২০২২ সাল শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে দীর্ঘ এক ইতিহাসেরও। দীর্ঘ ৮১ বছরের পথচলা থামিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা রেডিও শেষবারের মত সম্প্রচার করা হয়। সুদীর্ঘ ৮১ বছর ধরে বিবিসি বাংলা তার শ্রোতাদের মনে একটু একটু করে স্থান করে নিয়েছে। আর এই পথপরিক্রমায় বিবিসি বাংলা জন্ম দিয়েছে অনেক অনেক গল্প। সেসবেরই কিছু আজ eআরকির পাঠকদের জন্য।
১। মাত্র ১৫ মিনিট
১১ অক্টোবর, ১৯৪১ সালে শুরু হয় বিবিসি বাংলার সম্প্রচার। সেসময় লন্ডন থেকে বাংলায় নিউজলেটার পড়ে শোনানো হতো। এই অনুষ্ঠানটির ব্যপ্তিকাল ছিল সপ্তাহে মাত্র ১৫ মিনিট। জী হ্যাঁ, পুরো সপ্তাহে মাত্র ১৫ মিনিট বরাদ্দ ছিল। যারা তখন বিবিসি বাংলার সংবাদ শুনতেন তাদের কতই না ধৈর্য ছিল ভাবুন তো প্রিয় পাঠক।
২। এরিক ব্লেয়ারের কথিকা
প্রথম দিকে ইংরেজি কথিকা পড়ে শোনানো হতো বিবিসি বাংলা থেকে। কথিকাগুলো পাঠ করতেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক ড. সুধীন ঘোষ।
এই কথিকাগুলো লিখতেন সাংবাদিক প্রবন্ধকার, ঔপন্যাসিক এরিক ব্লেয়ার। যাকে আমরা সবাই জর্জ অরওয়েল নামে চিনি।
৩। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষতা
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তার ছয় বছর আগে থেকেই বিবিসি বাংলা সংবাদ পরিবেশন করা শুরু করেছে। অচিরেই তারা নিজেদের নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের কারণে সকলের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তাই যুদ্ধের সময় কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধের খবর পাবার জন্য বিবিসি বাংলার খবর এর উপর পুরোপুরি নির্ভর করতো।
৪। মিত্রপক্ষের বার্তা
বিবিসি বাংলার ইতিহাস এর পাতা থেকে জানা যায়, ১৯৪১ সালে ও এর পরবর্তী আর ৪ বছর ধরে চলমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিবিসি বাংলা সম্প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। এসময় যাতে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় উপমহাদেশীয় সৈন্য এবং তাদের পরিবার অক্ষশক্তির প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হন, এ লক্ষ্যেই মিত্রপক্ষের বার্তা পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয় বিবিসি বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
৫। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'বিচিত্রা'
১৯৪৪ সালের কোন এক সময়ে সপ্তাহে ১টির বদলে দুইটি করে কথিকা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা শুরু হয়। তারপরে ৩১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় ৩০ মিনিট ব্যাপী নতুন এক অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানটি ছিলে নানা ধরনের ছোট ছোট আয়োজনের মিশ্রণ, এর নাম দেয়া হয় বিচিত্রা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে অনুষ্ঠানটির পরিচিতি সঙ্গীত ছিল এখনকার ভারতের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন অধিনায়ক জয় হে গানটির সুর। তবে ভারত জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ১৯৪৭ সালে গানটি গ্রহণ করার পরে তা আর বিবিসি বাংলা ব্যবহার করেনি।
৬। মহিলাদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান
ভারত ভাগ হবার পরে ১৯৪৯ সালে নতুন একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা শুরু হয় শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য। অনুষ্ঠানটির নাম ছিলো আঞ্জুমান। এ অনুষ্ঠানে মহিলাদের জন্য সম্পূর্ণ বিশেষ একটি অংশ, এ অংশটি পরিচালনা করতেন পিয়ারী আপা ছদ্মনামে শরিফা আলম।
৭। দুই দেশের মিলন
যদিও বাস্তবে উপমহাদেশের মানুষের এখন তিনটি দেশে বিভক্ত। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বিবিসি বাংলা দুই সীমান্তের মানুষের মাঝে কাটাতারের বেড়া সরিয়ে দেবার একটি উদ্যোগ নেয়। ব্যস্ত হবেন না পাঠক। ২ জুন, ১৯৬৯ থেকে ভারতীয় বাংলা বিভাগের অন্তর্গত অনুষ্ঠান বিচিত্রা আর পূর্ব পাকিস্তানের অনুষ্ঠন আঞ্জুমান এর পাশাপাশি শুরু হয় এক নতুন অনুষ্ঠান। প্রবাহ নামের সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো সন্ধ্যাবেলায়।
৮। ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ কে?
২০০৪ সাল বিবিসি বাংলার সম্পাদক ছিলেন সাবির মুস্তাফা। এসময় শ্রোতা জরিপের ভিত্তিতে তারা একটি অনুষ্ঠান শুরু করেন। সেটি হচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? অনুষ্ঠানটির প্রচার শুরু হয় সে বছরের ২৬শে মার্চ, আর লক্ষ্য স্থির করা হয় পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল জানানো হবে সর্বকালের সেরা ২০ বাঙ্গালির মধ্যে শ্রোতারা কাকে বেছে নিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে নিয়েছেন। তালিকায় যখন আস্তে আস্তে সেরা ১০/১১ নম্বরে ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা হয় তখন থেকেই অনেকগুলো পত্রিকা এ ব্যাপারটি তাদের পত্রিকায় ছাপানো শুরু করে।
তারপর ১৩ এপ্রিল তারিখে যখন তালিকায় দু’নম্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ঘোষণা করা হয় তখন থেকেই সম্পাদক সাবির মুস্তাফা ফোন পেতে থাকেন। কারণ ১৫ তারিখে কোন পত্রিকা ছাপা হবে না। তাই পত্রিকাগুলো চাইছিলেন সাবির মুস্তাফা তাদের কে আগেই যেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির নামটা বলে দেন।
অতঃপর, ১৪ই এপ্রিল ভোর সাড়ে ছ’টায় বিবিসি বাংলা প্রভাতী অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে শেখ মুজিবের নাম ঘোষণা করা হয়।
৯। বাংলাদেশ সংলাপ
বিবিসি বাংলার আয়োজন বাংলাদেশ সংলাপ বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’-এর সহযোগিতায় সম্প্রচারিত একটি অনুষ্ঠান। সমসাময়িক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে শ্রোতা, দর্শক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সরাসরি অংশগ্রহণে এ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। 'বাংলাদেশ সংলাপের' প্রতিটি অনুষ্ঠানে শ্রোতারা আমন্ত্রিত প্যানেল সদস্যদের কাছে তাদের প্রশ্ন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মতামত দেন। অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি হচ্ছে ৫০ মিনিট।
১০। সবশেষ পরিক্রমা
২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিবিসি দশটি ভাষায় রেডিও সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে করে বিবিসির প্রায় ২৮.৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ কমাতে পারবে। ২০২২ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর 'পরিক্রমা' অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে দেবার মাধ্যমে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন