সাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি, ক্রিকেটবিশ্বে শহীদ আফ্রিদি নামেই পরিচিত। আর ভক্তরা আদর করে তাকে ডাকেন 'বুম বুম' বলে। প্রায় দুই দশক ক্রিকেট খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। ১৯৯৬ সালে অভিষেকের সময় তিনি ছিলেন একজন পিঞ্চ হিটার ব্যাটসম্যান। একটা সময় ওপেনার হিসেবে খেললেন কিছুদিন। এরপর আবার ব্যাটিং অর্ডারে নেমে গেলেন। তখন বল হাতে গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকেন এই 'মারকুটে ব্যাটসম্যান'। মাঝে ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়কও। অভিষেকের কিছুদিনের ভিতরেই ৩৭ বলে সেঞ্চুরী করে বিশ্বরেকর্ড গড়ে আলোচনায় চলে আসেন আফ্রিদি। এরপর আর কখনো আলোচনা (কিংবা সমালোচনা) থেকে বেশিদিনের জন্য বিরতিতে যেতে হয়নি। কখনো প্রতিপক্ষের সাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে, কখনো বলকে আপেল ভেবে কামড়ে দিতে গিয়ে নানান কারণে তিনি এসেছেন আলোচনায়।
দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের সমার্থক হয়ে গেলেও মারকুটে স্বভাবের কারণে তার এক প্রকাণ্ড ভক্তকুলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় উপমহাদেশে। পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলাদেশেও তার তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল একটা সময় পর্যন্ত। যদিও পরিসংখ্যানই একজন ক্রিকেটারের সব না, তারপরেও পরিসংখ্যানে আফ্রিদির অবস্থা যেন তথৈবচ। টেস্টে কখনোই সুবিধা না করতে পারা আফ্রিদি ৩৯৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে করেছেন মাত্র ৮ হাজার রান। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরি ৬টি! আর গড়? মাত্র ২৩! তো ভক্তদের মাঝে এই প্রচণ্ড জনপ্রিয় ক্রিকেটারের এক অন্যরকম গল্প বেশ কয়েক বছর আগে থেকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে ইন্টারনেটে। সম্ভবত একজন পাকিস্তানির লেখা সেই ইংরেজি লেখাটির বাংলা অনুবাদ আজ থাকছে eআরকির পাঠকদের জন্য।
আফ্রিদিকে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু সবসময়ই তাকে ভুল বোঝা হয়েছে। শুরুর দিকে আমরা ভেবেছিলাম তিনি সব ধরনের ক্রিকেটের জন্য পারফেক্ট একজন ‘কমপ্লিট’ ক্রিকেটার। তিনি যে শুধুই ওডিআই-এর জন্য উপযুক্ত, সেটা বুঝতে আমাদের লেগে গেল ১০ বছর । বছর পাঁচেক পর আমরা বুঝতে পারি ওডিআই নয়, তিনি শুধুমাত্র টিটুয়েন্টি ক্রিকেটেরই একজন দক্ষ কারিগর। এখন আমরা জানি, উঠতি ক্রিকেটারদের সামনে ‘ক্রিকেট যেভাবে খেলা উচিত না’ সেটার এক জ্বলন্ত উদাহারণ হলেন আফ্রিদি।
১৯৯৬ সালে আমরা ভেবেছিলাম, আফ্রিদি একজন ব্যাটসম্যান যিনি কিনা কিঞ্চিৎ বল করতে পারেন। ২০০৬ সালে এসে আমরা বুঝতে পারি, তিনি সত্যিতে একজন বোলার যিনি কিঞ্চিৎ ব্যাটিং করে থাকেন। আর ২০১৩ সালে এসে আমরা জানতে পারলাম যে, তিনি একজন ‘কিঞ্চিৎ’, যার কিনা ব্যাট অথবা বল কোনটাই হয় না।
আফ্রিদি প্রচণ্ড প্রতিভাবান। তার মাপের ব্যাটসম্যানদের মাঝে একদিনের ক্রিকেটে তার স্ট্রাইক রেটই সর্বোচ্চ। আফ্রিদির মাপের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা হলেন মুরলিধরন, দানিশ ক্যানেরিয়া, দিলীপ যোশী এবং আবদুল কাদির।
আফ্রিদি এতটাই শক্তসামর্থ্য যে তিনি ক্রিকেট বল চেরির মতো খেয়ে ফেলেন। অনেকে বলে থাকেন, আম্পায়ার যখন তার দিকে বল ছুঁড়ে দিয়ে ‘ক্যাচ দ্য চেরি’ বলেছিলেন, তখন আফ্রিদি কথাটাকে আক্ষরিক অর্থেই নিয়ে নেন। জোয়েল গার্নার, প্যাট্রিক প্যাটারসন কিংবা মার্ভ হিউজের মতো দানবীয় ক্রিকেটাররাও কখনো দর্শকদের সামনে এমন করার সাহস পাননি। সে যাই হোক, তিনি যে একজন ‘কুইক লার্নার’ তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ১৫ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর সেই দিনটিতে তিনি বুঝতে পারলেন, দর্শকের সামনে দাঁত দিয়ে বলের আকার বদলে ফেলার প্রচেষ্টা খুব একটা স্বাভাবিক না। তিনি আর কোনদিন এই ভুল করেননি।
৩৫০ ওডিআই খেলা ক্রিকেটারদের মাঝে সবচেয়ে কম বল খেলার রেকর্ড তার। সত্যি কথা বলতে তিনি যতগুলো ওডিআই খেলেছেন ব্যাট দিয়ে তার চাইতেও কম বল ‘খেলেছেন’।
ক্রিকেট মাঠের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্তের জন্ম হয়, আফ্রিদি ব্যাটিং করতে মাঠে ঢোকার সময় যখন মাঠের প্রতি কোণা থেকে ভক্তদের ‘বুম বুম’ ধ্বনি গর্জে ওঠে। অধিকাংশ সময়ই প্রথম বলের পরেই ক্যামেরায় দেখা যায় চোখ বড় বড় করে, হা করা মুখ দিয়ে জিভ বের করে রেখে এই দর্শকরাই মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর শহীদ আফ্রিদি এই পিনপতন নীরবতার মাঝ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরছেন কিছুক্ষণ আগেই রেখে আসা গরম চা খেতে। উপরের কাজটির পুনরাবৃত্তি দর্শকরা করেছেন শতশত বার। আফ্রিদি কিংবা দর্শক কেউই নিজেদের পারস্পরিক এই ভূমিকা পালনে কখনো ব্যর্থ হননি।
খুব অল্প সময়ের জন্য (যা প্রায় ১৫ বছর লম্বা) আফ্রিদি নিজের ব্যাটিং ফর্ম খুঁজে পেতে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু আমরা কখনোই তার উপর থেকে আশা হারাইনি। আমরা সাধারণত ধৈর্য্য হারাবার আগে নতুন সরকারকে ১০০ দিন আর গণতন্ত্রকে কয়েক বছর সময় দিই। কিন্তু আফ্রিদির প্রতি আমাদের ভালোবাসা অসীম। এখনো আমাদের অধিকাংশের বিশ্বাস, আফ্রিদি এখনো শিখছেন এবং একদিন তিনি সব সমালোচকের মুখ বন্ধ করে দিবেন।
একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি প্রতিপক্ষ অধিনায়কের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। যখন কোন দল তাকে তিন বলের মধ্যে আউট না করতে পারে, তাহলে সেই দলের অধিনায়ককে বোর্ড বরাবর, ‘কেন আফ্রিদিকে আউট করতে দেরি হল?’ তার লিখিত কারণ দর্শাতে হয়। আর যদি কয়েক ওভারের মাঝে আউট না করা যায়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতে দলের বিরুদ্ধে বেঞ্চ গঠন করা হয়।
ক্রিকেট বিশ্বে আফ্রিদিকে তিন বলে আউঁট করার বিষয়টি একজন বোলার কিংবা ক্যাপ্টেনের জন্য দলে জায়গা পাওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি ‘লালা টেস্ট’ নামে পরিচিত। গুজব আছে, অন্তত টানা তিনদিন ক্রিকেট খেলেছেন এমন প্রায় যে কেউই এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারবেন।
আফ্রিদি হলেন এক প্রহেলিকার মতো। কেউ বলে, তিনি একজন স্পিন বোলার যিনি কিনা খুব জোরে বল করেন। অন্যরা বলে, তিনি আসলে একজন ফাস্ট বোলার যিনি কিনা খুব আস্তে বল করেন।
কিন্তু আমরা তাকে ভালোবাসি! কারণ আমাদের জাতির মতোই তিনি আবেগপ্রবণ, অবুঝ এবং ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের জাতির মতোই তিনি বছরের পর বছর ধরে বাতাসেই ব্যাট ঘুরিয়ে যাচ্ছেন এই আশায় যে, এইবার নিশ্চয়ই বলটা কেউ ধরে ফেলবে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন