অটোক্যাড বা কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন এবং এইরকম আরও নকশা প্রণয়নের যে সফটওয়্যারগুলো এখন বাজারে আছে সেগুলোর আবির্ভাবের পূর্বে, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংগুলো কাগজের বড় একটি পাতায় ড্রইং বোর্ড এর উপর রেখে আঁকতে হতো। ড্রইং বোর্ড, বিভিন্নরকম এর গ্রেড পেন্সিল, ইরেজার, টি-স্কোয়্যার, সেট স্কোয়্যার এরকম নানারকম সরঞ্জাম লাগতো শুধুমাত্র একটি ড্রইং শেষ করতে।
কাগজের উপরে এই যে নকশা বা ড্রইং আকা এটার একটা বড় সমস্যা ছিল, একবার এটা কাগজের উপর আঁকা শুরু হয়ে গেলে অনেক সময় মাঝপথে সেখানে কোন পরিবর্তন আনা যেত না। অর্থাৎ কোন কারণে নকশাতে পরিবর্তন আনতে হলে তখন ইঞ্জিনিয়ারদেরকে স্কেচগুলো আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ শুরু থেকে আঁকতে হতো, যেটা অনেক সময়সাপেক্ষ, কিছুটা বিরক্তিকরও বটে।
যদি আমরা ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাবো যে প্রকৌশল সংক্রান্ত খসড়া এবং নকশার ইতিহাস আসলে মানুষের ইতিহাস, মানবজাতির দ্বারা কোন কিছু নির্মাণের ইতিহাস এর সাথে জড়িত। সময়ের শুরু থেকেই কোন কিছুর জন্য খসড়া আঁকা বা নকশা করা এ ব্যাপারটা ছিল। যেমন ধরুন আমরা ছোটবেলায় পরীক্ষার খাতায় মানচিত্র আকতাম। যাতে পরীক্ষা হলে দ্রুত আঁকা যায় এজন্য অনেকে বাসা থেকে পরীক্ষার আগে দুই একবার রাফ হিসেবে মানচিত্র এঁকে প্র্যাকটিস করে যেতাম।
প্রায় ৪০০০ বছর পূর্বে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়কার একটি দুর্গের ‘বার্ডস আই ভিউ’প্ল্যান এর জীবাশ্ম নমুনা পাওয়া যায়, বলা হয় ইঞ্জিনিয়ারিং খসড়ার ক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে সবচাইতে আগের প্রমাণিত নথিপত্র, যা ইতিহাসে পাওয়া যায়।
ড্রাফটিং এর ইতিহাসের একটা বড় সময় ধরে এটা ছিল একটা শিল্প, যেটা বছরের পর বছর ধরে দক্ষ নকশাকারীদের মাধ্যমে পূর্নতাপ্রাপ্ত হয়েছে, ড্রাফটিং বা রাফ আঁকা-আকি একটি সভ্যতার অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয়। অনেক অনেক দিন ধরে ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে সবাই বুঝতো, একটা কাগজ বের করে পরিকল্পনাটা প্রথমে হাতে এঁকে ফেলা এবং নকশা করা।
আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং খসড়ার যুগ শুরু হয়েছিলো ১৯৬৩ সালে, যখন ইভান সাদারল্যান্ড স্কেচপ্যাড নামে একটি ছোট্ট প্রোগ্রাম আবিস্কার করেন। এটা ছিল গ্রাফিক্যালি ইন্টারফেসড ক্যাড বা সি এ ডি প্রোগ্রাম, যেটা এর ব্যবহারকারীকে এক্স-ওয়াই প্লট বা নকশা তৈরি করতে সাহায্য করে।
সেসময়ের ইঞ্জিনিয়াররা যে এই প্রোগ্রামটি নিজেদের প্রতিদিনের কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন ব্যাপারটা এমন নয়, কিংবা অনেকে আদৌ ব্যবহার করতেনই না। তবে বর্তমানে যে কম্পিউটার এর সহায়তা নিয়ে ডিজাইন শিল্পের ব্যাপক উৎকর্ষ চালু হয়েছে এটার শুরু হয় এই প্রোগ্রামের মাধ্যমেই।
১৯৬০ এর শুরুর দিকেই বোয়িং, ফোর্ড, সিত্রোঁ, জিএম, এম এই টি এর ইঞ্জিনিয়াররা এই ক্যাড বা সি এ ডি প্রোগ্রামে টাকা-পয়সা, সময় এবং নিজেদের মেধাকে কাজে লাগাতে শুরু করেন, এবং সেটা বেশ জোরে শোরে। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ক্যাড স্বয়ংক্রিয় যান তথা মোটর কার এবং আকাশযান তথা রকেট, বিমান ইত্যাদির নকশা সহজে তৈরি করার উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়।
আজকের হিসাবে তখনকার ক্যাড প্রোগ্রাম অনেক অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ছিল এবং এটা ইঞ্জিনিয়ার কত বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন তার উপর ও অনেক বেশি নির্ভর করতো, কারণ তখন এটার তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়া এখনকার কম্পিউটারের তুলনায় অনেক অনেক কম ছিলো।
পরের পঞ্চাশ বছরে মুর’স ল এবং ইলেক্ট্রনিক্সের দ্রুত বৃদ্ধির ফলে ক্যাড বা সি এ ডি প্রোগ্রাম এর সক্ষমতাও সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে। আর এই উন্নয়ন এর ধারা চলাকালীন সময়েই ইঞ্জিয়ানিয়ারিং এর দুনিয়ায় আসে নতুন এক নাম, অটোডেস্ক। যখন অটোডেস্ক আসে তখন কম্পিউটার হার্ডওয়্যার তেমন সুলভ ছিল না, শুধুমাত্র এজন্যেই ক্যাড প্রোগ্রাম এবং এর ব্যবহারকারীরা এর সর্বোচ্চ সুবিধা পাচ্ছিলেন না।
যদিও ৮০ এর দশকের শুরুতে প্রযুক্তিগত খাতে একটু বিশাল উদ্যোগ নেয়া হয়, যেন ক্যাড প্রোগ্রাম টি সম্পূর্ণরুপে ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার এর উপযোগী হয়ে উঠে, তারপরে ও এটি পুরোপুরি ভাবে নকশা তৈরি করার জন্য সক্ষম হয়ে উঠতে উঠতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ৯০ এর শুরু কয়েকটি বছর।
আগে খসড়া আঁকা বা রাফ অঙ্কন এ জিনিষটা একি সাথে ছিল যেমন বিরক্তিকর তেমন প্রচুর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখানে যে ছবি গুলো দেয়া সেগুলো দেখলেই এই কথাগুলোর সত্যতা টের পাওয়া যায়। খুব ভালভাবে তাকালে আপনি ছবিগুলো দেখে প্রায় কাগজের খচমচ খচমচ শব্দ শুনতে পাবেন। এখন শুধুমাত্র নিজেদের মাউস আর কিবোর্ড এ কয়েকটা বাটন এ চাপ দিয়েই স্থপতি এবং অন্যান্য ইঞ্জিনিয়াররা তাদের খসড়া বা রাফ আঁকার কাজটা শেষ করে ফেলতে পারেন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন