স্টেলার মতো বুদ্ধিমান কুকুর পৃথিবীতে আর দুটা নাই। তার বুদ্ধির একটা ছোট্ট নমুনা দেই।
কিছুদিন আগে আমরা যে বাসায় থাকতাম সেই বাসার মেঝে পুরোটাই বাই ডিফল্ট কার্পেট বিছানো, পার্মানেন্ট। তাই সেটাকে নিয়মিত পরিষ্কার রাখাও আমাদের দায়িত্ব। স্টেলাকে সকাল-বিকাল দুইবার বাইরে হাঁটাতে নিয়ে যাই আমি না হয় দিয়া। বাইরে বেশিরভাগ সময়ই থাকে প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি। কাজেই হাঁটিয়ে নিয়ে আসার পর স্টেলার পা স্বাভাবিক কারণেই ময়লা হয়ে যায়। এ জন্য আমি স্টেলাকে ট্রেনিং দিলাম, তিনতলা বাসায় দরজা খোলার পরই সে বাসায় ঢুকে যাবে না। দরজার বাইরে সে অপেক্ষা করবে, আমি ভিতরে যাবো, কিচেন টাওয়েল পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে এসে তার চার পা মুছে দেবো। এরপর মুখে 'গো' বলে হাতে সিগন্যাল দিলে সে ভেতরে ঢুকবে। দুই দিনেই এই জিনিস সে শিখে ফেললো। বাইরে থেকে এসে আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি, সে থাবা গেড়ে বাইরে আমার কিচেন টাওয়েল নিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। মোছা শেষ হলে ‘গো’ বললে লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। এভাবে চললো চার-পাঁচ মাস। একদিন মানে একদিনও সে নিয়ম ভাঙলো না। এমনকি আমি অনেকদিন ভেতরে ঢুকে আগে ওয়াশরুমে গিয়ে ৩/৪ মিনিট কাটিয়ে ফিরে এসেও দেখতাম সে বাইরে অপেক্ষা করছে পা মোছানোর জন্য।
একদিন বিকেলে হলো কি, বাইরে কাঠবিড়ালি বা কিছু একটা দেখে স্টেলা দিয়েছে তার পিছে পিছে দৌঁড়। সারা গা কাদায় মাখামাখি। ফিরতি পথে আমি দেখলাম আজ এতই কাদা যে কিচেন টাওয়েল দিয়ে হবে না। বাসার নিচে গাড়ি ধোয়ার একটা হোসপাইপ আছে। সেটা দিয়ে তার সারা শরীর ধুয়ে দিলাম। এরপর তাকে নিয়ে তিনতলায় উঠে বাসার দরজা খোলার পর এতদিনের নিয়ম ভঙ্গ করে সেদিন আর স্টেলা বাসার দরজায় দাঁড়ালো না। খোলা মাত্রই বাসায় ঢুকে গেলো। ...বুঝে ফেলেছে আজকে আর পা মোছার পর্ব নেই, সেটা নিচেই সেরে আসা হয়েছে। কুকুর জাতীয় প্রাণী যে এই ধরনের জটিল লজিক খাটাতে পারে সেটা দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হলাম।
করোনার এই সময়টাতে স্টেলার খুব আনন্দে কেটেছে। স্টার্ক নামের আরেকটা চমৎকার সঙ্গী পেয়েছে সে। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে স্টার্ক একদম স্টেলার উল্টো। সে কিছুটা উদাসীন, বন্ধুবৎসল, জীবন নিয়ে তার কোনো তাড়া নেই, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই তার নিজের ভাগের খাবার স্টেলাকে দিয়ে দেয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে গর্তে পড়ে যায়।
করোনায় আমি আর দিয়া যেহেতু পুরোটা সময় বাসায় ছিলাম, স্টেলা সারাদিন আমাদের সঙ্গ পেয়েছে। কিন্তু এখন অফিস-আদালত খুলেছে। আমরা দুজনেই বেরিয়ে যাই নানা কাজে। স্টেলা মোটেও এটা পছন্দ করছে না। বাইরে বের হওয়ার সময় হলেই, কাপড় চোপড় পাল্টাতে শুরু করলেই সে মন খারাপ করে খাটের নীচে মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকে। অনেক ডাকলেও সে আর তখন সেখান থেকে বের হয় না। অন্যদিকে স্টার্ক আমাকে বাসার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। সে জানে আমি ফিরে আসবো একটু পর। তার এত স্টেলার মতো সেপারেশন এনজাইটি নেই।
গত কয়েকদিন থেকে স্টেলা কিছু অদ্ভুত কাজ করছে যা সে আগে কখনো করেনি। সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পাই, আমি বের হয়ে চলে যাওয়া মাত্রই সে খাটের নীচ থেকে বের হয়ে আমি বিছানার যে পাশে শুই সে পাশে আমার মতোই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আমি না ফেরা পর্যন্ত অলমোস্ট একইভাবে শুয়ে থাকে। অন্যদিকে স্টার্ক ঘরময় ঘুরে বেড়ায়, ছাদে যায়, বিড়াল-পাখি তাড়া করে, বাইরের গেটের সিকিউরিটি আঙ্কেল ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা চেক করতে যায়।
সিসিটিভিতে গত পরশু স্টেলাকে আরেকটা অদ্ভুত কাণ্ড করতে দেখলাম। বিকেলের দিকে সে চেয়ার থেকে আমার ব্যবহৃত কয়েকটা টিশার্ট মুখ আর থাবা দিয়ে টেনে মেঝেতে ফেলে সেগুলোর উপর শান্ত হয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বসলো। আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে এই ঘটনার ব্যাখ্যা বের করলাম, কুকুর যখন ভয়ংকর সেপারেশন এনজাইটিতে ভোগে তখন তারা অনেকসময় নিজেরাই কমফোর্ট খোঁজার চেষ্টা করে। যেহেতু তাদের ঘ্রাণশক্তি মারাত্মক, তাই তারা তাদের মানুষ বন্ধুর জামা কাপড়ের গন্ধের ভেতর একটা কমফোর্ট খুঁজে পায়। এভাবেই তারা নিজেদের শান্ত রাখে।
কিন্তু গতকাল স্টেলা যা করেছে সেটা খুব আশ্চর্যের। স্টেলা কখনোই বাসার কোনো কিছু নষ্ট করে না। কিন্তু গতকাল সে আমার বাইরে বের হওয়ার একটা জুতা কামড়ে ছিলে ফেলেছে। আমি বাসায় ফিরে এটা দেখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী বিষয়, তুই এই কাজ কেন করলি...আগে তো কখনো এই কাজ করিসনি!’ সে তার চোখ দিয়ে কী জবাব দিলো বুঝতে পারলাম না...আমি জুতার শোকে তাকে ইনফ্যাক্ট কড়া করে দুইটা বকাই দিলাম। সে তখন মন খারাপ করে দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে অপরাধীর ভঙ্গি করে তাকিয়ে থাকলো।
অফিসের কাজে এতই ক্লান্ত ছিলাম যে জুতার শোক ভুলে গেলাম বিছানায় যেতেই। শোয়ামাত্রই ঘুম। ...শেষ রাতের দিকে স্বপ্ন দেখলাম স্টেলাকে। দেখি সে কথা বলতে পারছে, বললাম ‘আরে তুই কথা বলতে পারিস তাইলে এতদিন বলিস নাই কেন?’ সে বলল, সে নাকি সব সময়ই কথা বলে কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। আমি বললাম, ‘কিন্তু তার আগে বল, তুই আমার সাধের কেডসটা ছিঁড়লি কেন? তোর তো আগে কখনো ছেঁড়াছিড়ির স্বভাব ছিলো না!’ সে বলল, সে এইটার জন্য লজ্জিত কিন্তু কিছু করার নাই। এইটা তার আমাকে বাসায় আটকায়ে রাখার একটা ডেস্পারেট অ্যাটেম্পট। আমি বললাম, ‘সেটা কী রকম?’ তার সাফ জবাব, সে চায় না আমি তাকে রেখে কখনোই বাইরে যাই, কখনোই না। গেলেও তাকে যেন সাথে করে নিয়ে যাই। ফলে সকাল হলেই তার টেনশন বাড়তে থাকে আমি কখন চলে যাই। সে খেয়াল করে দেখেছে আমি মাঝে মাঝে বাইরে যাওয়ার জন্য জামা-কাপড় পরে ফেললেও আবার বাসাতেই কাজে বসে যাই, বের হই না। বা তাদেরও লিশ লাগাই সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যদি জুতা পরে ফেলি তাইলে নাকি আমাকে আর ঠেকানো যায় না। বের হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তাই সে জুতা নষ্ট করা শুরু করেছে যাতে অন্তত জুতার অভাবে হলেও আমি বাইরে বের হওয়া বন্ধ করি।
মাত্রই ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি স্টেলা বাকি জুতাটা মুখে করে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব এখন আর বুঝতে পারছি না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন