কেন? এই বেয়ারা, এদিকে হুইস্কি দাও।
মহিলাটি বলল, এই, তুমি ওকে বেশি-বেশি মদ খাওয়াবে না! তুমি নিজে যত ইচ্ছে খাবে বলে অন্যদেরও জোর করে খাওয়াবে।
পুরুষটি হেসে বলল, সুনন্দা, তোমার দেখছি, স্বামীর চেয়েও বিজনের ওপর বেশি দরদ। অথচ এতদিন তো তোমার খোঁজও নেয়নি।
মহিলাটির নাম জানা গেল। সুনন্দা। পুরুষটির নাম কী?
মনোজ বলল, আমাকে ঘনঘন দিল্লি যেতে হয়েছে, খুব কাজের চাপ ছিল।
সুনন্দা পাতলা অভিমানী গলায় বলল, আহা, তাহলে বুঝি একটা চিঠিও লেখা যায় না?
লোকটি বলল, সেই যে তোমাদের মধ্যে একদিন খুব কথা কাটাকাটি হল, মান-অভিমান, তারপর থেকেই তো বিজন হাওয়া।
সুনন্দা বলল, সেটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। তার মধ্যে তুমি নাক গলাতে এসো না।
লোকটি বলল, আমি নাক গলাতে চাইও না।
নিজের হুইস্কির গেলাসটা এক নিশ্বাসে শেষ করে সে হঠাৎ আরও কাছে এসে ফিসফিস করে বলল এই পার্টিটা একেবারে ডাল! সবাই গম্ভীর হয়ে আছে। চলো, এখান থেকে কেটে পড়ি।
অরুণের কাছে যাই।
মনোজ বলল, অরুণ?
লোকটি বলল, অরুণের বাড়িতে একটা ঘরোয়া পার্টি আছে। অনেক করে যেতে বলেছিল। তোকে দেখলে খুব খুশি হবে!
সুনন্দা বলল, তাই ভালো। চলো, চলো যাই। কিন্তু অরুণের ওখানেই বা যাওয়ার দরকার কী? আমাদের বাড়িতেই তো বসতে পারি। আমার তো ড্রিঙ্কস রয়েছে।
লোকটি বলল, একবার অরুণের বাড়িটা ছুঁয়ে যেতে হবে।
সুনন্দা মনোজের বাহু ছুঁয়ে বলল, চলো, বিজন, চলো। তোমার জন্য আমার অনেক কথা জমে আছে।
মনোজ ভাবল, এই লোকটি সুনন্দার স্বামী। দুজনকে ঠিক যেন মানায় না। বিজন নামে এদের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। তার সঙ্গে সুনন্দার খুব ভাব, মান-অভিমানের সম্পর্ক। কিন্তু সেটা সে স্বামীকে গোপন করে না, তার স্বামী সব জানে, মেনে নিয়েছে। একদিন কোনও কারণে বিজন এই সুনন্দার ওপর রাগ করে চলে গিয়েছিল।
এর আড়ালে যেন একটা গল্প আছে। সেই গল্পটা পুরো জানবার জন্য মনোজের দারুণ কৌতূহল হল। কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন করে রাখা কি অন্যায়? ওদের ভুল ভাঙিয়ে দেওয়া উচিত। অবশ্য মনোজ তো নিজে থেকে বিজন সাজেনি। ওদের ভুলটা আর-একটু পরে ভাঙলেই বা ক্ষতি কী?
সে বলল, ঠিক আছে, চলো!
দরজার সামনে একজন লোক সুনন্দার স্বামীকে জিগ্যেস করল, এ কী, প্রীতমদা, এর মধ্যেই চললেন নাকি? খাবেন না?
প্রীতম বলল, না ভাই, আর-একটা জায়গায় যেতেই হবে।
সুনন্দা মননজের হাত ধরে ততক্ষণে বাইরে নিয়ে এসেছে।
এবারে মনোজ দেখল, পাশেই আর-একটা হল রয়েছে, সেখানেও পার্টি চলছে একটা, তারও বাইরে লেখা পার্ল রুম। পার্ল রুম দুটো আছে, ওয়ান আর টু। মনোজ অত লক্ষ্য করেনি, সে দুনম্বর পার্ল রুমের পার্টিতে যোগ দিয়েছিল।
তার মানে এক নম্বর পার্ল রুমে তার অফিসের পার্টি চলছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে এখন আর কী হবে। এখন মনোজ অন্য একটা গল্পে ঢুকে পড়েছে। সে দ্রুত সরে এল সেখান থেকে।
বাইরে এসে প্রীতম গাড়ির নাম্বার বলে দিল। তারপর মনোজকে জিগ্যেস করল, তুই কি এখনও দিল্লিতে থাকছিস?
মনোজ বলল, না, কলকাতায়।
সুনন্দা জিগ্যেস করল, তুমি কি ফ্ল্যাট নিয়েছ, বিজন? কোন পাড়ায়?
মনোজ বলল, যোধপুর পার্ক!
সুনন্দা বলল, তাহলে তো আমাদের বাড়ির কাছেই।
প্রীতম বলল, শালা, তুই চুপিচুপি কলকাতায় ফ্ল্যাট নিয়ে সেটল করেছিস, তবু আমাদের কোনও খবর দিসনি? সুনন্দা বুঝি তোকে খুবই কঠিন কিছু বলেছিল?
সুনন্দা বলল, আমি মোটেই সেরকম কিছু বলিনি সেদিন। বিজন আসলে ভুল বুঝেছিল। তুমি আর আমাদের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না তো।
মনোজ সুনন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এ কীরকম সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর। বিজন কি প্রীতমের স্ত্রীর প্রেমিক? প্রীতম সেটা মেনে নিয়েছে?
গাড়িটা এসে পোর্টিকোতে দাঁড়াল।
গাড়িতে উঠতে একটু দ্বিধা করল মনোজ। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না তো? সে আর কতক্ষণ বিজন সেজে থাকবে? বিজন সত্যিই রাগ করে কিংবা অভিমানে দূরে সরে আছে, সে হয়তো
কোনওদিনই এদের মাঝখানে আর আসতে চায় না।
ওঠ-ওঠ বলে প্রায় ঠেলেই মনোজকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল প্রীতম। সুনন্দাকে মাঝখানে বসিয়ে সে বসল অন্য পাশে।
তারপর প্রীতম বলল, তাহলে অরুণের ওখানে আগে একটু ঘুরে আসব তো?
সুনন্দা বলল, তা আজ থাক। বাড়িতেই চলো। বাড়িতেই আড্ডা দেব। রাত বেশি হয়নি!
প্রীতম বলল, ঠিক আছে। আজ বিজনের অনারে ভালো স্কচের বোতলটা খোলা হবে। কোনও দোকান থেকে কাবাব কিনে নিয়ে গেলে হয় না?
সুনন্দা বলল, দোকানের খাবার দরকার নেই। বাড়িতে মাছ আছে, ভেজে দিতে বলব। বিজন মাছ ভাজা ভালোবাসে।
প্রীতম বলল, তোর কী হয়েছে রে, বিজন? এত চুপচাপ কেন?
মনোজ শুকনোভাবে হেসে বলল, না শুনছি!
খানিকদূর যাওয়ার পর প্রীতম বলল, সুনন্দা, অরুণের বাড়িটা একবার অন্তত না গেলে খারাপ দেখাবে। অনেক করে বলেছিল। চলোনা মাত্র আধঘণ্টা থাকব!
সুনন্দা বলল, আজ ইচ্ছে করছে না। তা ছাড়া অরুণটা বিজনকে ভালো করে চেনে না।
প্রীতম বলল, তাহলে এক কাজ করা যাক। তুমি আর বিজন বাড়িতে নেমে যাও! আমি একবার অরুণের ওখানটা ঘুরে আসি।
সুনন্দা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমাকে অরুণের বাড়িতে যেতেই হবে? কেন?
প্রীতম বলল, কথা দিয়েছিলাম, একবার ঘুরে আসি!
সুনন্দা বলল, আট-দশজনের পার্টি। একজন না গেলে কিছু হয় না। অরুণও কয়েকবার কথা দিয়ে তারপর আসেনি!
প্রীতম বলল, তুমি যেতে না চাও যেও না, কিন্তু আমি গেলে তোমার আপত্তি কীসের?
সুনন্দা বলল, তুমি একবার ওখানে জমে গেলে কতক্ষণে ফিরবে তার কোনও ঠিক নেই। আমরা শুধু-শুধু বসে থাকব?
প্রীতম এবার ভুরু তুলে কৌতুকের সুরে বলল, শুধু-শুধু বসে থাকবে কেন? গল্প করবে। তুমিই তো বললে, বিজনের জন্য তোমার অনেক গল্প জমে আছে। আমি সেখানে থেকে কী করব?
সুনন্দা হঠাৎ তীব্রভাবে বলল, তার মানে?
প্রীতম হাসতে-হাসতেই বলল, তার মানে, তোমাদের মান-অভিমান ভাঙাবার ব্যাপার চলবে। তার মধ্যে থেকে আমি কী করব?
সুনন্দা বলল, তুমি কী ভাবছ বলত?
প্রীতম বলল, আমি কিছুই ভাবছি না। তোমরা গল্প করোনা নিরিবিলিতে!
সুনন্দা বলল, বিজনের সঙ্গে তুমি বুঝি গল্প করতে চাও না?
প্রীতম বলল, আমি ফিরে আসি। তখন গল্প হবে। বিজনকে আজ রাতটা রেখে দাও আমাদের ওখানে!
সুনন্দা বলল, তোমার আজ অরুণের বাড়িতে যাওয়া চলবে না।
প্রীতম বলল, তুমি এত আপত্তি করছ কেন? আমি তোমাদের দুজনকে খানিকটা সুযোগ দিচ্ছি—
সুনন্দা চিৎকার করে বলল, সুযোগ দিচ্ছ? ছিছি-ছিছি, তুমি এমন একটা কথা বলতে পারলে আমাকে?
প্রীতম বলল, অত উত্তেজিত হোয়ো না।
সুনন্দা বলল, গাড়ি থামাও! আমি এক্ষুনি নেমে যাব!
প্রীতম বলল, এই, এই, কী হচ্ছে কী? বিজন, তুই একটু বুঝিয়ে বলত?
মনোজ গম্ভীরভাবে বলল, আমি বিজন নই!
সুনন্দা গাড়ির দরজা খুলতে যাচ্ছিল, চমকে ফিরে তাকাল।
মনোজ বলল, আমি বিজন নই, কোনও কালে আমার গোঁফ ছিল না। আমার নাম মনোজ বর্মন, আমি স্মিথ মার্টিন কোম্পানিতে কাজ করি। আপনারা আমাকে বিজন বলে ভুল করেছিলেন, তাই আমি একটু মজা করছিলাম!
প্রীতম মনোজের চিবুকটা ধরে ঘুরিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, প্রায় হুবহু মিল, শুধু ডানদিকের জুলপির পাশে কাটা দাগটা নেই।
সুনন্দা ফ্যাকাসে গলায় বলল, তুমি…আপনি সত্যি বিজন নন!
মনোজ বলল, মাপ করবেন! প্রথমেই হয়তো আমার বলা উচিত ছিল।
প্রীতম বলল, সত্যিই তো! যাক গে, তাতে কী হয়েছে, আপনি বিজন না হোন মনোজই হলেন। চলুন, আপনার সঙ্গেই আলাপ করা যাক। আমাদের বাড়িতে চলুন। আমি তাহলে অরুণের ওখানে যাব না!
মনোজ বলল, আজ থাক। আজ আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমাকে ওই সামনের মোড়ে নামিয়ে দিন। ওখানে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।
সুনন্দা একেবারে চুপ করে গেছে। প্রীতম আরও কয়েকবার অনুরোধ করলেও মনোজ প্রায় জোর করেই নেমে গেল গাড়ি থেকে।
রাস্তায় নেমে একটা সিগারেট ধরাল মনোজ। তার মনে হল, ভুল করে অন্য পার্টিতে ঢুকে পড়া যায়, কিন্তু জোর করে অন্যের জীবনের গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়া বিপজ্জনক। সেই জন্যই বোধহয় তার বুক কাঁপছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন