একজন তরুণী সাংবাদিক বসার ঘরে বসে গ্যাবোর প্রতীক্ষায়। ডাক্তার নিষেধ করেছে, প্রেসের সঙ্গে কথা বলার কোনো দরকার নেই, গ্যাবোর ডিমেনশিয়া। তিন মিনিট আগের কথা মনে রাখতে পারেন না। সুতরাং সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা উচিৎ হবে না। আর তরুণ-তরুণী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলা মানেই বারবার জিজ্ঞেস করবে, আপনার নিউমোনিয়া হবার পর অনুভূতি কী? অথবা ওয়াও চিৎকার করে বলবে, আপনার ৮৭ বছর বয়স তবুও এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে কেন? কোনো দরকার নেই। হয়েছে তো অনেক নাম, অনেক সাক্ষাৎকার। গ্যাবোতো নিজেই বলতেন, লেখাগুলো ভাঙ্গা স্যুটকেসে রেখে দিলেই পারতাম। মৃত্যুর পর ছাপলে এই শোবিজের টেন পার্সেন্টের ব্যবসা ফাঁদতে হতো না। কোন ভাবনা থেকে শতবর্ষের নীরবতা উপন্যাস লিখেছেন; এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে গ্যাবো এতো বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন; যে এক সময় এই প্রশ্নের উত্তরে উনি শুধু জিভ দেখাতেন। সেই গুন্টার গ্রাসের ‘জিভ কাটো লজ্জায়’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ হয়ে গিয়েছিলেন গ্যাবো।
ওয়াশিংটন সাদ্দামের কাছে জনশংকামূলক মারণাস্ত্র রয়েছে এই কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করে যখন বাগদাদ গুড়িয়ে দিলো, বুশ যখন বলতে শুরু করলেন, তুমি হয় আমাদের সঙ্গে বা বিরুদ্ধে; ওদের সঙ্গে; তখন থেকেই গ্যাবোর মনে হলো, ‘শতবর্ষের নীরবতা’ উপন্যাসে যে ম্যাকন্ড নামের উন্মাদ গ্রামের কথা বলেছেন তিনি, সেটা ওয়াশিংটন। সুতরাং জিভ দেখানোই এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর। কারণ গোটা পৃথিবী জুড়ে বানানা রিপাবলিক তৈরীর অভিসন্ধি পাগল বুশের মনে। ইরাকের কলাচাষী সাদ্দাম ইরাকে গণতন্ত্র কলা চাষে ধর্মঘট ডাকলে রাতারাতি বাগদাদের কলাচাষীদের হত্যা করে মার্কিন সেনারা। মৃতদেহ গুলো কোথায় হারিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
গ্যাবো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা রাখতেই, পা ভিজে যায় লাল রক্তে। বাগদাদের রক্ত শত বর্ষের নীরবতার স্রষ্টার কাছে ছুটে এসেছে; জানান দিতে, বুশ সেই উন্মাদ কলার ব্যাপারী যে বাগদাদের অসহায় কলা চাষীদের হত্যা করেছে। গ্যাবো ছুটে যান ওয়াশরুমে। পা ধুয়ে একটা সিগার ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই শুরু হয় নীল রঙের ফুলের বৃষ্টি। বাগদাদের বেদনায় আকাশ কাঁদছে। গ্যাবোর মুখ ধুয়ে যায় বেদনার নীল ফুলে।গ্যাবোর সামনে একটা চিরকুট। তাতে লেখা লারা, বোগোতা। পরিচিত নাম; খুব পরিচিত। কিন্তু এই লারাতো বোগোতায় গ্যাবোর দুই ক্লাস নীচে পড়তো; সে তরুণী হয় কী করে! এসেছে ওয়াশিংটন থেকে; কাগজে লেখা বোগোতা। গ্যাবোর খটকা লাগে; আবার রহস্যময় লাগে। দেখা যাক।
লারাকে ওপরের ব্যালকনিতে ডেকে পাঠায়। তারপর ভুলে যায়। নিউমোনিয়ার সঙ্গে কী ভালোবাসার কোন সম্পর্ক আছে! তা নাহলে বোগোতা লেখা লারা নামটি কেন হঠাত তার হাতে। লারা মার্কিন বানানা ট্রেডারের মেয়ে ছিল। বোগোতায় ওর বাবা রেমন্ড-এর ছিল বিশাল গুদাম। সেইখানে গ্রাম থেকে কলাচাষীরা আসতো কলা বেচতে। কৃষকদের খুব অল্প পয়সা দিতেন রেমন্ড সাহেব। গ্যাবো লারাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার বাবা লোক ঠকায়; তুমি তাকে কিছু বলো না! স্প্যানিশ লিটারেচারের তুখোড় ছাত্রী লারা বলতো, কলার ব্যাপারী নিয়ে কথা বলা সময় নষ্ট। তুমি বরং তোমার নতুন লেখা কবিতাটা পড়ো। লাইব্রেরীতে লারার সঙ্গে যাওয়া পড়তো। সেখানে লং স্কার্ট পরা মেয়েটি রাজহাঁসের মতো গলা ফুলিয়ে গ্যাবোর কবিতা পড়তো। মেয়েটার ঢং ছিল অনেক। এমন আলেয়ার নেশায় গ্যাবো ইচ্ছে করেই পড়েনি। কারণ ও হচ্ছে কলার ব্যাপারীর মেয়ে। আর গ্যাবো প্রতিদিন কলাচাষীর ঋণের দায়ে আত্মহত্যার প্রতিবেদন নিজের হাতে সম্পাদনা করে নিউজ রুমে। লারা ঘাতকের মেয়ে। অথচ কবিতার প্রতি এমন ঝোঁক। এটা মেলাতে পারে না গ্যাবো।
ছোট বেলায় দাদীমার কাছে গল্পে শুনেছিল, কলার ব্যাপারীরা সঙ্গে করে ধর্মটাকে এনেছিল, ব্যবসাটাকে পাকাপোক্ত করতে। একজন পাদ্রী এসেছিল বোগোতায়। সে বলেছিল সে রুটি-কাপড়-গৃহের ব্যবস্থা করবে; বোগোতার সব মানুষের জন্য; যদি তারা খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। পাদ্রীটা এক বানানো গল্প বলে। সূর্যের সন্তান নাকি এক নারীর পেটে জন্মেছে। সেই এই ধর্মের মহাপুরুষ। দাদী খিল খিল করে হাসতো। বল গ্যাবো তোর বাপ-মা কলেরার মাঝে মেলামেশা না করলে, তুই এমনি এমনি কী তোর মায়ের পেটে আসতে পারতি! আচ্ছা সেটা বাদ দে। আমার যদি তোর দাদার সঙ্গে দেখা না হতো, তোর বাবা অমনি অমনি হাওয়া থেকে জন্মাতো। যত সব মারিজুয়ানা খাওয়া গল্প। আমরা গাছ ভালোবাসতাম, পাহাড় ভালবাসতাম, আকাশ ভালোবাসতাম। চাঁদ সাক্ষী রেখে তোর দাদা আমাকে বিয়ে করেছিল। আমাদের একটা নৈসর্গিক ধর্ম থাকতে; ঐ পাদ্রীর ধর্ম কেন নিতে হবে! তাও একটা আজগুবী গল্প নিয়ে হাজির হয়েছে।
তারপর দাদী যে গল্প বলেছিল, তা ভয়ংকর। পাদ্রী রুটি-কাপড়-বাড়ির লোভ দেখিয়ে একদল লোককে একটা চার্চে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারে। উজাড় হয়ে যায় পুরো লোকালয়। গ্যাবোর দাদীর জেদাজেদীতেই ওর দাদা সেদিন চার্চে যায়নি। বেঁচে যায় গ্যাবোর দাদা। গ্রামের পুরুষ মানুষেরা মারা যাবার পর সে জনপদ হয়ে ওঠে এক বিধবাদের গ্রাম। সেইখানে একদল মার্কিন সেনা আসে। তারা ধর্ষণ করে গ্রামের নারীদের। নারীরা অনেকেই সন্তান সম্ভবা হয়ে ওঠে। পাদ্রী সবাইকে ডেকে বলে, তোমাদের পেটে সূর্যের সন্তান। সূর্যই এদের পিতা।এই গণহত্যা ও গণধর্ষণের গল্পটা দাদীমার কাছ থেকে শোনা ছিল। তাই লারাকে শত্রু মনে হয়। প্রতিদিন যেন ওর সঙ্গে শত্রু শত্রু খেলা। ও ওদের বাড়ী থেকে সাহেবী খানাদানা নিয়ে আসতো গ্যাবোর জন্য। ইউনিভার্সিটির ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে সে অনেক আগ্রহ নিয়ে গ্যাবোকে খাওয়াতে চাইতো। গ্যাবো খেতে চায় না। লারা সাধাসাধি করার পর গ্যাবো তার দাদীর কাছ থেকে শোনা রাক্ষস পাদ্রীর ঘটনাটা বলে। লারা স্তব্ধ হয়ে যায়। গ্যাবো তখন লারার দেয়া কালো পাউরুটি আর সসেজ খায়।
ব্যালকনিতে হঠাত গ্যাবো দেখে সেই লারা দাঁড়িয়ে। সেই মিষ্টি হাসি। সেই লং স্কার্ট ঘিয়ে রঙ। লম্বা দীঘল চুল। চোখগুলো সাগর ধোয়া নীল। কিন্তু এ কী করে সম্ভব। গ্যাবো লারাকে জিজ্ঞেস করে, আমি বুড়ো হয়ে গেলাম, আর তুমি এমন তরুণী থেকে গেলে লারা। লারা সেই ঝরণার মত করে হাসে, তুমি বুড়ো হয়েছো কে বলেছে! তুমি সেই আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। দূর তুমি আমার ডিমেনশিয়ার সুযোগ নিচ্ছো। তুমি লারা নও। লারা গ্যাবোকে জোর করে ধরে আয়নার সামনে নিয়ে আসে। গ্যাবো অবাক হয়। সত্যিই তো। সেই ইউনিভার্সিটি দিনের চেহারা; সেই তরুণ সাংবাদিক, যে কলাচাষীর আত্মহত্যার প্রতিবেদন সম্পাদনা করতো প্রতিদিন। লারাকে জানাতো প্রতিটি মৃত্যুর খবর। ও ডায়েরীতে লিখে রাখতো কতজন মারা গেল সেই সংখ্যাগুলো। একদিন সেই সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। গ্যাবো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। লারা ওর চোখ মুছে দেয়। লারার চোখ দিয়ে রক্ত অশ্রু পড়ছিল। গ্যাবো রুমাল দিয়ে লারার চোখ মুছে দিলে রুমালটা লাল পতাকার মত হয়ে ওঠে। এতো গুলো মানুষের মৃত্যুতে একটা রুমাল তো লাল পতাকা হবেই। লারা গ্যাবোর সাদা রুমালটাকে রক্ত অশ্রুর লাল পতাকা বানিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল, সেই শেষবার। তারপর আর লারার সঙ্গে কোন দিন দেখা হয়নি। গ্যাবো লারার বাবার গুদামে গিয়ে খোঁজ খবর করে। একজন ম্যানেজার মতো লোক বলে, আমরাও রেমন্ড সাহেব আর তার মেয়ে লারাকে খুঁজছি। কোথায় গ্যালো তারা! আপনি কিছু জানেন, আপনি তো সাংবাদিক।
কী হয়েছিল লারা হঠাত তোমরা কোথায় চলে গেলে। এমেরিকা। আমাকে একবার বলেও গেলেনা। আমি কত খুঁজেছি তোমাকে, কত অপেক্ষা করেছি।লারা এসে গ্যাবোর কাঁধে হাত রাখে, আমাকে একটু রঙ্গিন নিউমোনিয়া দেবে গ্যাবো; আমি কত বছর অপেক্ষা করে আছি একটু নিউমোনিয়ার উষ্ণতার জন্য। ঘরের সিডি প্লেয়ারে পুরনো দিনের স্প্যানিশ ইন্সট্রুমেন্টাল ছেড়ে দেয় লারা। আহা কত প্রিয় সেই সুর। বোগোতায় কত শোনা হতো, রামজলের দোকানে বসে। গ্যাবো চোখ বন্ধ করো। আমার কাঁধে হাত রাখো, আমি লম্বায় একটু ছোট, তবুও মনে নেই, বোগোতার রামজলের দোকানে সন্ধ্যেবেলা দুজন কত নেচেছি। নিউমোনিয়ার ঘোরে আক্রান্ত হয় লারা। নিউমোনিয়া কেমন রামজলের মতো ঝাঁঝ অলা অথচ কী এক ইক্ষু গন্ধ, কী মাদকতা। গ্যাবোর সামনে লারা ঘুরতে থাকে ব্যালেরিনার ভঙ্গিতে। গ্যাবোও আঙ্গুল ধরে লারাকে সামনে পিছে ডানে বামে ঘুড়ির মতো ওড়াতে ওড়াতেই বোগোতার সেই রামজলের দোকানটা এসে পড়ে।আহা সেই লোক গিজ গিজ হুল্লোড় আর নাচের নিউমোনিয়া।কী হয়েছিলো লারা? তুমি আর তোমার বাবা কোথায় হারিয়ে গেলে! আমাকে একবার বলেও গেলে না!
আমি ঐ লাল-রুমাল, সেই তোমার দেয়া রুমালটাতে জড়িয়ে নিয়েছিলাম আমার বাবার পিস্তলখানা। বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সমুদ্রের ধারের পাহাড়ে চাঁদ দেখবো বলে। বাবা কিছু বোঝার আগেই আমি বাবাকে গুলি করে পাহাড় থেকে সমুদ্রে ফেলে দিই। আমিও ঝাঁপ দিই সমুদ্রে। ডুবে যাই।হারিয়ে যাই।
হঠাত একটা ভূকম্পন টের পায় গ্যাবো। একটা টুরিস্ট রিসর্টে নীল চাদরের উষ্ণতায় নিজেকে আবিষ্কার করে লারার সঙ্গে সেই ৬৫ টি বছরের অপেক্ষার আলিঙ্গনে। আমরা কোথায় লারা! আমরা মেক্সিকো সিটিতেই সমুদ্রের ধারে। দেখো বাইরে আজ হলুদ রঙের ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা দুজন একশো বছরের নিউমোনিয়ার ভালোবাসাবাসির শুরু করলাম আজ থেকে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন