না বলতে না পারা ফারহানার একদিন!

৭০৬৪ পঠিত ... ২৩:১৩, নভেম্বর ১৬, ২০১৮

পোর্ট্রেট: প্রসুন হালদার

নেয়ামত উল্লাহ সাহেব বললেন, ‘কী বলবো বাবা, আমার মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র ভালো না।’

শুনে চমকে উঠলাম। কোনো বাবাকে তাঁর মেয়ে সম্পর্কে এরকম কথা বলতে আগে কখনো শুনি নি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো না মানে? কী করেছে?’

নেয়ামত উল্লাহ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশ্রুসজল হয়ে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল কম বয়সে মা হারানো মেয়েটাকে অতি আদরে মাথায় তুলেছেন তিনি। এখন নামাতে পারছেন না। মাত্র এইচএসসি ক্লাসের ছাত্রী, এর মধ্যে তিন তিনটি দুর্ঘটনা! ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রেমে পড়েছিল পাড়ার এক রোমিওর। এসএসসি পরীক্ষার পর ছুটিতে নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে প্রেমে পড়লো ফোন-ফ্যাক্সের এক দোকানদারের। এ দুটো ঘটনা তবু অল্পের ওপর গেছে। তৃতীয়টা আরও জটিল। নিরাপত্তার নানা দিক বিবেচনা করে মেয়েকে মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন নেয়ামতউল্লাহ। কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। ফার্স্ট ইয়ারে মেয়ে ঝুলে গেল আম্বিয়া খাতুন মহিলা কলেজের এক প্রভাষকের সঙ্গে। বাড়িতে চিঠি লিখে পালিয়েও গিয়েছিল। কিন্তু তরিত ব্যবস্থা নেওয়ায় কমলাপুর স্টেশনে দুজনে বমাল আটক হওয়ার ফলে একটি প্রেমের সমাধি রচিত হয়েছিল সেখানে।

নেয়ামত উল্লাহ্র কাছে তাঁর কন্যারত্নের কীর্তিময় অতীত জানার পর যে প্রশ্নটি প্রথমেই আমার মনে উদিত হল তা হচ্ছে, ‘আমি কি করতে পারি?’

‘পারো বাবা, তুমিই পারবে, ’... প্রায় অতল জলের ঘূর্ণিস্রোতে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যেন আমার হাতটা ধরে কূলে উঠতে চাইলেন নেয়ামত সাহব, ‘তুমি আমার মা-মরা মেয়েটাকে মানুষ করার দায়িত্ব নাও।’

আমিতো মানুষ গড়ার কারিগর নই, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র। পাশ করে সুন্দর বহুতল ভবন, বাড়িঘর তৈরি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু কোনো কথা শুনতেই রাজি নন নেয়ামত উল্লাহ, বললেন, ‘তোমার বাবা আমার বন্ধু, যখন সেই ছোট্ট ছিলে তখন থেকে তোমাকে দেখছি, যেমন মেধাবী তেমন ভালো চরিত্রের একটা ছেলে... কোনোদিন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাওনি...।’

কথাটা সত্যি। আমি ছাত্র ভালো। কিন্তু মেয়েদের দিকে না তাকানোর মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তার কিছু নেই। আমি একটু নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ... মেয়েদের দিকে তাকাতে ভয়ই পাই, এ নিয়ে আমার সহপাঠিনীরা কম ঠাট্টা করে না। এসব কথা নেয়ামত উল্লাহকে বলা যায় না। তিনি আমার হাত দুটো ধরেই আছেন, ‘সামনে মেয়েটার এইচএসসি পরীক্ষা, মেয়েটা গাধা, ওকে পড়ানোর দায়িত্বটা তুমি নাও, অন্য কোনো টিউটরকে ভরসা করতে পারছি না।’

আমার মা বললেন, ‘রাজি হয়ে যা বাবা, নেয়ামত ভাই আমাদের আপন মানুষ, এতো করে বলছেন।’

অগত্যা আমি রাজি হলাম। প্রথম দিন ফারহানা আমাকে মিষ্টি গলায় ‘মামুন ভাই’ বলে সম্বোধন করলো। প্রথম রাতেই বিড়াল মারার আয়োজন করলাম, গম্ভীর গলায় বললাম, ‘আমি তোমার শিক্ষক, মামুন ভাই না, আমাকে স্যার বলে ডাকবে।’

ফারহানা বললো ‘আচ্ছা স্যার।’

দু একদিন পড়ানোর পর বুঝলাম মোটেই গাধা না। লেখাপড়ায় ভালো। কিছুদিন যাওয়া আসার পর যখন সম্পর্কটা অনেক সহজ হয়ে এসেছে, একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু মনে কোর না, শুনলাম তোমার নাকি অনেক ঘটনা... মানে এই প্রেম ট্রেম...।’

ফারহানা হেসে ফেললো, ‘ঠিক শুনেছেন স্যার। আসলে দোষ আমার না, আমি দেখতে সুন্দর তো, সবাই আমার প্রেমে পড়ে যায়...।’

আমি তো মেয়েদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না, তবু কৌশলে লক্ষ্য করে দেখলাম, কথাটা ঠিক। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। ফর্সা ডিম্বাকৃতির মুখ, গাঢ় কালো চোখ। হাসলে একপাশে একটি গজদন্ত বেরিয়ে পড়ে, তাতে হাসিটা সুন্দর হয়ে ওঠে আরো।

পোর্ট্রেট: প্রসুন হালদার

ভ্রু কুঁচকে বললাম, সবাই তোমার প্রেমে পড়লে তোমারও পড়তে হবে?’

‘সবার প্রেমে তো পড়িনি, তিনজনের... কেউ যদি বলে তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না তখন খারাপ লাগে না? কী করবো...।’

‘শোনো, এসব বাজে কথা, ছেলেরা এরকম বলে, কেউ মরে না। তোমার প্রেমিকেরা কেউ মরেছে?’

‘না স্যার কেউ মরে নি, একজন তো বিয়েই করে ফেলেছে’— বলে ফিক্ করে গজদন্ত দেখিয়ে হেসে ফেললো ফারহানা।

‘এরপর কেউ যদি প্রপোজ করে, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না বলে, তুমি এক মিনিট চোখ বন্ধ করে আগের ঘটনাগুলোর কথা মনে করবে, তারপর চোখ খুলে শান্ত গলায় বলবে, দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না। ঠিক আছে? বলতে পারবে?’

‘পারব স্যার।’

এরমধ্যে পরীক্ষা এসে গেল ফারহানার। আমি প্রচন্ড পরিশ্রম করলাম ছাত্রীর জন্য। সবকটি পরীক্ষাই ভালো হয়েছে। শেষ পরীক্ষার পরের দিন আমার উপদেশগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে বিদায় নিলাম।

এদিকে আমারও ফাইনাল পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এসেছে। নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া দরকার। কিন্তু ইদানিং সন্ধ্যার সময় আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। উদ্দেশ্যহীন কিছুক্ষণ পথে পথে হেঁটে ঘরে ফিরে আসি। পড়তে বসে বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা লাগে, চোখ বন্ধ করলে একটি হাসি মাখা মুখ ভেসে ওঠে মনে, একটি গজদন্ত বেরিয়ে পড়া অপূর্ব সেই হাসি। কী হলো আমার!

এই অবস্থার মধ্যে একদিন মিষ্টি নিয়ে নেয়ামতউল্লাহ সাহেব হাজির। মেয়ে গোল্ডেন পেয়েছে। আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘ভালো ফল করেছে সেটা বড় কথা না, তুমি আমার মেয়ের স্বভাবটাই পাল্টে দিয়েছো, জানতাম তুমি পারবে...’ ইত্যাদি।

আমার একটু অভিমান হলো, রেজাল্টের খবরটা নিজে একবার ফোনে জানাতে পারতো ফারহানা। রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি। সকালে নিজেই ফোন করলাম। ফারহানা বললো, ‘কেমন আছেন স্যার?’

বললাম, ‘আছি, ভালো আছি। তুমি একবার দেখা করতে পারবে?’

‘বাসায় আসবেন?’

‘না বাসায় না, তোমার কলেজের সামনে...।’

ফারহানা এলো। আমাকে দেখে প্রায় চমকে উঠে বললো, ‘এই কদিনে এতো রোগা হয়ে গেছেন স্যার!’

আমার আবেগের বাঁধ ভেঙে গেল। আম্বিয়া খাতুন মহিলা কলেজের গেটের পাশে যে শিমুল গাছটা, তার আড়ালে আমি ফারহানার হাত ধরে ফেললাম, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না ফারহানা...।’

ফারহানা চোখ বুঁজলো, কী যেন ভাবলো মনে মনে, তারপর চোখ খুলে শান্ত গলায় বললো, ‘দুঃখিত স্যার, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।’

৭০৬৪ পঠিত ... ২৩:১৩, নভেম্বর ১৬, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top