ভূমিকা
একাত্তরে আমি ক্লাশ সিক্সের ছাত্র। আমাদের পরিবারটা তখন নানা ভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এই সময় আমি ডায়েরী লিখতাম একটা। সাদা খাতায়। যা যা দেখতাম বা শুনতাম লিখে ফেলতাম। স্বাধীনতার পরও খাতাটা ছিল। তারপর আর একসময় পেলাম না। এখন আফসোস হয় খাতাটা থাকলে অনেক ঘটনা জানা যেত। কিছু কিছু ঘটনা আমার এখনো মনে আছে। ভাবলাম, আচ্ছা লিখে রাখলে কেমন হয়? এক সময়তো এগুলিও হারিয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্ম বরং জানুক আমরা কী সময় পার হয়ে এসেছি। সেই সময়কার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে এই একাত্তরের রোজনামচা… কিছু কিছু ঘটনা আবার ইদানিংকালে শোনা। এগুলোর বেশীর ভাগই অনিক খানের তবুও’তে ছাপা হয়েছিল।
*
গভীর রাতে এক হিন্দু প্রধান গ্রামে হামলা করল পাক আর্মী। গুলি আর আগুন দিয়ে তছনছ করে দিল গ্রামটাকে। সবাই পালাচ্ছে। পাশেই বিশাল নদী। যদি নৌকা দিয়ে কোন মতে পার হওয়া যায় নদীটা তবেই জানে বাঁচা যেতে পারে। রাতের অন্ধকারে সবাই ছুটছে নদীর দিকে। রমাকান্ত তার স্ত্রী আর ছোট দুই পুত্র-কন্যা নিয়ে ছুটছেন। মেয়েটি কোলে ছেলেটার হাত ধরে রেখেছেন মা। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়লেন মা।
: কী হল? রমাকান্ত হতভম্ব।
‘আমার গুলি লেগেছে’ কোনোমতে বললেন স্ত্রী সুধা। বুকের কাপড় থিক থিক করছে রক্তে।
‘তুমি ওদের নিয়ে পালাও’ কোনমতে বললেন স্ত্রী।
রমাকান্ত দেরী করলেন না, ছেলে-মেয়ের হাত ধরে ছুটছেন। নদীর ঘাটে নৌকা বেশী ছিল না। সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠছে। একটায় কোনমতে উঠলেন রমাকান্ত। শক্ত করে ধরে রেখেছেন ছেলে আর মেয়েকে। নদীটা পার হতে পারলে হয়। নৌকা চলতে শুরু করল। মাঝ নদীতে হঠাৎ মর্টারের শেল আঘাত হানল নৌকায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল নৌকাটা। রমাকান্ত ছেলে আর মেয়ে নিয়ে ডুবে গেলেন উত্তাল নদীতে। দু’হাতে দু’জনকে ধরে রেখে কোনমতে ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি পারছেন না। যে কোন একজনকে ছেড়ে দিলে হয়ত বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু কাকে ছাড়বেন? ছেলেকে না মেয়েকে? দ্রুত চিন্তা চলছে তার মাথায়। তিনি অন্ধকার রাতে নদী আর চোখের পানি এক করে মেয়েটাকেই ছেড়ে দিলেন। তিনি কী ভেবে ছেড়েছিলেন মেয়েটিকে? হয়ত ভেবেছেন মেয়েতো একসময় পরের ঘরে চলেই যাবে বরং ছেলেটাই থাক শেষ বয়সে বাবাকে দেখবে… এমনটা? মেয়েটি ভেসে গেল। তিনি এক হাতে ছেলেটিকে ধরে উত্তাল নদী সাঁতরে কোন মতে অন্য পাড়ে উঠে এলেন। আর আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলেন তিনি ডান হাতে ধরে আছেন তার মেয়েটিকে। তিনি রাতের অন্ধকারে ছেলেটিকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, বুঝতে পারেননি!
*
তরুণ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। বাবার মন সায় দেয় না। তার চুপচাপ ঘরোয়া ছেলেটি কি পারবে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করতে? কিন্তু বাবা জানেন না। ছেলে গোপনে ঢাকায় গেরিলাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একের পর এক অপারেশন করে চলেছে। ছেলে যে গভীর রাতে ফিরে স্টেনগান লুকিয়ে রাখে তার ঘরে সেটাও তিনি জানেন না। বাবা কেন তাদের বাসার কেউই জানেন না তাদের বড় ছেলে গোপনে এক ভয়ঙ্কর মুক্তিযোদ্ধা। চলছিলো ভালোই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলের দুই বন্ধু এলো তার খোঁজে। মা চেনেন তাদের। খুশিও হলেন তাদের দেখে- কতদিন পর এলো তারা। তাদের দুপুরে খেতেও দিলেন। খেয়ে দেয়ে তারা ফিরেও গেলো হাসিমুখে। বলে গেলো, ‘খালাম্মা পারভেজকে বলার দরকার নেই আমরা এসেছিলাম, আমরা আবার আসব।‘ সহজ সরল মা বুঝতেই পারলেন না তারা আলবদর।
সে রাতেই আবার তারা এলো। এবার তাদের হাতে অস্ত্র, ভাবভঙ্গিও অন্যরকম। বাইরে অপেক্ষা করছে সাদা মাইক্রোবাস। কোন কথা নেই, পারভেজকে জোর করে ধরে তুলল সাদা মাইক্রোবাসে… ছোট ভাই ফিরোজ ছুটে গেলো, ভাইয়াকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ওরা হ্যাঁচকা টানে ছোটভাই ফিরোজকেও তুলে নিলো। দিনটা ছিলো ১৪ই ডিসেম্বর। তার দুদিন পরে ১৬ই ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলায় ফিরে এলো না শুধু তারা দুই ভাই…।
*
পাকিস্তানী বাহিনী বাবাকে হত্যা করতে নিয়ে গেলো। বাবার চোখ বাঁধা। বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মুক্তিযযাদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন। রাজাকাররাই তাকে ধরে এনেছে। বাবাকে দাঁড় করানো হলো গুলি করার জন্য। হঠাৎ কোত্থেকে খবর পেয়ে ছুটে এলো তার কিশোর পুত্র। দুহাতে জড়িয়ে ধরল বাবাকে, চিৎকার করে বলল, ‘আমার বাবাকে মেরো না, আমার বাবাকে মেরো না।‘ মিলিটারীর নির্দেশে কিশোর ছেলেটিকে টেনে হিঁচড়ে সরানো হলো। ছেলেটি আবার ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো, ‘আমার বাবাকে মেরো না, আমার বাবাকে মেরো না।‘ এবারও তাকে টেনে-হিঁচড়ে সরানো হলো। আবারও একই ঘটনা ঘটলো। এবার মিলিটারীরা নির্দেশ দিলো গুলি করার। গর্জে উঠলো কয়েকটা রাইফেল। ছিটকে পড়লো বাবা আর ছেলে এক সঙ্গে। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো কিশোর ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো… আর ভয়ঙ্কর মৃত্যু তাদের গ্রাস করলো একসঙ্গে।
*
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নানা রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের কানে আসতো। তার একটা ছিলো এরকম,পাকবাহিনীরা বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের নাকি বাঘের খাঁচায় ছুঁড়ে দিয়েও হত্যা করতো। স্বাধীনতার পরেও সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের কানে এসেছে। সেইরকম একটি ঘটনা যেখানে একজন দুর্ধর্ষ। মুক্তিযোদ্ধা বাঘের খাঁচা থেকে জীবিত অবস্থায় বের হয়ে এসেছিলেন।
তার নাম শফিকুল আলম চৌধুরী। পঞ্চগড়ের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। একবার এক পাকসেনা ভুল করে তার এলাকার বাজারে চলে এলে তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় একাই পাক আর্মির অস্ত্র ছিনিয়ে নেন। সেই শুরু, তারপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বহু সফল অপারেশন করেছেন। ঐ অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় পাক বাহিনীর একটা ক্ষোভ ছিলো তার ওপর। এবং স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় একদিন তাকে ধরেও ফেললো সে। তারপর শুরু হলো ভয়ানক নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন একটা খাঁচার ভেতর। খাঁচাটা বাঘের, চারটা বাঘ সেই খাঁচায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাঘ তাকে ছুঁয়েও দেখলো না। উল্টো একটা বাঘ তার গায়ে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লো। এই ঘটনা দেখে রাজাকার আর মিলিটারীরা ভীষণ অবাক হলো। তবে খাঁচা থেকে তাকে বের করলো না। এই ভাবে টানা তিন মাস তিনি বাঘের খাঁচায় রইলেন। বাঘ তাকে স্পর্শও করলো না। তার সামনে প্রায়ই অন্যদের ধরে এনে বাঘের খাঁচায় দেয়া হতো, বাঘ মুহূর্তেই তাদের ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলতো। বাঘের আক্রমনে যারা গুরুতর আহত হতো কিন্তু মারা যেত না, তাদের আবার বাইরে এনে গুলি করে মেরে ফেলা হতো।
পরে তাকে ঠাকুরগাঁও জেল-হাজতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে এক পরিচিতের মাধ্যমে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এখনো তিনি শরীরে অজস্র ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন।
আর আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় এখনও তার কোনো নাম নেই!
*
১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের সময় পাঞ্জাবী আল্লারাখা খান কি মনে করে পাবনা শহরে চলে এসেছিলেন তা আজ আর কারও মনে নেই। তিনি পাবনা শহরেই এক বাঙ্গালী রমনীকে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে যান। তিনি ছিলেন পুলিশের লোক। অস্ত্র চালনা ভালই জানতেন। তার এক ছেলে ছিল শরীফ খান।
তারপর একদিন দেখতে দেখতে চলে এল ১৯৭১ সাল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সেই সময় পঞ্চাশ জন পাক সেনার একটা দল হঠাৎ পাবনার শহরে পুলিশ লাইনে হামলা চালালো। পাবনার পুলিশ বাহিনী জনতাকে সাথে নিয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করে ঘিরে ফেলল। শুরু হল যুদ্ধ। আশ্চর্যের ব্যাপার প্রায় ৩৫ জন পাক সেনাকে মেরে ফেলল স্বাধীনতা কামী জনতা আর পুলিশ মিলে। বাকি ১৫ জন পাক সেনা গিয়ে আশ্রয় নিল পাশের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। ওদিকে খবর পেয়ে পাক বাহিনীর দু’তিনটা কনভয় ছুটে আসছিল পাবনার দিকে। এ খবর কিভাবে পেয়ে গেলেন আল্লারাখা খান, তিনি তার তরুণ ছেলে শরীফ খান আর তৃতীয় একজনকে নিয়ে মাত্র তিনটি রাইফেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, সার্কিট হাউজের পাশের একটা টয়লেটের জানালা দিয়ে তিনি গুলি শুরু করলেন। তার সঙ্গের লোকটি নাকি রাইফেল চালাতেই জানতো না। তিনি ছেলে কে গুলি করতে দিয়ে সঙ্গের লোকটিকে তখন তখনই শিখিয়ে দিয়ে গুলি করতে বলেন। ধুন্ধুমার গুলি চালিয়ে যেতে লাগলেন তারা তিনজন। তাদের এই অতর্কিত আক্রমনে বেশ কয়েকজন পাক সেনা মারাও গেল। সে যাত্রা তাদের ঠেকিয়েই দিলেন আল্লারাখা খান আর তার ছোট্ট দলটি। এই গোপন প্রতিরোধ খুব বেশী মানুষ জানল না। কিন্তু পাক বাহিনী ঠিকই মনে রাখল।
মাসখানেক পরে প্রতিরোধ ভেঙে পাক বাহিনী পাবনা শহরে ঢুকলো। তখন তরুণরা সব ছুটছে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে ভারতে, সেই দলের সঙ্গে আল্লারাখা খানও রওনা দিলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। উর্দুভাষি বলে তাকে পাকিস্তানী চর’সন্দেহে তাকে নেয়াতো হলই না উল্টো মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হল। তবে পরিচিত কয়েকজনের হস্তক্ষেপে সন্দেহ দূর হলেও তিনি সেই দলের সঙ্গে ভারত যেতে পারলেন না। ফিরে এলেন পাবনায়… এবং ধরা পরলেন পাক বাহিনীর হাতে। তার ছেলে এবং আরও কয়েকজন ধরা পড়ল তার সাথে। পাক বাহিনী সেই প্রতিরোধের সূত্র ধরেই তাকে ধরেছে।
তখন আল্লারাখা খান পাক বাহিনীর কাছে সব স্বীকার করলেন যে তিনিই সেই পাঞ্জাবী (তাদের ভাষায় গাদ্দার) সেই দিন এককভাবে তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি পাকবাহিনীকে বললেন মাত্র তিনটি রাইফেল নিয়ে তিনি একাই সুবিধা জনক স্থান থেকে তাদের প্রতিহত করেছিলেন। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল না। পাকবাহিনী তাদের স্বজাতি বলেই হয়ত তাকে বিশ্বাস করল এবং তার ছেলে আর সঙ্গের কয়েকজনকে ছেড়ে দিয়ে আল্লারাখা খানকে আরও অন্য সাতজনের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করল। না আল্লারাখা খান কোনো পদক পাননি। তাকে আমরা মনেও রাখিনি। হয়তো বাংলার মাটি তাকে মনে রেখেছে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন