সবার অজান্তেই একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে বাংলাদেশে, আমাদের চিন্তায়, আমাদের কথা বলায়। এর ভেতর আবার সরকার চিন্তা করছে একটা নতুন আইন চালু করার যাতে আপনার আমার মতো সাধারণ নাগরিককে সাধারণ নাগরিক অধিকার চর্চার জন্য হলেও ক্যাক করে ধরতে পারে।
করোনা মহামারির এই সময়ে আমার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলো ফোন। যাদের সঙ্গেই ফোনে কথা বলা শুরু করেছি তারা কথোপকথনের এক পর্যায়ে বলেছে, 'নরমাল ফোনে এত কথা বলতে পারবো না, হোয়াটসঅ্যাপ আছে তোমার? সেখানে কথা বলি।' আমি বলেছি, 'কী সমস্যা এখানে কথা বললে?' 'আরে ফোন তো রেকর্ড হয়। কোথা থেকে কী কেটে কোথায় লাগায়ে দিবে কে জানে।'...এরপর অতি অতি সাধারণ কথাবার্তাও আমরা হোয়াটসঅ্যাপে চালিয়ে গেছি।
ধারণা অমূলক নয়। ফোন কোম্পানিগুলোর ঘাড়ে চেপে বসে সরকার আমাদের কথা শুনে। ফোন কোম্পানিগুলো যেহেতু বাংলাদেশের মাটিতে বসে এই সার্ভিস দেয় তাদের উপর নানা আইন চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ফোনে কথা বলার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে সরকার। যখন যেটা ফাঁস করা দরকার সেটা ফাঁস করে। সম্প্রতি সেটা আবার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়েও দেখা দিয়েছে। জর্জ অরওয়েলের '১৯৮৪' হয়ে উঠেছে সরকারের প্রিয় উপন্যাস। আমাদের কথা বলার পাশাপাশি চিন্তাও নিয়ন্ত্রন করতে চায়। ঠেলে দিচ্ছে সেল্ফ সেন্সরশিপের এক কঠিন গোলকধাঁধাঁয়।
মন ভরছে না সরকারের। দেশীয় ফোন কোম্পানির কথোপকথন ফাঁস করে আর হচ্ছে না। বিটিভির মতো সেখানে শুধুই এখন ফুল লতাপাতার গল্প। এবার তারা বিদেশী কোম্পানি যারা ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগ সুবিধা দেয় তাদের উপরও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শুনতে চায়, জেলে পুরতে চায় তাদের যারা এত এত ফ্লাইওভার আর উপর থেকে সিঙ্গাপুরের শহরের পরেও দমবন্ধ করা জ্যামে, পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরে, পাগলের মতো গ্যাস-বিদ্যুত-পানির দাম বাড়ার শহরে, টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে, বাড়িতে বসে হোয়াটসঅ্যাপে, সিগন্যালে, ভাইবারে সরকারের সমালোচনা করে--গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করা যেখানে নাগরিকের অতি সাধারণ অধিকার।
‘ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন রেগুলেশন-২০২১’ নামের এই প্রবিধানের খসড়া বলছে, বিধি লঙ্ঘনকারী কোনো বার্তা আদান-প্রদান করলে আদালত ও বিটিআরসির নির্দেশ সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট বার্তা প্রথম যিনি দিয়েছিলেন, তাঁকে শনাক্ত করে দিতে হবে। প্রথম ব্যক্তি যদি দেশের বাইরে অবস্থান করেন, তবে দেশে যিনি অবস্থান করবেন, তিনি ‘প্রথম’ বলে অভিযুক্ত হবেন। মানে এক ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে সাংবাদিক, সাধারণ মানুষদের গ্রেপ্তার করে, জেলে পুরে মন ভরছে না সরকারের। নতুন আইনে আরও শতশত দ্বিমত পোষন করা মানুষের মুখ বন্ধ করতে চায় সরকার।
মানুষ একটা জটিল প্রাণী। তাকে দমিয়ে রাখা খুব কঠিন। পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন এইসব আইন করে মানুষের কথা বলা থামিয়ে রাখতে পারেনি। হ্যাঁ, আইনের ভয় দেখিয়ে সাময়িকভাবে পেরেছে কিছু দেশ সেইসব দেশের নাম আপনারা সবাই জানেন, কিন্তু সেইসব দেশের নাগরিকও আমরা কেউ হতে চাই না। কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থেকেই আমি আপনি যে সেসব দেশের নাগরিকদের মতো হয়ে যাচ্ছি, আমাদের যে তাদের মতো বানানো হচ্ছে বুঝতে পারছেন? ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে থাকবেন-ভিআইপিরা সাঁই সাঁই করে চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে, রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি দেখবেন, তাদের টাকা পাচার দেখবেন, উচ্চদামে জিনিসপত্র কিনবেন, ধুলা খাবেন, খকখক করে কাশবেন কিন্তু আওয়াজ করতে পারবেন না, ঠিক আছে?
স্বাধীন বাংলাদেশে আমি আমার কথা বলার অধিকার চাই, সরকারের সমালোচনা করার অধিকার চাই, খারাপকে খারাপ বলার অধিকার চাই, আমি খারাপ আছি সেটা বলার অধিকার চাই, আমি অন্যায়ের শিকার হচ্ছি সেটা বলার অধিকার চাই, অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার চাই, ছাত্রছাত্রী অবান্ধব ভিসির বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার চাই, আপনাদের চুরি-চামারির বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার চাই, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার চাই, গুম-হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার চাই।
কিন্তু আপনারা যেসব ভয়ংকর জনবান্ধবহীন আইন করার পায়তারা করছেন তাতে অচিরেই দেশ থেকে ডেন্টিস্ট পেশাটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ নতুন এসব জনবিরোধী আইন করার চিন্তা বাতিল করুন।
আমাদের নাগরিক অধিকার চর্চায় আপনারা ভয় দেখাবেন না। দুর্নীতি কমান, অবৈধ টাকা বিদেশ পাচার করা থামান, আমাদের কথা বলার অধিকার কেড়ে না নিয়ে আপনারা শুদ্ধ হোন, আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করুন। আমাদের ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করুন।
মাথায় বন্দুক ধরলে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন